প্রিন্সিপাল সাব্বির উদ্দিন আহমেদ

অধ্যাপক সি আর আবরারকে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নতুন শিক্ষা উপদেষ্টা জাতির আশা-আকাক্সক্ষা তথা একটি নৈতিকতাসম্পন্ন যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিতে সক্ষম হবেন বলে আমরা আশা করি। সেজন্যে একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা এ মুহূর্তে খুবই জুরুরি ও সময়ের দাবি। জাতির দাবি, মূলত এ শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকতার সাথে নৈতিকতার সম্মিলন ঘটাতে হবে। তার সাথে একটি প্র‍্যাকটিকাল শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এর ফলে এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে জাতি একদিকে ভালো মানুষ পাবে, অন্যদিকে পাশাপাশি দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি তৈরি হয়ে উঠবে। ফলে আগামী দিনগুলোতে মেধাবী, যোগ্য ও নৈতিকভাবে উন্নত ব্যক্তিরাই দেশ শাসন করবে। আমরা যারা শিক্ষক বা শিক্ষাবিদ আছি, আমাদের থেকে ও তিনি শিক্ষা বিষয়ক গঠনমূলক সাজেশন নিতে পারেন যা সমন্বিত ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে।

অধ্যাপক সি আর আবরারের ব্যাপারে যতটুকু জানতে পারি, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। যেহেতু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, সেহেতু তিনি একজন শিক্ষাবিদ ও বটে। কিন্তু তিনি ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন। প্রতিবেদনে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসংগতি তুলে ধরেন এবং শিক্ষাপ্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় তীব্র সমন্বয়ের অভাবের কথা বলেন। তিনি এ প্রতিবেদনে শিক্ষা সংস্কার সম্পর্কে কথা বলেন। কিন্তু এ বিষয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন, তিনি হয়ত সে ব্যাপারে করতে পারেননি।

অধ্যাপক সি আর আবরার শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে কতটুকু শিক্ষার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন সেটা এখন দেখার বিষয়। শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য তাকে যথেষ্ট সাহসিকতা, পরিশ্রমী, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দেখাতে হবে। জাতি গত ৫৪ বছরে কোনো সত্যিকারভাবে একটি সমন্বিত, যুগোপযোগী ও নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা পায়নি। শিক্ষকদের মর্যাদাসম্বলিত একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা আজও তৈরি হয়নি। মেধাবী ও নৈতিকতাসম্পন্ন লোকজন শিক্ষার পেশায় আসতে অনিচ্ছুক। প্রতিটি সরকারই এ বিষয়ে চরম অবহেলা দেখিয়েছে। এক কথায়, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে জাতি গড়ার ক্ষেত্রে আমরা খুবই পিছিয়ে আছি। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে ও আমাদেরকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য জুলাই-আগস্ট বিপ্লব করতে হয়েছে।

শিক্ষকদের মর্যাদা ও তাদের জীবনমান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। শিক্ষা এমন একটা বিষয় যা শুধুমাত্র মেধাবী বা উচ্চ ডিগ্রিধারী হলেই হবে না। তাকে শিক্ষাদানকে জীবনের সাথে মিশিয়ে ফেলে তারপর ছাত্রছাত্রীদেরকে শিক্ষাদানে ব্রতী হতে হবে তাহলে প্রকৃত শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। সুতরাং একজন কম ক্যালিবারসম্পন্ন ব্যক্তি ও ছাত্রছাত্রীদের কাছে ভালো শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। শিক্ষার এথিক্সের সাথে যার সম্মিলন হবে সে ভালো ও জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত হন। এখানে উচ্চডিগ্রি বা হাইপ্রোফাইল ডিগ্রিধারী আবশ্যক নাও হতে পারে। কাজেই আমরা তার থেকে এই ব্যাপারে বাস্তবভিত্তিক ও যুগান্তকারী উদ্যোগ আশা করি।

বিদায়ি শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বিদায় বেলায় বেসরকারী শিক্ষকদের জন্যে বিভিন্ন ভাতা দেয়ার কথা বলে গেছেন। তা আগামী ঈদুল আজহা থেকে কার্যকরের কথা আমাদেরকে জানিয়েছেন। এটি সত্যি একটি শুভ সংবাদ। সেজন্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। তিনি শেষের দিকে শিক্ষকদের কষ্ট কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন। আসলে একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, শিক্ষকদেরকে রাষ্ট্র কর্তৃক যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার আসনে বসাতে না পারলে সত্যিকারার্থে জাতি গড়ার কাজটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যা গত ৫৪ বছরে সম্ভব হয়নি।

একটি জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃথিবীর শীর্ষস্থানে সমাসীন করতে হলে অবশ্যই শিক্ষা ও শিক্ষকদেরকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ কাজটি মূলত রাষ্ট্রকেই করতে হবে। তাছাড়া, শিক্ষকদের মর্যাদা কতটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করলে শিক্ষকরা জাতি গড়ার কাজে তাদের মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সবকিছু ছাত্রছাত্রীদেরকে সুমানুষ তথা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করতে পারবেন। আগামী প্রজন্মকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্ব দেয়ার উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে শিক্ষকবৃন্দ পুরোপুরিভাবে নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে সক্ষম হবেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকার বিশেষভাবে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবেন এবং সে আলোকে পরবর্তী কর্মকৌশল তৈরি করবেন।

আমরা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখব তারা প্রথমে যে কাজকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল তা হচ্ছে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষকদেরকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসীন করা। এ ক্ষেত্রে আমেরিকা, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন, হংকং, যুক্তরাজ্য, সুইডেন এবং অতি সম্প্রতি মালয়শিয়া ও তুরস্ক অন্যতম। তারা শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করছে এবং শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা রাষ্ট্রের উচ্চ স্থানে স্থাপন করেছে। তা সেসব দেশে আজ উন্নতি ও অগ্রগতির শীর্ষে গিয়ে পৌঁছেছে।

শিক্ষার সংস্কার সবার আগে হওয়া উচিত কারণ আফ্রিকার অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে একটি স্মরণীয় উক্তি অঙ্কিত আছে। স্মরণীয় উক্তিটি হচ্ছে-

‘The destroying of a nation does not require the use of atomic bombs or the use of long range missiles. It only requires lowering the quality of education and allowing in the examinations by the students. The result is that the patients die at the hands of the doctors. The building collapses at the hands of the engineers. Money is lost at the hands of the economists and accountants. Humanity dies at the hands of the scholars. Justice is lost at the hands of the judges. Because the collapse of education is the collapse of a nation.’ ( Main entrance of Ahmadu Bello University (ABU), Zaria, Nigeria

স্মরণীয় এ উক্তিটি একটি সমন্বিত শিক্ষার অতিব গুরুত্ব ও সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতকরণের উপর অত্যন্ত জোরালোভাবে গুরুত্ত্বারোপ করে। অর্থ্যাৎ পারমাণবিক বোমা একটি জাতিকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করতে পারে না। এটি একটি দেশের একটি বা দুইটি অঞ্চল বা এলাকা ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু পুরো দেশ বা জাতিকে ধ্বংস করতে পারে না। কিন্তু একটি দেশের শিক্ষার পতন মানে পুরো দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করে ফেলা। তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে শিক্ষার পতন বা ধ্বংস সে দেশ ও জাতিকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে দেয়াকে বুঝায়।

সুতরাং আজকে আমরা নতুন বাংলাদেশের শ্লোগান দিচ্ছি ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর। কিন্তু আমরা সরকারের কেউ শিক্ষাকে নিয়ে তেমন সিরিয়াসলি ভাবছি না এ চিন্তা করে যে যদি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করে বর্তমান শিক্ষাকে আমূল, পরিবর্তন ঘটানোর উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে কোনো মহল বিশেষ নাখোশ হতে পারে। সেজন্যে হয়তো আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাকে নিয়ে তেমন খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন না। কিন্তু আমরা যদি ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সুফল বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌছে দিতে চাই এবং শহীদের স্বপ্ন বাস্তবে রুপ দিতে চাই তাহলে শিক্ষাকে সর্বাগ্রে সংস্কার করতে হবে।

শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনুস নিঃসন্দেহে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। বিশ্বে জীবিত যে কয়জন লিজেন্ড আছে যাদেরকে বিশ্ববাসী শ্রদ্ধা করে তাদের মধ্যে ড. ইউনুস সর্বাগ্রে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন। তার একটি বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘তিন শূণ্যের পৃথিবী’ A World of three zeros)। এ গ্রন্থে তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে নিছক চাকরি কেন্দ্রিক বলে কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে তার অভিমত পেশ করেন: ‘Young people should not be trained to be mere jobseekers; rather, they should be equipped with the knowledge and confidence to create jobs

ছাত্রছাত্রীরা শুধুমাত্র চাকরির পিছনে না দৌড়িয়ে নিজেকে উদ্যোক্তা (ঊহঃৎবঢ়ৎবহবঁৎং) হিসেবে গড়ে তোলার কথা তিনি বলেছেন। তার মতে ছাত্রছাত্রীকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির পাশাপাশি তাকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বিশ্বে শান্তি ও কল্যাণ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। এ ক্ষেত্রে তিনি সামাজিক ব্যবসা বিষয় শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করার পক্ষে জোর দেন। তিনি বলেন, Educational institutions should integrate social business concepts into their curriculum so that students understand how business can be a force for good.

শুধুমাত্র কর্মমুখী শিক্ষাই যথেষ্ট নয় এর সাথে নৈতিক শিক্ষার সম্মিলন ঘটাতে হবে। তবেই কোমলমতি শিশুরা একজন যোগ্য, নৈতিকতাসম্পূন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। ড. ইউনুসের বক্তব্য বিশ্ববাসীর কাছে সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ। তিনি সত্যিকার শিক্ষাদানের মাধ্যমে তিন শূণ্যকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করতে চান। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস সাহেব শিক্ষা নিয়ে যে চমকপ্রদ বক্তব্য দিয়েছেন তার বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ড. ইউনুসের শিক্ষা বিষয়ক স্বরণীয় মতামত (observation) দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। সেজন্যে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা সময়োচিত পদক্ষেপ হবে বলে আমরা মনে করি। লেখক : শিক্ষাবিদ।