এম এ হক বিশ্বাস

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানের একটি মন্তব্য দিয়ে শুরু করছি। তিনি বলেছেন, ৫৪ বছরে রাজনীতিবিদরা কী করেছেন? তার এ বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাই অরাজনীতিবিদদের কিছুদিন সময় দেয়া যেতে পারে। স্বাধীনতার পর থেকে দুর্বৃত্তায়িত আওয়ামী রাজনীতির ছত্রছায়ায় যে ফ্রি স্টাইল লুটপাট, চাঁদাবাজী, দখলবাজী, ব্যাংক লুট, জমি-রাস্তাঘাট-বাড়িঘর-মিলকারখানা দখল, থেকে শুরু করে নির্বাচন নিয়ে তেলেসমাতি, ঘুষ-দুর্নীতি, খুন-রাহাজানি, স্বজনপ্রীতি, টাউট বাটপারির যে প্রলয়ংকারী যাত্রা শুরু হয়েছিল তা যেন থামছেই না।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় কিছুটা হলেও এ অরাজকতার গতি কমানো সম্ভব হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে তার সততা ও জনপ্রিয়তার কারণে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির প্রয়োজন পড়েনি। ’৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর একদিনের ব্যবধানে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম রাতারাতি অর্ধেকেরও বেশি কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশ আবার সঠিক পথে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল তখন থেকে। কিন্তু এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর পুনরায় সে পূর্বের ধারায় ফিরে আসে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার পতনের পর ৯০ এর দশকে গণতন্ত্র ফিরে আসলেও সে অরাজকতার ধারা অব্যাহত ছিলো।

এভাবেই চলে আসছিল এতকাল। এসময়গুলোতে মাঝেমধ্যে কোনো ঘটনা ঘটলে কিছুদিন হৈচৈ হওয়ার পর আবার ফিরে আসতো পুরুনো বৃত্তে। যেমন, একবার ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানায় ২ জন ছাত্র সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে ২/৩ সপ্তাহ পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়। সোস্যাল মিডিয়ায় টকশো শুরু হয়। ফলে কিছুদিন আইন-কানুনের খুব কঠোর দেখা যায়। আবার ঢাকা-আরিচা সড়কে এক বাস-মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পাঁচজন মানুষের মৃত্যু হলে কয়েকদিন সে লোক দেখানো মেরামত বা সংস্কার চলে। বাস ড্রাইভারকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর সে একই অবস্থা। আসলে অবস্থার কোনো উন্নতি বা পরিবর্তন হয় না। কোভিডের সময় সিলেট এমসি কলেজ বন্ধ থাকাবস্থায় কলেজের হোস্টেল কম্পাউন্ডে এক গৃহবধু কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী দ্বারা ধর্ষণের স্বীকার হলে শুরু হয় তোলপাড়। লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন আর কলেজের নিরীহ দারওয়ান বরখাস্ত হওয়া পর্যন্ত। এগুলো হাজারও উল্লেখযোগ্য ঘটনার দু’একটি মাত্র। কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান এসব কোনো ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। এদেশের জনগণ এভাবে দেখেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বাস্তবে সমাজে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।

যাহোক ৭১ এর পর থেকে এভাবে চলতে চলতে ৫ আগষ্ট ২০২৪ পর্যন্ত উল্টা পথে চলাটা প্রান্তিক পর্যায়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার পর থেকে যে লীগের সবকিছু খাই খাই দিয়ে শুরু করেছিল, তারা এবং তাদের বংশধরেরা স্বরূপে ফিরে সর্বত্র শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সীমা ছাড়িয়ে যায়। বিতারিত পলাতক লেন্দুপদর্জি খ্যাত ফ্যাসিস্ট সরকার নিজের গদি রক্ষার্থে ভারতীয় চক্রান্তের কাছে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়া স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী হাসিনার পতন ও তার প্রায় ১৬ বছরের অপশাসনের আসল চেহারা প্রকাশের মধ্যদিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্র মেরামতের সুযোগ আসে। সুযোগ আসে দেশ সংস্কারের। এ সুযোগ বারবার আসবে না। তাই এ সুযোগ সহজে হাতছাড়া করা যাবে না।

ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক এ বিপ্লবের পর সকলের ঐক্যমতে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েট ড. মোহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াকে দেশের প্রায় সকল জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাগত জানায় এবং অনেক আশা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে এবার যদি কিছু হয়। তার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই, দেয়া ছাড়া। আর এটাই এদেশের জন্য একটা মহাসুযোগ যা আমরা চাই তিনি যেন তা কাজে লাগাতে পারেন। সেজন্য আমাদের তাকে সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে। তাকে তার কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। দেশের সংস্কার ও উন্নয়নে এ অল্প সময়ের জন্য তার কাজে যেন বাধা না আসে। তার কাজে যেন ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদরা বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। মিডিয়ায় তার কাজের সমালোচনা হতে পারে। টকশোগুলোতে ভূল ধরিয়ে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তার মানে এই না যে ড. ইউনূসের জন্য তারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আমরা চাই নিছক সমালোচনা না করে গঠনমূলক সমালোচনা হোক। কিন্তু তাকে কাজ করতে দিন। ড. ইউনূস সমালোচনাকে উৎসাহিত করেছেন। তাকে তো ক্ষমতার জন্য লালায়িত হতে দেখা যায়নি। প্রেসিডেন্ট জিয়ার যেমন চলনবলন, পোশাক-আশাক, সম্পদ সম্পর্কে দেশের সকলেই জানে, আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের প্রায় সদস্যদের অবস্থা, চলনবলনও দেখছি। তাদের অবস্থাও সাধারণ বলেই দৃশ্যমান হয়েছে যা দেশের ইতিহাসে এরকমভাবে দেখা যায়নি। আসলে এটাই হওয়া উচিৎ ছিল এযাবৎ।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিল, নিজের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল তার নিজের প্রয়োজনে তা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। দেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান উচ্চশিক্ষিত মেরুদণ্ডহীন নতজানু নিয়ন্ত্রকদেরকে দিয়ে নিজের কব্জায় রেখেছিল। র্ভিসি, ডিসি, এসপি, গবর্নর থেকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান, পুলিশ সহ অন্যান্য সকল বাহিনীর প্রধান কেউ বাদ যায়নি। এমনকি ইমাম, খতিবও না।

তাই যাদের হাতে এ ভয়াবহ পরিস্থিতির সূত্রপাত ৭১-এর পর, শেষ পর্যন্ত ঠিক তাদের হাত থেকেই ২৪ এ উদ্ধার পাওয়া দেশকে কোনো অবস্থাতেই আর বিগত দিনগুলোর মতো সে ভয়ংকর ও পশ্চাৎমুখী ধারায় পরিচালিত করা যাবে না। দেশের প্রধান দু’খাত রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টস। এক কোটি দক্ষ, সেমি দক্ষ লোক অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের বাইরে থেকে বছরে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়। আর গার্মেন্টস থেকে আসে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এদুটোই দেশের মূল আয় যা সম্পূর্ণ দেশের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে কাজে না লাগিয়ে চুরি ও পাচার করার জন্য নয়। কিন্তু লুটপাট আর বিদেশে যে কি বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে তা ৫ আগষ্ট না হলে এভাবে জানতেও পারতাম না।

এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। পৃথিবীর বহু দেশ তাদের শুরুতে বাংলাদেশের মত পরিস্থিতিতে ছিল। তাই বলে আমাদের মতো অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে না। অল্প সময় বা সর্বোচ্চ ৪/৫ বছরের মধ্যেই সভ্য দেশের কাতারে সামিল হতে দেখা যায় অনেক দেশকে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এখন পর্যন্ত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার মত রাজনীতিবিদ এদেশে দেখা যাচ্ছে না। মূলত এক দু’দিনের সংস্কার করে কোনো লাভ হবে না। এরকম এক দু’দিনের, এক দু’মাসের সংস্কার দেশবাসী অনেক দেখেছে। কাজেই ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব আমাদের দরকার। আমরা আশা করব তিনি যত বেশিদিন সম্ভব সংস্কার চালিয়ে দেশকে সঠিক ট্রাকে উঠিয়ে আরও বেশি দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তাই তাকে সে পর্যস্ত সময় দিতে হবে। পাশাপাশি কঠোর আইনের শাসন ও জবাবদীহিতা নিশ্চিতকরণের কাজ চালিয়ে যেতে হবে। সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাদের সুপারিশ অনুযায়ী সমাজের প্রতিটা স্তরে কার্যকর সংস্কার করতে হবে। জনগণের মনমানসিকতার উপর ও সংস্কারে স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়তে দিতে হবে। বর্তমানে আটককৃত ও আটককৃত নয় (পালিয়ে থাকাসহ) এমন চোর-ডাকাত, দুর্নীতিবাজ অলিগার্কদেরকে অবশ্যই ন্যয়বিচারের মাধ্যমে উদাহরণযোগ্য ও দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

এ সংস্কারের সুফল হিসেবে দেশের জনগণ যেন শক্তিশালী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে নিজেদেরকে ভাবতে পারে। নিজেদের আত্মমর্যাদা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারে। চাইলেও আর পিছনের দিকে কেউ দেশকে নিয়ে যেতে না পারে। এসব আমাদের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। এজন্য দৃশ্যমান ও দৃষ্টান্তমুলক সংস্কার করার পরই নির্বাচন হোক। অন্যথায় দেশের আর্থ-সামাজিক যে অবস্থা এখনও বিদ্যমান তাতে ইলাষ্টিকের মতো তা পূর্বের স্থানে চলে যাবার সমুহ সম্ভাবনা আছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক।