মো: আকতার হোসাইন
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কবিতার দুটি লাইন খুব মনে পড়ছে, “এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান: জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে...প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল”। জঞ্জালে ভরা এ দেশটা জঞ্জাল থেকে মুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সড়ক মানিক মিয়া এভিনিউতে দিনের আলোয় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করলো তরুণ ছাত্র- জনতার নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি’। তারুণ্যে ঠাসা নবগঠিত অনভিজ্ঞ দলটি মানুষের কাছে সম্পূর্ণরূপে নতুন। অনেকে মনে কষ্ট পেলেও ইতিমধ্যে অনেকে আবার নতুন দলকে পছন্দ করতে শুরু করেছে, বিশেষ করে দেশের বর্তমান তরুণ ভোটার ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। ভিন্নমতের অনেকে আবার প্রকাশ্যে বিরোধীতাও শুরু করেছে। পক্ষে-বিপক্ষে মতামত থাকবে, এটা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। নতুন যে দলটি হলো তাদের আদর্শ হিসাবে পুরনো ধাঁচের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য থেকে বেরিয়ে আসার প্রত্যয় নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। পুরনো ধাঁচের রাজনীতি বলতে, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, স্ট্যান্ড দখল এবং জনগণের অর্থ আত্মসাৎ এমনটা। যা একশ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলোর ছিল পরোক্ষ আদর্শ।
নতুন দলকে অবশ্যই জনগণের ভাষা বুঝতে হবে। সাধারণ জনগণও অনেকটাই এখন সচেতন। তারা তাদের অধিকার আদায় করতে শিখে গেছে। কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থাকা অবস্থায় প্রধান বিরোধীদল বিএনপি অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও জনসম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল তা হয়তো অনেকেই দেখেছে। বিশেষত ২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচন সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের সময় বিএনপির শক্ত কোন আন্দোলন-সংগ্রাম ও বিরোধিতা দৃশ্যত দেখতে পাওয়া যায়নি। এর পিছনে অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা-সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চিন্তা ধারা ও অত্যাচার নিপীড়ন অন্যতম। কারণ তাদের যে দমন পীড়ন নীতি ছিল সেখানে কেউ টিকতে পারতো না, তারা ছিল হিংস্র হায়েনার মত। আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন নীতির কাছে সবাই পরাস্ত ছিল। এর ফলেই আওয়ামী লীগ গত ১৬ বছরে দেশে এক ফ্যাসিস্ট সরকারে পরিণত হয়েছিল। সরকারি চাকরিতে কোটা বহাল রাখার প্রেক্ষিতে যখন জুলাই অভ্যুত্থান শুরু হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে তখন প্রথমে ছাত্রসমাজ, পরে শিক্ষক, সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদেরা এবং সবশেষে সাধারণ জনগণ অংশগ্রহণ করে। জুলাই অভ্যুত্থান ছিল মূলত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার যখন ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে গণহত্যার মতো ঘৃণিত কাজ শুরু করে, ফলশ্রুতিতে আন্দোলনটি জোরালো হয় এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, গার্মেন্টস শ্রমিক মজুর এবং সাধারণ জনতা। কোটা আন্দোলন পরবর্তীতে রূপ নেয় আওয়ামী ফ্যাসিস্ট বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন নামে। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের ফলে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার জনসম্পৃক্ততা হারিয়ে দেউলিয়াত্তবরণ করে নেয় এবং সরকার প্রধান তার দলের নেতা কর্মীদের কোনো নির্দেশনা না দিয়েই পালাতে বাধ্য হয়, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শহীদদের তালিকা থেকে উইকিপিডিয়ার একটি তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত ১৬ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত মোট ৬২৪ জন শহীদ হন, যার মধ্যে ৭৩ জন শিশু রয়েছে, রাজনৈতিক পরিচয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ২০৪ জন, বাকি শহীদগুলো হলো ছাত্র ও সাধারণ জনতা। দেশে এখন শিক্ষিতের হার অনেক বেশি, তাই সচেতন নাগরিকের সংখ্যাও অনেক বেশি। রাজনীতিবিদদের মিথ্যা আস্ফালন সাধারণ জনগণ আর গ্রহণ করবে না। ফলে নতুন রাজনৈতিক দলের কাছে সকলের প্রত্যাশা হলো, তারা যেন সবকিছুতেই পূর্বের রাজনীতিবিদদের মতো রাজনীতির ভাষায় কথা না বলে।
পূর্বে রাজনীতিবিদেরা যেভাবে কথা বলতেন তার সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ আকবর আলী খান তুলে ধরেন তার আজব ও জবর-আজব গ্রন্থে। তিনি লেখেন, রাজনীতিবিদের প্রতিশ্রুতিমূলক বক্তৃতা যেমন হয় : “মানে আপনারা এ দিক থেকে এমন করতে থাকুন। আর আমরা ওই দিক থেকে ওই করতে থাকি। আপনারা যদি এটুকু করেন, তাহলে আপনাদের কাছ থেকে আমাদের এতে সত্যিকারে সাহায্য হবে। মানে, বাংলাদেশের যে অবস্থা, বুঝতে পেরেছেন। এখন যদি আমরা এটা না করি তাহলে -মানে, এদের ব্যাপারটি তো বুঝতে পারছেন? এরা দিবে না। কিন্তু দেবে না বলেই তো আমরা এ করতে পারিনা। আমাদের কেড়ে নিতে হবে”। এখানে বাক্য অনেক আছে, কিন্তু অর্থ কিছুই নেই। অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়ে বহু লোককে খুশি করা সহজ। উপরন্তু অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতই সম্ভব কিনা, সে সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠে না। পূর্বে প্রশ্ন না উঠলেও বর্তমানে কিন্তু জনগণ বেশ সচেতন, শুধুমাত্র না বুঝার ভান ধরে থাকে।
পলিটিকস গ্রন্থে অ্যারিস্টটল লিখেছেন: সরকার তখনই ভালো সরকার হয়, যখন তার লক্ষ্য হয় সমগ্র জনগোষ্ঠীর মঙ্গলসাধন। আর খারাপ সরকার হলো সে সরকার, যে শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবে। তিনি আরো বুঝাতে চেয়েছেন রাজনীতিতে ভালো মানুষের স্থান নেই। যদি তাই হয় তাহলে, ভালো মানুষকি রাজনীতি করতে পারে না? নাকি ভালো মানুষ রাজনীতি করলেও ভালো থাকতে পারে না? যেটাই হোক বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভালো মানুষের বড়ই অভাব! তারপরেও যদি দু-এক জন ভালো মানুষ থেকেও থাকে, আর তা যদি রাজনীতি করতে এসে দুষ্ট রাজনীতিবিদে পরিণত হয়, তাহলে মানুষ কার প্রতি আস্থা রাখবে। নতুন যে রাজনৈতিক দলটি গঠিত হলো তাদের অবশ্যই এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে। নতুবা টিকটকারদের মতই হবে। মানুষ শুধু মজাই নিবে, ভালবাসবে না। উপস্থিত বিনোদন নিয়ে দূরে ঠেলে দিবে। মানুষ তার মনিকোঠায় স্থান দেওয়ার পূর্বেই যদি ফেলে দেয় বা ঘৃণা করে, তাহলে তার ভবিষ্যৎ কী হবে? তাই নতুন দলটিকে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জনগণের ভাষা বুঝতে হবে, বুঝতে হবে মানুষ কী চায়, কেন চায়। আর সে লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। তবেই মানুষেরও দলটির প্রতি আস্থা ও ভালবাসা এবং বিশ্বাস স্থাপন তৈরি হবে। যদিও দলটির প্রধান অনেকটা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রধানের মতোই ধীরস্থির, মিষ্টি ভাষী এবং বিচক্ষণ, জনগণের দ্রুত আস্থা অর্জনকারী ব্যক্তি। তাই অনেকে হয়তো বিশ্বাস করে এই দলটিও দ্রুত মানুষের মন জয় করে তাদের মন-মনিকোঠায় স্থান পাবে।
লেখক : ব্যাংকার।