॥ এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী ॥
মাইলস্টোন কলেজের উপর প্রশিক্ষরত যুদ্ধ বিমান দুর্ঘটনায় স্কুলের নিষ্পাপ শিশুদের মৃত্যুতে আমাদের সকলের হৃদয়-মন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারা হয়ে উঠেছে। গতকালকের এমন হৃদয়বিদারক ঘটনায় শোকে স্তব্ধ যেমন গোটা দেশ তেমনি এলাকাবাসি। কলেজ ক্যাম্পাসে কিছুক্ষন পর পর লাশ আসছে আর জানাযা হচ্ছে! মাইলস্টোন কলেজের ২য় তলা ভবনের উপর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যে প্রশিক্ষণ বিমানটি বিধ্বস্ত হয় তার-১ম তলায় ৩য়, ৪র্থ, ৫ম শ্রেণির ক্লাস, ২য় তলায় ৬ষ্ঠ, ৭ম, ৮ম শ্রেণির ক্লাস। এ অংশে ইংলিশ ভার্সনের কিছু ক্লাস।
প্রত্যক্ষদর্শীর মতে ঘটনার সময়ে পুরো দুর্ঘটনা স্থলটি যেন পরিণত হয়েছিল এক মিনি গাজা শহরে। বিমান ধ্বংস হওয়া, দাউ দাউ আগুনে চারিদিকে মানুষের আর্তনাদ কান্না আর পোড়া মানুষের কয়লা ,অর্ধ পোড়া মানুষের চিৎকার, এম্বুলেন্স,ভ্যান গাড়ীতে করে হাসপাতালে স্থানান্তর. নিখোঁজ শিশুদের স্বজনের কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে উঠেছিল! ছোটখাট একটা। যুদ্ধ বা কিয়ামত ঘটে গিয়েছিল যেন। এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা মিনিমাম -১২০ ,তার উপরে হবার সম্ভাবনাই বেশী। কোন কোন ক্লাস থেকে কোন বাচ্চাই বের হতে পারেনি। পুরো ক্লাসই জলন্ত অঙ্গারে পরিনত হয়েছে। হায় নিয়তি! এতবড় দূর্ঘটনার পর কোন্ অথরিটিকে দোষারোপ করবো আমরা!
বিগত সকল দূর্ঘটনার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়-কোন দূর্ঘটনার পর পরই তদন্ত কমিটি গঠিত হয় ,৭ দিনের মধ্যেই রিপোর্ট চাওয়া হয়! জানিনা গতানুগতিকভাবে গঠিত তদন্ত কমিটি কী রিপোর্ট দিবে! এর দায়ভার কে নিবে। এতগুলো নিষ্পাপ কচি প্রাণগুলোর এমন বিভৎসভাবে দূর্ঘটনার ঝড়ে যাওয়া বা কঠিন পোড়া নিয়ে হসপিটাল বেডে কাতরানো কিভাবে সহ্য করছেন তাদের স্বজনেরা!
একজন প্রত্যক্ষদর্শীর লোমহর্ষক হৃদয়স্পর্শি অভিব্যক্তিতে তার কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়-“আমি কোন ক্লাসরুমে ঢুকিনি, যেন এক উত্তপ্ত কয়লার বাগারে ঢুকেছিলাম... ক্লাসের ঢুকার রাস্তায় বিমানের ধংসাবশেষ পড়ে বন্ধ... জানালা একটি- ভিতরে ৩০+ শিক্ষার্থী বেঞ্চে বসে...দেহ অর্ধ গলিত অবস্থায়...কেউ হাত নাড়ায় আর কেউ মাথা... এক সেনা সদস্য বাহিরে দিয়ে গ্রিল ভাঙ্গবার কথা বলা মাত্র ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন মিলে গ্রিল ভাঙা শুরু করি.... কয়েকজনের হাত জানালার গ্রিলে ছিল (কারণ তারা বের হবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে ছিল) কিন্তু আগুনের উত্তপ্তার কাছে জীবন দিতে হল তাদের...!
জানালার গ্রিল ভাঙ্গবার সময় পাশে থাকার ২ জন সেনাসদস্য কাদঁছিল আর বলছিল, “এইযে মা !!! এইযে মা হয়ে গেসে আরেকটু এরপরই বের হতে পারবা” বলে বলে অজস্র কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখছি... হাত কাঁপছিল বাচ্চাগুলার মুখ দেখা মাত্র... বালতি দিয়ে নিচ থেকে পানি আনতে গেলে উপরে শব্দ পাই গ্রিল ভাঙ্গসে... ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এক এক করে ঢুকে গেল ।আমাদের মাক্স ছিল না তাই মানা করসে আমরাও মানা শুনে ঢুকার সাহস করিনি... মাথা ঝিম খাওয়া ছিল, হাত কাপছিল আর হার্টবিট প্রচুর ফাস্ট হয়েগিয়েছিল... শুধু দেখলাম ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা বাচ্চা গুলোর হাত ধরে তুলতে গিয়ে হাত সাথে এসে পরতেসে আহহহহহহহহ.... নিজেকে ঐ সময় কিভাবে ঠিক রাখতে পেরেছিলাম তাই ভাবছি... !
সমাজের কিছু জানোয়াদের সাথেও দেখা হইসে -যারা আহত কিন্তু সুস্থ অবস্থায় হেঁটে হেঁটে প্রথম ধাপে বের হইসে তাদের ভিডিও করছিল আর “আল্লাহ” “ইসসস” “আল্লাহ” করছিল... ! মূলত এদের সাথে সেনা সদস্যদের হাতাহাতিই দেখতে পেরেছেন হয়তো... ! এদের এইসব কর্মকা-ের জন্য আর সারাক্ষণ বিভিন্ন পয়েন্টে মারামারি দেখতে পাইসি এবং আমার মতে উচিত হয়েছে.... !
হে আল্লাহ!!!, “তুমি এরকম পরিস্থিতি আর বাংলাদেশের বুকেঁ না নামাও,...আজ যত নিরীহ প্রাণ নিহত হয়েছে তারা শহীদ...জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকামে ওদের রেখো আর “বাংলাদেশ”কে এরকম আপদকালীন সমস্যাগুলো থেকে বের করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা দিয়ে সমৃদ্ধশালী কর আর যারা এই দেশকে সমৃদ্ধশালী হওয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের যথাযথ শাস্তি প্রদান কর... আমিন।
[উত্তরা মাইলস্টোন কলেজ বিমান বিধ্বস্ত দূর্ঘটনা; দেশের পাতার এক নির্মম কালো অধ্যায়]
শুনেছি পুরোনো বিমানগুলোই নাকি প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে । এত পুরোনো বিমান প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা কতটা যৌক্তিক ও আইন সম্মত! তাছাড়া প্রশ্ন হলো জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান কেন? বিমান বন্দরের রানওয়ের পাশে স্কুলের অনুমোদন দেয়াটাই কতটা পরিকল্পিত ছিল, কিভাবে তা অনুমোদন দেয়া হলো? এসব ব্যাপারে জবাদিহীতার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ?
নিহত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের সলো ফ্লাইট ট্রেনিং (Solo Flight Training) ছিল। সলো ফ্লাইট ট্রেনিং হলো একজন পাইলটের ট্রেনিংয়ের সর্বশেষ ধাপ। একটি পোষ্টে দেখলাম -পাইলট তৌকিরের সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর হাতের মেহদির রং এখনো শুকোয়নি! পিতামাতা বুকের মানিক, এতগুলো নিষ্পাপ প্রানের এত কষ্টকর মৃত্যু যেন কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আর স্বজনেরা কিভাবে নিবেন!
হে আল্লাহ ! আপনি পাহাড়সম এ শোক সহ্য করার তৌফিক দিন। ঘটনার যথাযথ তদন্ত, দূর্ঘটনা কবলিত স্বজনদের পাশে দাঁড়ানো, আহতদের সুচিকিৎসা এবং নিহতদের মাগফেরাত কামনা করছি। এ ঘটনায় সরকারের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং ঘটনার পূনরাবৃত্তি রোধে এখনই জরুরী পদক্ষেপ গ্রহন জরুরী মনে করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক।