ছলের অভাব হয় না দুর্জনের। বর্তমান সভ্যতায় সেরা দুর্জন হলেন নেতানিয়াহু। তার আশেপাশে আরো অনেকে বিচরণ করছেন। কেউ কেউ তো এ দুর্জনকে টিকিয়ে রেখেছেন। দুর্জন নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ, ইসরাইলের রাজনীতিতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এ যুদ্ধ ছিল খুবই অপরিহার্য। কিন্তু বিভিন্ন বিবেচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতানিয়াহুর ওপর যুদ্ধবিরতিটা একরকম চাপিয়ে দিয়েছেন। পরিস্থিতির কারণে নেতানিয়াহুও তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। নিজের দেশেও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী কিছুটা সমস্যার মধ্যে ছিলেন। ঘুষ, জালিয়াতি এবং বিশ^াসভঙ্গের জন্য নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তিনটি মামলা রয়েছে আদালতে। এসব বিষয় থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে নেতানিয়াহুর প্রয়োজন ছিল যুদ্ধ। গত দু’বছর গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে পরিস্থিতি ভালোভাবেই সামাল দিয়েছেন তিনি। তবে এ চ্যালেঞ্জগুলোর কোনটাই সরে যায়নি। গাজায় যুদ্ধকালীন সময়েও ওইসব মামলার শুনানিতে বিলম্ব ঘটলেও বিচার চলমান আছে। বরং যুদ্ধবিরতির এ সময়ে বিষয়গুলো আরো বেশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠছে। বিচারে নেতানিয়াহুর ১০ বছরের কারাদ- হতে পারে। গাজায় দীর্ঘ যুদ্ধ এবং নেতানিয়াহুর দুর্নীতির বিচারের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বক্তব্য থেকেও উপলব্ধি করা যায়। ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটে সম্প্রতি দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে ক্ষমা করার জন্য ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জোগের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন। যুদ্ধ না থাকলে নেতানিয়াহুর কপালে যে বিপর্যয় নেমে আসবে, সে ব্যাপারে বিশ্লেষকদের অনেকেই নিশ্চিত। উল্লেখ্য, গাজায় ইসরাইলের দীর্ঘ যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যয় ও কূটনৈতিক চাপ বেড়েই চলছিল। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিয়েছে এবং সবকিছু তাদের সহ্যের সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করেন সাবেক ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত অ্যালন পিঙ্কাসসহ আরো অনেক বিশ্লেষক। যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিষয়টি নেতানিয়াহু উপলব্ধি করেছেন এবং যুদ্ধবিরতি মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু এটা অনুতপ্ত হয়ে কোনো সজ্জনের মেনে নেওয়া নয়, বরং দুর্জনের কৌশল মাত্র। তাই গাজা এখনো যুদ্ধমুক্ত হয়নি। বিপদমুক্তির জন্য নেতানিয়াহুর আর একটি যুদ্ধ প্রয়োজন, গাজায় কিংবা অন্য কোনো ভূগুলে।
আন্তর্জাতিক পরিম-লে এখনকার মতো এত বিচ্ছিন্ন আর কখনো ছিল না ইসরাইল। অনেকের মতে, নেতানিয়াহু এখন বিচ্ছিন্নতার মুখ হয়ে উঠেছেন। গাজায় গত দু’বছরের আগ্রাসনে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং পরিকল্পিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির কারণে বিশ^জুড়ে ইসরাইল বিরোধী মনোভাব তীব্র হয়ে ওঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিহীন নেতানিয়াহু টিকে থাকবেন কেমন করে? বর্তমান বাস্তবতায় ইসরাইলে ভাঙা-গড়ার এক খেলা শুরু করেছেন নেতানিয়াহু। তার কট্টরপন্থী জোটে ভাঙ্গনের শংকা দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় কাউকে বাদ দিয়ে এবং কাউকে গ্রহণ করে তার কট্টর ডানপন্থী জোটকে পুনর্গঠনের কৌশল গ্রহণ করেছেন নেতানিয়াহু। বর্তমানে আর একটি বড় প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছে। ট্রাম্প কি নেতানিয়াহুকে ত্যাগ করতে পারবেন? এটা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে বলে অনেকেই মনে করেন। কারণ, ইসরাইলকে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন ক্লান্ত। সবকিছুই তাদের ধৈর্য্য ও সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর নেতানিয়াহু অযৌক্তিক ও নৃশংস কর্মকা- এবং স্বেচ্ছাচারিতা বোধসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি নেতানিয়াহুও জানেন। কিন্তু যুদ্ধ তার প্রয়োজন-সেটা যে রূপেই হোক না কেন। তার বিকৃত মস্তিষ্ক মানবিক বোধের বাইরে গিয়ে এমন এক যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা কেবল একজন দুর্জনের পক্ষেই সম্ভব।
গাজায় আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ থেকে মুক্তি নেই ফিলিস্তিনিদের। ইসরাইলের প্রধামন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজায় ভিন্নরূপের এক যুদ্ধ শুরু করতে চাইছেন, যেখানে ইসরাইলি সৈন্যদের উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যেরও তেমন প্রয়োজন হবে না। সেনা ছাড়া এ যুদ্ধ পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনিদের জন্য রয়েছে আরো ভয়ানক বার্তা। ইসরাইলের ধ্বংসযজ্ঞে গাজায় তৈরি হয়েছে এক ভয়ংকর বাস্তবতা। সব কাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে। স্বাভাবিক জীবনযাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও দুর্ভোগকে পুঁজি করে আবির্ভূত হচ্ছে বিভিন্ন সশস্ত্রগোষ্ঠী। দলগুলো এক সময় ইসরাইলি দখলদারদের বিরুদ্ধে নিজেদের ‘প্রতিরোধ যোদ্ধা’ হিসেবে দাবি করতো। কিন্তু এখন তাঁরা ক্রমশই নিজেদের মানুষের দিকে অস্ত্র তাক করছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। মাতৃভূমির প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসার বদলে তারা সহিংসতার মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। তারা গোষ্ঠীতান্ত্রিক ও তথাকথিত রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির ধোঁয়া তুলে ফিলিস্তিনীদের যন্ত্রণার মাত্রা আরো বাড়িয়ে তুলছে। গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসন ও নিষ্ঠুর নির্যাতন দেখেছে ফিলিস্তিনীরা। গাজার বাসিন্দারা ইসরাইলী বিমান হামলায় ভয় পেতেন, কিন্তু অপরাধী গোষ্ঠী কিংবা প্রতিবেশীর বন্দুকের ভয় তাদের ছিল না। আজ তাদের ভয় বৃদ্ধি পেয়েছে। দখলদার ইসরাইলীদের ভয়তো আছেই, সাথে যুক্ত হয়েছে নিজেদের লোকদের ভয়ও।
গাজা সিটির সাবরা এলাকায় সাংবাদিক সালেহ আল জাফারাউইয়ের হত্যাকা- এক নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। ২৮ বছর বয়সী এ সাংবাদিক দীর্ঘদিন ধরে গাজায় ইসরাইলী নৃশংসতার দলিল তৈরি করছিলেন। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে তিনি কর্তব্য পালন করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু হলো শান্তিচুক্তির কয়েক দিনের মধ্যেই। ইসরাইলী সেনার গুলী কিংবা ড্রোন হামলায় নয়, সাংবাদিক সালেহ নিহত হয়েছেন ফিলিস্তিনী বন্দুকধারীদের হাতে। এ হত্যাকা-ে উপলব্ধি করা যায়, যুদ্ধ এখন চলছে ভিন্নরূপে। ইসরাইল এখন ফিলিস্তিনীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে। ইসরাইলী সৈন্যদের উপস্থিতি ছাড়াই এখন যুদ্ধ চলবে এবং রক্ত ঝরবে ফিলিস্তিনীদেরই। এতে রক্ষিত হবে ইসরাইলের স্বার্থই। ইসরাইল এখন পুরনো ঔপনিবেশিক কৌশলটাই গ্রহণ করেছে-‘ভাগ কর এবং শাসন কর’। ফিলিস্তিনীদের যদি অভ্যন্তরীণ সহিংসতায় জড়ানো যায়, তাহলে দখলদার ইহুদি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়বে কারা? ইসরাইলী অর্থে এবং পরিকল্পনায় যদি বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটানো যায় তাহলে ফিলিস্তিনীদের ঐক্যই শুধু বিনষ্ট হবে না, আন্তর্জাতিক চাপ থেকেও অনেকটা রক্ষা পাবে ইসরাইল। এমন কৌশলে ইসরাইলী সেনাবাহিনীর ওপর বোঝা কমবে, অস্ত্র ও অর্থের সাশ্রয়ও ঘটবে। অথচ গাজায় রক্তপাত ঘটতে থাকবে যুদ্ধের ভিন্নকৌশলে।
গাজায় বর্তমানে যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী বা গ্যাং ভীতি ছড়াচ্ছে, তারা জন্মভূমির প্রতিরোধ যোদ্ধা নয়। ওরা ইসরাইলের বরকন্দাজ বা প্রক্সিযোদ্ধা। অর্থ ও স্বার্থের বিনিময়ে ওরা বিক্রি হয়ে গেছে। কিছুতো আগেই বিক্রি হয়েছে, এখন সংখ্যায় বাড়ছে এবং তা বাড়ছে ইসরাইলের পরিকল্পনাতেই। হামাস এবং ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের জানার বাইরে নয় বিষয়টি। হামাসতো ওদের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। প্রক্সিযোদ্ধাদের শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করছে বীর ফিলিস্তিনী জনগণ। আশা করি, আন্তর্জাতিক বিশ^ও উপলব্ধি করবে, নেতানিয়াহু আসলে কোনো শান্তি চুক্তি করেনি, বন্ধ করেনি যুদ্ধও, শুধু পরিবর্তন করেছে যুদ্ধের কৌশল। প্রক্সিযুদ্ধের মাধ্যমে ইসরাইল শুধু ফিলিস্তিনীদের বিভক্ত করতেই চাইছে না, মনোবল ভেঙে পরিণত করতে চাইছে এক পরাধীন জাতিতে। ইসরাইলের জঘন্য এ নতুন পরিকল্পনায়ও কি শামিল হবে যুক্তরাষ্ট্র? বিশে^র নাগরিক এবং রাষ্ট্রসমূহের সামনে আজ বড় প্রশ্ন-এবারও কি তাঁরা ন্যায় ও নীতি বিসর্জন দিয়ে ইসরাইলের কাছে মাথা নত করে থাকবেন?