পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হলো পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ নাম ধারণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার। কথা ছিল আলাদা হয়ে ন্যায়-সাম্য প্রতিষ্ঠা করা হবে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভূখণ্ডে। কিন্তু আমরা কী দেখলাম এতো দিনে? এ ৫৪ বছরে অনেক ব্যক্তি পরিবার এবং সামরিক বেসামরিক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন দেখেছি। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এসে কতটুকু ন্যায় আর সাম্য প্রতিষ্ঠা হলো এ ভূখণ্ডে! না। বড় বড় কথা বলে ন্যায় নীতির কথা বলে ক্ষমতায় গিয়ে জাতির সাথে কেবল প্রতারণাই করেছে। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে গিয়ে নিজেরাই দুর্নীতির তিমির অন্ধকারে নিজেদের ঠেলে দিয়েছে। জাতি হিসেবে ন্যায় এবং সাম্যের ধারে কাছেও যেতে পারিনি আমরা। পুরো বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করার পরিবর্তে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে জাতির মাথা হেট করে দিয়েছে। বরং স্বার্থবাজ শাসকগোষ্ঠী নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার ধান্ধায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজের স্বার্থে, আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করে গদি রক্ষার ব্যবস্থা করেছে বার বার।
নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে হীন চক্রান্ত করার রেওয়াজ দেখেছে মানুষ বার বার। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে সুশাসনের আশ্বাসে নানা বাহানায় স্বৈরতন্ত্র কায়েম, পারিবারিক শাসন আর ফ্যাসিজমের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা।
জনগণকে মুলা দেখিয়ে জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে সিন্ডিকেট করে নিজেরাই ফুলে ফেঁপে উঠেছে শাসকদের আত্মীয়-স্বজন আর দোসররা। আজ আমরা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। এরপরও কি বাহানা পিছু ছাড়ছে? না। পিছু ছাড়েনি। কোন কোন ক্ষেত্রে এ বিতর্ক আরও জোরালো হচ্ছে, উসকে দেয়া হচ্ছে। তাদের কথায় অবশ্য স্বার্থের পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সুযোগ পেয়েই এটা চাই, সেটা চাই না ওটা চাই। দ্রুত ইয়েটা চাই। যাতে লুটে খেতে পারি। আর তর সহ্য হচ্ছে না ভাই। কেন দেরি হচ্ছে? কেন দেরি করছেন।
এক সাগর রক্ত আর হাজার হাজার জীবনের বিনিময়ে স্বৈরাচারী হাসিনাকে পলায়নে বাধ্য করার পর যেখানে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কথা ছিল; সেখানে আজ আমার লিপ্ত হয়েছি স্বাধীনতা আর দ্বিতীয় স্বাধীনতার তর্কে। মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে একজন রাজনৈতিক নেতাকে বলতে শোনা গেল দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে নাকি কিছু নাই। জি¦-হ্যাঁ। এখনতো কতো কি-ই বলা যায়। দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে কিছু নাই। দ্বিতীয় স্বাধীনতা দরকার নাই। এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা দরকার ছিল ৫ আগস্ট ২০২৪ সালের আগে। জাতি যখন স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস ফেলতে পারতো না। ঘরে ঘুমাতে পারতো না। রাস্তাঘাটে বারুদের গন্ধ পাওয়া যেত। গুম খুুনের শিকার মানুষের স্বজনদের আহাজারিতে আশপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে হয়ে যেতো। নির্দোষ মানুষেরা নিষিদ্ধ জঙ্গির তকমা নিয়ে মাসের পর মাস বছরের পর বছর জেলের বাসিন্দা হয়ে থাকতো।
অবশ্য কারো কারো কাছে তা ছিল না। তখন নানা কথা শোনা যেত নানা ব্যক্তিদের ব্যাপাারে। নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য কতজন যে কত কি করেছেন তাও শোনা যেত নানান মারফতে। এই আপনাদের মুখেরই শোনা যেতো দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর চেয়ে বেশি অত্যাচার চলছে। তখনো এতো মানুষের প্রাণ যায়নি। এভাবে রাস্তাঘাটে লাশ পড়ে থাকেনি। ক্রসফায়ারের শিকার হয়নি। নিখোঁজ হয়ে যায়নি।
১৯৭১ সালের আগে স্বাধীনতা প্রাপ্তির জন্য যে যুক্তিগুলো দেয়া হতো তা হলো- পশ্চিম পাকিস্তানিদের দমননীতি, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ইত্যাদি। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে যে দাবিগুলো জোরালো হলো তাতে কী ছিল? মোটা দাগে বলতে গেলে ন্যায়বিচার। বাংলার তরুণেরা বলতো ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। আমরা ন্যায়বিচার চাই। কোটা পদ্ধতির বিলোপ চাই। এরপর আরও যে বিষয়গুলো আসে তা হলো- দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, স্বজনপ্রীতিমুক্ত নিয়োগ আর জবাবদিহিমূলক রাজনীতি। এই দাবির কারণে ছাত্রদের ওপর চালানো হলো নজিরবিহীন নিপীড়ন। অবশেষে গণহত্যা। সেই গণহত্যার পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিদায় হলো স্বৈরাচার। এসবের পরও যখন কেউ কেউ দ্বিতীয় স্বাধীনতা নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলে, তখন স্বাভাবিক কারণেই তাদের মতলব নিয়ে নানা প্রশ্ন সামনে আসে।
শুধু তাই না। ছাত্রদের পক্ষ থেকে যখন সংস্কারের কথা বলা হয় তখন তাদের সহ্য হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের কথা বলা হলে চমকে ওঠেন তারা। এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিবের সামনে গিয়েও কথা বলতে ভাল লাগে না। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনের কথা বলা হলে চেহারা আর সঠিক জায়গাতে থাকে না। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যখন এই শিক্ষার্থীরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল তখন তারা কোথায় ছিলেন তা কিন্তু জাতি জানে। এই দেশের জনগণ যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল তখনো আপনাদের কী ভূমিকা ছিল তাও কিন্তু জাতির সামনে পরিষ্কার। অভ্যুত্থানের পর আপনারা মিডিয়ার সামনে কী বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাও কিন্তু রেকর্ডে অবস্থায় রয়েই গেছে। এগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সামনে চলে আসছে।
আজকের ছাত্ররা হয়তো ৭১ এর স্বাধীনতা দেখেনি। সেদিন বাংলার মাটি রঞ্জিত হয়েছিল লাখো মুক্তিকামীর রক্তে। পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। নারীরা হয় নির্যাতনের শিকার। লাখ লাখ পরিবার দেশ ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়। নিঃসন্দেহে সেই স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা যাবে না। বিদেশী পাকিস্তানিরা সেদিন যেভাবে অত্যাচার করে হত্যা-নির্যাতন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। একই কায়দায় ২০২৪ সালে স্বৈরশাসক হাসিনা রাজপথে রক্তের স্রোত বইয়ে দিয়ে নিজের ক্ষমতা সারাজীবনের জন্য পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতা সেই ইচ্ছা পূরণ হতে দেয়নি। পুরো জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বের করে এনে শান্তির পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে আমাদের। তারা সেটাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে চায়। দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন সিন্ডিকেটমুক্ত ব্যবসা দিয়ে দেশের মানুষকে শান্তিতে রাখতে চায়। ৭১ এর পর যে স্বাধীনতাটুকু পায়নি এ দেশের জনগণ সেই স্বাধীনতার স্বাদ ফিরিয়ে দিতে চায়। উই ওয়ান্ট জাস্টিসের প্রতিফলন ঘটাতে চায়। তারা যদি জুলাই আগস্টের মুক্তিকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলতে চায় তাহলে দোষ কী তাতে?
লেখক : সাংবাদিক