হরিনাথ মজুমদার নামের সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। তবে তিনি কে ছিলেন? কী তার পরিচয়? চলুন জেনে নেওয়া যাক।

হরিনাথ মজুমদার ইং ১৮৩৩ সালের ২০-শে জুলাই (বাংলা -৫ শ্রাবণ ১২৪০) বৃহস্পতিবার কুমারখালীর কুন্ডু পাড়ায় তার নিজ বাড়ির চণ্ডী মণ্ডবের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন হলধর মজুমদার। মাতা ছিলেন কমলিনী মজুমদার। কিন্তু কপাল গুনে তিনি শিশু কালেই তার মাতা ও পিতা হারা হন। আনুমানিক ৬ মাস বয়সে তার মা মারা যায় ও তার পিতা ৫ বছর বয়সে মারা যান। শিশু কালেই মাতা ও পিতাকে হারিয়ে হরিনাথ মজুমদার নিজের নামের আগে কাঙ্গাল যোগ করেন। সেখান থেকে তার নাম হয় কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। হ্যাঁ, তিনিই আজকের এই কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার।

কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারে মাতাপিতা মারা গেলে তার কোন ভাই বোন না থাকাই তার জ্যাঠারা (তার বাবা বড় দুই দাদা) তাকে তার নিজ বাড়ির সামনে একটি কুয়াতে ফেলে দেয় এবং নিজ সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। তাকে কুয়াতে ফেলে দেওয়া আগেই কুয়াতে একটা কাঠ পড়ে ছিল । যার ফলে তাকে কুয়াতে ফেলে দিলে সে না ডুবে কাঠের ওপর ভেসে ছিল । এমন সময় পাশের বাড়ির এক বিধবা মহিলা কুয়াতে জল নিতে এসে দেখে কুয়ার মধ্যে একটি বাচ্চা পড়ে আছে। তখন সে বাচ্চাটিকে কুয়া থেকে উঠিয়ে দেখে সে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। তখন থেকেই কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার কে তিনিই লালন পালন করতে থাকেন। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার তাকে দুধ মা বলে ডাকতেন। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ০৮ সন্তান (সতীশ, বানীশ, সুরেন্দ্র, বিজয়, বসন্ত, আনন্দময়ী, চপলা ও যাগমায়া) এর জনক ছিলেন। তিনি কর্ম জীবনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পত্রিকায় প্রকাশনা, গ্রন্থ রচনা, সাংবাদিকতা, সাহিত্য চক্র, পৌরনিক কাহিনী, ছাপাখানা ও সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি ছিলেন একজন নির্ভিক ব্যক্তি। তার গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকা থেকে জানা যায়, কোন এক বিধবা বুড়ি ইংরেজ কে কর দিতে না পড়ার মিঃ হামফ্রে নামে এক ইংরেজ ঐ বুড়ির গরু রাতের আঁধারে চুরি করে নিয়ে যায়।

কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার তার নিজ পত্রিকা গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় মিঃ হামফ্রে নামে এক ইংরেজকে গরু চোর বলে আখ্যায়িত করেন। এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর মিঃ হামফ্রে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারকে চিঠি করে বলেন এডিটর! আমি তোমাকে ভয় করি না বটে, কিন্তু তোমার নির্ভীক লেখনির জন্য আমি অনেক কুকর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। আরো জানা যায় বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারকে এক চিঠিতে অনুরোধ করেছেন তিনি যত দিন মারা না যান তত দিন তার বাবার কোন অত্যাচারের কাহিনী পত্রিকায় না ছাপাতে।

কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার অনেক নীতি কথা লিখেছেন তার মধ্যে অন্যতম, নির্ভিক সাংবাদিকতার কোন বন্ধু নেই, দেশ নষ্ট কপটে-প্রজা মরে চপটে-কি করিবে রিপোর্টে, ওহে দিনত গেল সন্ধ্যা হল পার করো আমারে, যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন। মাত্র ৬৩ বছর জীবনকালে ৭২খানা গ্রন্থ, সমাজ সংস্কারে ১১টি দল, ডাকঘরে মানিঅর্ডার প্রথা প্রবর্তন নিজ সম্পাদিত গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকায় প্রকাশ, হাজার খানিক গান রচনা, ৮টি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। ১৭ই এপ্রিল ১৮৫৪ সালে নারীদের শিক্ষার জন্য গঠন করেন কুমারখালী বাংলা পাঠশালা, সে পাঠশালাটির শ্রী বৃদ্ধি হয়ে কুমারখালী সরকারি বালিকা বিদ্যালয় নামে আজো নারী শিক্ষা বিস্তার করছে। প্রেসের মুদ্রণ যন্ত্রটি ১৮৫৭সালে লন্ডনের ১০ নম্বর ফিনসবেরি স্ট্রিটের CLYMER DIXON & CO - তে নির্মিত হয়েছিল।

শোনা যায় এ মুদ্রণ যন্ত্রটি কলকাতার এক জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে স্থাপন করে ব্রিটিশ বিরোধী “প্রচার পুস্তিকা” ছাপা হতো। ব্রিটিশ সরকার পুলিশ তৎপরতায় সেটি উদ্ধার করে নিলামে বিক্রি করে। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার বাংলা ১২৮০ সনে, ইং ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ নিলাম হইতে ৬০০ টাকা দিয়ে একটি মুদ্রায়ন যন্ত্র ক্রয় করেন। মুদ্রায়ন যন্ত্রটির নাম কি রাখিবে এ নিয়ে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। এমন সময় তার মনে পড়ে মৃত নিঃসন্তান বাল্য বন্ধু মথুরানাথ মজুমদার এর কথা। তখন তার নাম অনুসারে যন্ত্রটির নাম রাখা হয় মথুরানাথ যন্ত্র। এ মুদ্রায়ন যন্ত্রটি কে সংক্ষেপে বলা হয় এম এন প্রেস। এ এম এন প্রেস থেকে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারে নিজ সম্পাদিত পত্রিকা গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকাসহ আরো অনেক পত্রিকা প্রকাশ করা হতো। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার লালন শাহ এর প্রথম ২১টি গান বন থেকে এনে খবরের কাগজে প্রকাশ করেন। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ও লালন শাহ বন্ধু ছিলেন। কাঙ্গাল হরিনাথ কে মারার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লাঠিয়াল বাহিনী পাঠালে লালন শাহ তার লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে এসে কাঙ্গাল হরিনাথ কে বাঁচান।

সংসার জীবনের মায়া ত্যাগ করে সাধন জীবন বেছে নিয়ে সাধক হয়েছিলেন। তিনি বর্তমান বটিকামারার দুর্গা বাড়িতে কালী সাধনা করেন। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে তিনি সাধনায় সফল হন। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ইং ১৮ এপ্রিল ১৮৯৬, বাংলা১৩০৩সনের ৫ বৈশাখ (অক্ষয় তৃতীয়া তিথি) বৃহস্পতিবার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সাধন চিত ধামে চলে যান। তিনি আজো অমর হয়ে আছেন। তার নামে বিভিন্ন যায়গায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আছে। তার মধ্যে অন্যতম কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের শাখা জাদুঘর কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘর। এ জাদুঘরটি ২০১৭ সালে ৯ ডিসেম্বর জাদুঘর উদ্বোধন ও টিকিট চালু করা হলেও কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ব্যবহৃত মুদ্রণ যন্ত্রটির অভাবে অসম্পূর্ণ অবস্থায় ছিল। ২০২৩ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নব নির্মিত বোর্ড কক্ষে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ব্যবহৃত মুদ্রণ যন্ত্রটির কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরে হস্তান্তর করা হয়। ২০২৩ সালের ১৮ জুলাই কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ব্যবহৃত মুদ্রণ যন্ত্রটির তার বসত ভিটা থেকে কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ২০ শে জুলাই এ মুদ্রণ যন্ত্রটি উদ্বোধন করা হয়। এ মুদ্রণ যন্ত্রটি উদ্বোধন করেন কুষ্টিয়া -৪(কুমারখালী - খোকশা ) আসেন সাবেক এমপি ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ। এই উদ্বোধনের মাধ্যমে কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর পূর্ণতা লাভ করে।

-অলিক মজুমদার দীপ্ত

কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ৬ষ্ঠ বংশধর।

কুমারখালী, কুষ্টিয়া।