॥ নাজমিন আক্তার ইতি ॥

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন-এ শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে আত্মবিশ্বাসী তরুণদের ছবি, নতুন স্বপ্ন, জ্ঞানের উন্মুক্ত পথ, ক্যারিয়ারের প্রস্তুতি আর স্বাধীনতার এক নতুন অধ্যায়। এ সময়ে শিক্ষার্থীরা চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ক্যাম্পাসে পা রাখে, জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় সে স্বপ্নকে চূর্ণ করে দেয়। বর্তমান সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অনেক শিক্ষার্থীর কাছে হয়ে উঠছে হতাশা, অনিদ্রার রাত, অস্থির মন, আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকা এক অদৃশ্য লড়াই। ‎হতাশা শব্দটি যখন শিক্ষার্থীদের সাথে যুক্ত হয় তখন সাধারণ ভাবনায় পড়াশোনা ও পরীক্ষার চাপকেই দায়ী মনে হয়। আসলেই কি শুধু পরীক্ষা ও পড়াশোনার চাপ শিক্ষার্থীদের হতাশার কারণ? বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে।

বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষার চাপ নয় বরং পারিবারিক প্রত্যাশা, নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সম্পর্কের জটিলতা, চাকরি নিয়ে ভয়-এ সবকিছু মিলিয়ে এক অদৃশ্য মানসিক চাপের ভেতরে বেঁচে থাকে। মুখে না বললেও ভেতরে একটা চাপা আর্তনাদ কাজ করে- “আমি পারবো তো? আমি যদি ব্যর্থ হই? আমার পড়াশোনার পর মূল্য কী? আমার পরিচয় কী?”

এসব চাপ থেকে জন্ম নেয় দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ (anxiety), হঠাৎ মন খারাপ, অকারণ কান্না, আত্মবিশ্বাসের অভাব, এবং অনেকের ক্ষেত্রে তা আত্মহত্যা পর্যন্ত গড়ায়। ‎প্রথম আলো-র ৭ জুন ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত একটি জরিপে (আঁচল ফাউন্ডেশন) দেখা গেছে- ‎৫৫% বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎ পেশাজীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। প্রায় ৮০% শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হতাশার বিভিন্ন উপসর্গ যেমন- ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া, ঘুমের ভাঙন, আত্মহত্যার চিন্তা ইত্যাদি ভোগ করেন। প্রায় ৩৯% শিক্ষার্থীর মনে আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে, ৬% চেষ্টা করেছেন, আর ৭% প্রয়োজনীয় উপকরণও জোগাড় করেছেন ।

এ সমস্যাকে আর উপেক্ষা নয়, সময় এসেছে শিক্ষার্থীদের কথা শোনার, পাশে দাঁড়ানোর এবং তাদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার। কারণ তারা শুধু ছাত্র নয়, তারাই আগামীর সমাজ নির্মাতা। ‎এ সমস্যা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো- সমাজ, পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একযোগে সচেতন হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে এবং তাদের ভবিষ্যৎ গঠনে সফল করতে নি¤œলিখিত বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন:

হল সমূহের উন্নয়ন : সকল যোগ্য শিক্ষার্থীর জন্য হলের সীট নিশ্চিত করতে হবে। হলগুলোকে পরিচ্ছন্ন, সুরক্ষিত ও মানসম্মত পরিবেশে রূপান্তর করতে হবে। এছাড়া, স্বল্পমূল্যে পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকে।

অর্থনৈতিক সহায়তার সুযোগ বৃদ্ধি : শিক্ষার্থীদের আর্থিক চাপ কমাতে বৃত্তি, স্টাডি লোন ও পার্টটাইম জবের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। পার্টটাইম কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজের খরচ চালাতে পারবে এবং কাজে দক্ষতাও অর্জন করবে।

ক্যারিয়ার গাইডলাইন ও মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করা : শিক্ষার্থীদের জন্য সফল পেশাজীবী ও বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে নিয়মিত ক্যারিয়ার পরামর্শ ও মেন্টরশিপ ব্যবস্থা করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের লক্ষ্য নির্ধারণে সক্ষম হবে এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে আগামীর পথে এগোতে পারবে।

কাউন্সেলিং ও মানসিক স্বাস্থ্য সেবা : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পেশাদার মনোবিজ্ঞানী ও কাউন্সেলর নিয়োগ দিয়ে নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য সেবা এবং সচেতনতামূলক কর্মশালা চালু করতে হবে। শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপ নিয়ে সহজে কথা বলতে পারবে এমন ব্যবস্থা প্রয়োজন।

নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা : শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বুলিং, হয়রানি ও নিপীড়ন রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্যাম্পাস ও হলগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।

শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি : আধুনিক ও প্রাসঙ্গিক পাঠক্রম প্রণয়ন এবং চাপমুক্ত পরীক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

পরিবারের ভূমিকা : শুধু সাফল্যের প্রত্যাশা নয়, সন্তানের অনুভূতি বুঝে পাশে দাঁড়ানোই পরিবারের আসল দায়িত্ব। একটুখানি সহানুভূতি অনেক বড় আশ্রয় হয়ে দাঁড়াতে পারে তাদের মানসিক সংকটে।

শিক্ষার্থীদের করণীয় : নিজেদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য সচেতন হওয়া জরুরি। সময়মতো ঘুম, খাওয়া-দাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেন এগুলো মানসিক অবসাদের কারণ না হয়। ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলা মানসিক স্থিতিশীলতা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। একইসাথে উদ্বেগ কমাতে কার্যকর। আত্মবিশ্বাস বাড়াতে বই পড়া, সৃজনশীল কাজ করা এবং নিজের দক্ষতা উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে।

পরিশেষে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থী একেকটি স্বপ্ন, একেকটি সম্ভাবনা। হতাশা বা দুশ্চিন্তা যেন এই স্বপ্নগুলোকে ভেঙে না ফেলে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে পরিবারকে, দায়িত্ব নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়কে, মানবিক হতে হবে সমাজকে। তবেই সুস্থ মন আর সুন্দর পরিবেশে গড়ে উঠবে আগামী দিনের আত্মবিশ্বাসী নেতৃত্ব।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়।