পাঠকের অভিমত
মত অভিমত
ফ্যাসিবাদের আমলনামা
খেলোয়াড়কে উপযোগী করার জন্য যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে দক্ষ হয়ে ওঠার জন্য। এরজন্য প্রশিক্ষকের প্রয়োজন পড়ে। যখন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ব্যতীত তাদের পৈত্রিক পরিবারে আর কেউ অবশিষ্ট রইল না ঠিক তখনই মোক্ষম সময়ে দু’বোনের উপযুক্ত প্রতিযোগীর মানদণ্ডে শেখ হাসিনাই উত্তীর্ণ হন।
Printed Edition
মোঃ শাহ আলম
খেলোয়াড়কে উপযোগী করার জন্য যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে দক্ষ হয়ে ওঠার জন্য। এরজন্য প্রশিক্ষকের প্রয়োজন পড়ে। যখন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ব্যতীত তাদের পৈত্রিক পরিবারে আর কেউ অবশিষ্ট রইল না ঠিক তখনই মোক্ষম সময়ে দু’বোনের উপযুক্ত প্রতিযোগীর মানদণ্ডে শেখ হাসিনাই উত্তীর্ণ হন। সুদীপ্ত প্রশিক্ষক হিসেবে নির্ধারিত হয় ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী। স্বীয় স্বার্থে ও অর্থে দেখভাল করে শেখ হাসিনাকে উপযুক্ত করে তোলা হয়েছিল, তুখর শ্যুটার, দুর্দান্ত দুুুর্নীতি পরায়ণ ও দুর্বৃত্তপনার লড়াকু হিসাবে। যাতে স্বার্থান্বেষী এ দু’পক্ষের স্বার্থসিদ্ধির পথ উন্মুক্ত হয়। প্রশিক্ষণ উত্তর অবশেষে পথপেলো দু’পক্ষ।
অগ্ন্যুৎপাতের সূত্রপাত হয় তখনই ছোট এ দেশটিতে। বহির্দেশের বদান্যতায় দুই বোনের একটি সবান্ধব সদ্গতি হয়ে যায়। এ প্রস্তুতির চূড়ান্ত পর্বের শেষে পরিমার্জিত কূটনৈতিক কূটকৌশলে বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এ অভিমানী শেখ কন্যা অন্তর্বেদনা নিয়ে অগ্নিদাহে অরুণবর্ণে নিজেকে রাঙিয়ে সন্ন্যাসিনীর বেশে বাংলাদেশে প্রবেশাধিকার পেয়ে পদার্পণ করেছিলেন নবরূপে, আবির্ভূত হয়েছিলেন কথিত দেশরত্ন হিসেবে।
সে দিনের ক্ষণলগ্ন কি শুভ কিংবা অশুভ ছিল তা এ দেশের মানুষকে হাড়ে মর্মে উপভোগ করতে হয়েছে। বড় বিশাল আকারের খেসারত গুনতে হয়েছে এ দেশের মানুষকে। ঐ সময়কার এ দেশের মহীরুহকারের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজ গংদের মধ্যে হতে কেউ উচ্চবাচ্য করেননি, শেখ হাসিনার এই প্রত্যাবর্তনে। ফাঁকে অভিমানী শেখ মুজিব কন্যা অন্তর্দাহে অরুণজ্যোতিলোকে ভারতের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আসীন হয়েছিলেন দেশটির সিংহাসনে, সমাজপতি হলেন দেশটিতে।
এ সময়টিতে দেশের মানুষের আশা আকাক্সক্ষা ঠেকেছিল গগনচুম্বীকারে কিন্তু নির্মম নিষ্ঠুরতায় আশাহত হয়ে পড়লো দেশের মানুষ। কালক্রমে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন দেশের সাধারণ মানুষ। দেশবাসী দেখতে পেলো আত্মস্বীকৃত এ রাজনন্দিনী এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে আসেননি, এসেছেন মাতা-পিতার ও ভাইদের হত্যার বদলা নিতে। মানুষ তখন ভয়ে কুঁচকে গেল, মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে একটু সময় লেগেছিল।
শেখ হাসিনার পরিকল্পিত কুকর্মটি সুচারুরূপে সম্পাদনের নিরিখে যে কর্মযজ্ঞগুলো সর্বপ্রথম সম্পাদন করার প্রয়োজন মনে করল তা হলো অভয়ারণ্যে নির্বিঘ্নে নির্বিচারে তহবিল সংগ্রহ করা। দ্বিতীয়টি হলো জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্র তৈরি করা। এর জন্য জামাতকে জঙ্গীবাদের তকমা দেয়া, জামাতি শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরকে খতম করল মিথ্যা অপবাদে প্রহসনের বিচারের দায়িত্বে নিয়োজিত ও কাণ্ডজ্ঞানহীন বিচারকের রায়ের ভিত্তিতে। চেঙ্গিস খানের পথ অনুসরণের মাধ্যমে দেশবাসীকে ভীতসন্ত্রস্ত করে মানুষের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল। ভিন্ন মতাবলম্বীদের গুম, খুন, আয়নাঘরে বন্দী করে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছিলেন।
তহবিল সংগ্রহ কাজে কতিপয় লুটের আধার নির্ধারণ করা হয়েছিল। জনগণের প্রদেয় ভ্যাট, ট্যাক্সের সঞ্চিত অর্থ, উন্নয়ন প্রকল্পের টাকার অংশবিশেষ, চাতুর্যের মাধ্যমে দেশের কতিপয় বাণিজ্যিক ব্যাংককে জনগণের গচ্ছিত অর্থ, বিদ্যুৎ খাত থেকে পুকুর চুরির অর্থ, শেয়ার বাজারের জনগণের অর্থ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মাধ্যমে হরিলুটের মহাউৎসব চলছিল দেশটিতে। উল্লেখ্য যে, রিজার্ভ চুরি উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে জড়িত দায়ী ব্যক্তিদেরকে কোনরূপ দোষারোপ করা এমনকি একটি বিবৃতিও প্রদান করা হয়নি।
এতদ্ব্যতীত অর্থলিপ্সু লুটের রাণী আরো ও অনেক অগণিত উৎস থেকে অর্থ লুন্ঠন করে গড়ে তুলেছিলেন মহামহৈশর্যভান্ডার, নিরুদ্বেগে, নির্লজ্জ বেহায়ার মতো করে। সাধারণত সম্ভ্রান্ত বংশোদ্ভূত মানুষ চুরি ডাকাতি, নোংরামির মতো ন্যক্কারজনক কাজ স্বভাববিরুদ্ধ বলেই কোনোক্রমেই করে না।
লুন্ঠনকৃত অর্থের কিয়দংশ দিয়ে ক্রয় করা হয়েছে দেশের লোভী, দেশপ্রেমহীন অযোগ্য প্রসাশনিক ব্যবস্থা, নখদন্তহীন বিচার বিভাগ, কতিপয় নীতিহীন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাগণের মধ্যে কয়েকজন এবং দলীয় সংগঠনের নেতা, পাতি নেতা এবং দেশের বৃহৎ বেকার যুবকগণের মধ্যে হতে কিছু সংখ্যক দেশের প্রতি মায়ামমতাহীন অসচেতন যুবকদের বাহুবল।
তদ্রƒপ আওয়ামী-বাকশালপন্থীরা ঐ একই অবস্থার চিন্তাধারা লালন-পালন করে মনের ভিতরে। আওয়ামী-বাকশালপন্থীদের “দরবেশ” একাই লুটেছেন ৫৭ হাজার কোটি টাকা (আমার দেশ পত্রিকা, ৮ জানুয়ারি ২০২৫) এটা একটুখানি কথা নয়। মানবেতিহাসে কোনো দেশে এমন লুটের ঘটনা ঘটার নজির পরিলক্ষিত হয় না। মস্তবড় এ তস্কর একটি দেশে বসবাস করে নির্দ্বিধায় এ লুটপাট সাধন করেছেন, যা দুরূহ কাজ, তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কথিত দেশরত্ন শেখ হাসিনার ছত্রছায়ায় আশ্রিত হয়ে এ কাজ সম্পাদন করতে তার মোটেই কষ্ট হয়নি।
দরবেশ চতুর্গুণে গুণান্বিত তাতে সন্দেহ নেই, এর মধ্যে চৌর্যবৃত্তি গুনে অতিশয় পাকা তা নিশ্চিত করে বলার দৃষ্টান্ত তিনি রেখেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এ যে, দরবেশ পালাতে গিয়ে চাতুর্র্যহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। সম্ভবত ভুলবশত নৌকায় পাল তুলেছিন, আবার এমনও হতে পারে যে, নৌকা ছাড়া তিনি কিছুই বোঝেন না। এর মধ্যে কোনটি সঠিক বুঝা মুশকিল, এও হতে পারে যে, দিগি¦দিক হারিয়ে বুদ্ধি ইন্দ্রিয়তে খেই হারিয়ে ফেলেছেন।
শেখ হাসিনার কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশা ছিল আশাতীত। মানুষ চেয়েছিল একটি সমৃদ্ধশালী অর্থনীতির সচলাবস্থা, সর্বশ্রেণীর মানুষের আয়ত্তে থাকা প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয়ের সক্ষমতা কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো বৈপরীত্যে। এ ধুরন্ধর অকরুণ নারী জাতিকে বঞ্চিত করেছে সবকিছু থেকে। দেশটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে নিজ স্বার্থ ও পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করেছে।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এ দুর্গেশনন্দিনী শপথ ভঙ্গ করে দেশের গৌরবোজ্জ্বল সেনা বাহিনীর ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে অন্তর্দহন প্রশমিত করেছেন। কিন্তু দেশের ক্ষতি করেছেন কতটুকু সে ভাবনা ভেবে দেখেন নি। এটাও ভেবে দেখেন নি যে, তার পিতার জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের একটি করুণ পরিণতি সংঘটিত হওয়ার পিছনে যে কারণগুলো ছিল সেগুলো কী কী? একপেশে চিন্তা করে অশিক্ষিত মানুষ, সুচিন্তিত মানুষের ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে।
শেখ হাসিনা পালানোত্তর বন্ধুপ্রতিম দেশে বসে ভিডিও বার্তায় বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন “আমার দোষ কী?” এসব কথা মানুষ আর এখন শোনেন না। স্বৈরাচার হটাও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগুনে ঘি ঢেলেছিল দিল্লীর কৃপা পাওয়ার আশায়, ছাত্র-জনতার উপর নির্দ্বিধায় নির্বিচারে গুলী চালিয়ে হত্যা ও পঙ্গু করেছে হাজার হাজার ছাত্র জনতাকে। ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ জাতি কোনদিন ভুলে যাবে না। প্রশ্ন থেকে যায় যে, শেখ হাসিনার হালুয়া খাওয়া দাঙ্গাবাজ ও দুর্বৃত্তরা এখনো কিভাবে সদর্পে বুক উঁচু করে এ দেশের মাটিতে হাঁটে, তাদের লুটের টাকা এবং অবৈধ অর্জিত সহায় সম্পত্তি কিভাবে এখনও সংরক্ষিত রয়েছে তা আমাদেরকে বিস্মিত করে।
দেশের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাতির প্রত্যাশা নিষ্ঠুর বৈপরীত্যে পর্যবসিত হলেও সে কোন কিছু ভ্রুক্ষেপ না করে, এ অকরুণ ধুরন্ধর ফ্যাসিস্ট দেশটিকে নষ্ট করে দিয়ে নিজ স্বার্থকে পরিপূর্ণ করেছেন, ফলে জাতির নিকট তিনি ঘৃণিত হয়ে ওঠেন এবং এমনিভাবে জাতির স্কন্ধে চেপে বসা এ জগদ্দল পাথরকে সরাতে দেশের মানুষকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে একটু একটু করে অগ্রগামী হতে হয়েছে। এক পর্যায়ে হাজার হাজার ছাত্র জনতার জীবন, রক্ত, অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্বের বিনিময়ে দানবীয় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কবল থেকে দেশকে মুক্ত এবং তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল।
দেশের মানুষ তাকে আটকাতে পারেনি, কারণ সে না পালানোর কথা বলেছিল, পালানোর জন্যই। সুব্যবস্থা করে রেখেছিল পথের। পালাতে গিয়ে তাকে দুর্গম দুর্গ পার হতে হয়নি। দোর্দণ্ড প্রতাপে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আকাশযান প্রস্তুত রাখা হয়েছিল।
মুহূর্তটিতে দেশের মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুক্ত বাতাস টেনে নিয়েছিল বুক ভরে। সে ক্ষণটিতে মনে পড়েছিল লেখক, গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জনাব সাইফুর রহমানের একটি লেখার কথা “রাবণ সীতাকে অপহরণ করলেও অসম্মান করেননি”। কিন্তু শেখ হাসিনা এদেশের মানুষকে শুধু গুম, খুন করেই ক্ষান্ত হননি উপহাসও করেছেন।
লেখক : অডিট এন্ড একাউন্টস অফিসার (অব:) পূর্ত অডিট অধিদপ্তর, ঢাকা।