DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

পাঠকের অভিমত

মত অভিমত

অধ্যাপক আবু জাফর : এক কালজয়ী প্রতিভা

নজরুল-ফররুখের পরে জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত বহুমানবের তরে একজনকেই খুঁজে বেড়াবে। তিনি হলেন অসাধারণ প্রতিভাধর কলম সৈনিক, অসাম্পদ্রায়িক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তবুদ্ধিচর্চক সংগীতগুরু আবু জাফর। যিনি ছিলে স্বকীয় কৃষ্টি কালচার ও

Printed Edition
Default Image - DS

মাহমুদ ইউসুফ

নজরুল-ফররুখের পরে জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত বহুমানবের তরে একজনকেই খুঁজে বেড়াবে। তিনি হলেন অসাধারণ প্রতিভাধর কলম সৈনিক, অসাম্পদ্রায়িক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তবুদ্ধিচর্চক সংগীতগুরু আবু জাফর। যিনি ছিলে স্বকীয় কৃষ্টি কালচার ও সংগীতশিল্পের যুগপ্রতিনিধি। দেশ ছিলো আগে, না তিনি ছিলেন দেশের আগে এ বিশেষণও তাঁর ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য ছিলো একসময়। কিন্তু আমরা নির্মম পরিহাসই বলব, তিনি কেন সংস্কৃতিচর্চার গণ্ডি ছেড়ে বেড়িয়ে আসলেন- এ বিষয়ে গবেষণার দাবি রাখে।

পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পাওয়া যায়? এটা শুধু শৈশবের স্মৃতিকাব্য নয়। এ স্মৃতিসংগীতে বহমান জীবন নদের নানামাত্রিক বিশ্লেষণ এবং সমাজ ও সভ্যতার উত্থান, পতন, স্থিতি, বিলুপ্তি। মানব দর্শন ও রাষ্ট্রীয় গতিপ্রকৃতির রসায়নের এ উপলব্ধি আবু জাফরের মুখেই ঘুরে ফিরে প্রচারিত হয়। তাইতো শতাব্দীতে আবু জাফরের আবির্ভাব একজনই হয়। নন্দিত সংগীতশিল্পী মর্ত্যরে জগত ছেড়ে রুহের জগতে প্রস্থান করেছেন। কিন্তু কীর্তিরাজি অমর ও জীবন্ত। তাঁর সুকীর্তি সুসভ্য করবে সমাজকে। আলোকিত করবে জাতিরাষ্ট্রকে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে অমরত্ব অর্থহীন বয়ান, তবে সৃষ্টি তো অমরত্ব লাভ করতে পারে। আবু জাফরের সৃষ্টিও তাই।

শিক্ষাবিদ, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, কবি ও গীতিকার। বিটিভি ও বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। দেশাত্ববোধক ও আধুনিক গান ঝড় তোলে সংগীত ভূবনে। আবু জাফর আর ফরিদা পারভীন তথা স্বামী-স্ত্রী জুটির গীতি ও কণ্ঠ মিলে সৃষ্টি হয়েছিল ভিন্ন আমেজের সংগীতভূবন। এই পদ্মা, এই মেঘনা বাংলাগীত তাঁকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়। লোক সংস্কৃতি গবেষক ও বাংলা একাডেমির উপপরিচালক সাইমন জাকারিয়া জানান, “তিনি বাংলা গানের ইতিহাসে অভিনব বাণী ও সুর সংযোজন করেছেন। তার অবদানের তুলনায় তাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে খুবই কম।” তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম, নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে, আমি হেলেন কিংবা মমতাজকে দেখিনি, তুমি রাত আমি রাতজাগা পাখি আজও মানুষের মুখে মুখে ফিরে। এ ধরনের বহু কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি। নিজের রচিত ও সুর করা অধিকাংশ গানে তিনি নিজেই কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যুগল গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সংগীতশিল্পী ও তার সাবেক স্ত্রী ফরিদা পারভীন। ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদীতটে’ গানটি বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি গানের মধ্যে স্থান পেয়েছিল। লেখক হিসেবেও তিনি সুবিখ্যাত। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে বাজারে দুর্নাম তবু তুমিই সর্বস্ব (কাব্য), বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত কবিতা (অনুবাদ কাব্য) প্রভৃতি।

বাঙালি কৃষ্টির কিংবদন্তি কীর্তিমান কবিপুরুষ অধ্যাপক আবু জাফর। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, সংস্কৃতি অঙ্গনের মুকুটহীন সম্রাট। তার সঙ্গীতশৈলীতে রয়েছে দেশ, প্রেম, দ্রোহ, লোকজ ঐতিহ্য। উপমা ও রূপক ব্যবহারে তিনি অনন্যতার দাবিদার। জীবনের পড়ন্ত বেলায় শিল্প ও সংগীতের প্রতি আগ্রহ হারান। এ সময়ে রচিত ইসলাম ও আত্মঘাতী মুসলমান, ইসলামের শত্রুমিত্র, অসহিষ্ণু মৌলবাদীর অপ্রিয় কথা, মহানবির মহাজীবন বাকবদলের কীর্তি। এগুলোতে তাঁর জীবন দর্শন উপভোগ্য। এমন বিশ্বাস ও মতবাদের ওপরই শিল্পীর জীবনলীলা সাঙ্গ হয়।

পাশ্চাত্যে ক্যাট স্টিভেনস আর বাংলাদেশে আবু জাফর। পাশ্চাত্য মিডিয়া ক্যাট স্টিভেনসকে নানাভাবে বিতর্কিত করার কোশেশ করেছে, জনতার মঞ্চ থেকে বিক্ষিপ্ত করার চিন্তা করেছে। আবু জাফরের ক্ষেত্রেও একই চেষ্টার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। বাংলাদেশের গনমাধ্যম তাঁকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে বারবার, পুনর্বার। এক্ষেত্রে তাদের সফলতাও ঈর্ষণীয়। মৃত্যুর আগের দুই দশক প্রচারমাধ্যম তাঁকে জনসম্মুখে উপস্থাপনের প্রয়োজন বোধ করেনি। মৃত্যুতে নামমাত্র খবর পরিবেশন করেই ইতি টেনেছে। তাঁর সাহিত্য ও সংগীত চর্চার মূল্যায়ন পত্রিকাগুলো পাঠক নজরে আনেনি।

ক্যাট স্টিভেনস ও আবু জাফর উভয়ের জীবনের আদর্শিক বিবর্তন লক্ষ্যণীয়। আঁধার থেকে আলোতে ফেরা। অন্ধকার গলি হাতড়িয়ে অহির প্রলয়ে প্রত্যাবর্তন। জন্মও বিংশ শতাব্দীর একই দশকে। বয়সের ফারাক মাত্র পাঁচ বছর। আবু জাফরের জন্ম ১৯৪৩ সালে আর ক্যাট স্টিভেনসের জন্ম ১৯৪৮ সালে। তবে আদর্শিক রূপান্তরের সময় পার্থক্য কম নয়। ক্যাট স্টিভেনসের আদর্শিক পরিবর্তন ঘটে সত্তর দশকে আর আবু জাফরের জীবনে নতুন দর্শনের উপস্থিতি দেখি নব্বই দশকে। একবিংশ শতাব্দীর স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিরোধী আইকনিক প্রতিবাদী সংস্কৃতিজন আবু জাফর। রবিন্দ্রদর্শন ও লালনদর্শনের ভ্রান্তনীতির মুখোশ উন্মোচনের বিজ্ঞ কৌশলী। মানবতা ও মানবিকতাপূর্ণ সমাজ-রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যায়ে বিযুক্ত তার কলম ও কণ্ঠ। শেকড়ের সন্ধানে ব্যপৃত ছিলেন সারাজীবন। কলম ও কণ্ঠে শুধুই দেশমাতৃকা ও জনতার জয়গান। রাষ্ট্র ও সরকারগুলো তাঁর কৃতিত্বের মূল্যায়ন করতে চরমভাবে ব্যর্থ। বহুমুখি অবদানের স্বীকৃতি দেয়নি জাতি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কর্মের মূল্যায়ন করার যোগ্যতাই আমাদের নেই। আমাদের চিন্তাজগতের এ কৃষ্ণপক্ষের অবসান হোক। আর ফুলে ফলে সুরভিত হোক আবু জাফরের মতো ভিত রচয়িতাগণ।

একদা তারকাখ্যাতি ও তুখোড় জনপ্রিয়তা তাঁকে পৌঁছে দেয় সাফল্যের স্বর্নশিখরে। আজও তিনি সংগীতপ্রেমিকদের প্রিয় মুখ। সম্পাদক, কলামিস্ট, গ্রন্থকার। সমাজসেবক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবেও খ্যাতিমান। জাতির অহঙ্কার, বাংলাদেশের গৌরব, আলোর ফেরিওয়ালা। মোমবাতির মতো শুধুই আলোকরশ্মি উদগীরণ করেছেন, চলে গিয়েছেন নিঃস্ব অবস্থায়, নিরবে, নিভৃতে। আবু জাফর জন্মগ্রহণ করেন কুষ্টিয়া জেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের গড়েরবাড়ি কাঞ্চনপুর গ্রামে ১৫ মে ১৯৪৩। গত ৬ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখ ঢাকাস্থ ল্যাবএইড হাসপাতালে মায়াময় জগৎ থেকে প্রস্থান করেন। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজমাঠে জানাযা শেষে পৌর গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। আবু জাফরের মতো জাতীয় বুদ্ধিজীবীর মরণোত্তর ঠিকানা মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কেন হলো না- এ প্রশ্ন রয়েই গেল।

লেখক : প্রাবন্ধিক।