মো: আকতার হোসাইন

১৮৭৫ সালের ২২ এপ্রিল কুড়িগ্রাম মহাকুমার জন্ম। যে মহাকুমায় অন্তর্ভুক্ত ছিল লালমনিরহাট সহ ৮ টি থানা। এরপর বাংলাদেশ জন্ম হওয়ার বেশ পরে ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার জন্ম নয়টি উপজেলা নিয়ে। কুড়িগ্রাম পুরাতন একটি শহর হলেও এ শহরটি তেমনভাবে প্রসারিত হয়নি। এর অন্যতম একটি কারণ হলো অবহেলা ও অবজ্ঞা। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। জেলার উপজেলা গুলো বেশ পুরাতন হলেও পৌরসভা রয়েছে মাত্র তিনটি। অথচ অধিকাংশ জেলাতেই উপজেলার চেয়ে পৌরসভার সংখ্যা বেশি। কতটা অবহেলিত বা উপেক্ষিত হলে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত উপজেলাগুলো পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়নি।

নদীমাতৃক এ দেশে কুড়িগ্রাম জেলাটি ভৌগোলিকভাবে এমন অবস্থায় অবস্থিত যে, উপকূলীয় জেলাগুলোর মতই এবং সীমান্তঘেষা জেলাটি। কিন্তু উপকূলীয় জেলাগুলোতে যে পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয় সে তুলনায় এ জেলাতে তেমন কোন বাজেট বরাদ্দ নেই। কুড়িগ্রাম জেলাকে উপকূলীয় জেলাগুলোর সাথে তুলনা করছি এ জন্য যে বাংলাদেশ আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোয় যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয় তার তিন চতুর্থাংশ এ জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়। ছোট বড় অসংখ্য নদী প্রবাহিত হয়েছে জেলাটি দিয়ে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ইত্যাদি। নদীগুলোর দ্বারা প্রতি বছরই নদীভাঙন ও বন্যা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এর উদাহরণ ২০২৪ সালে ফেনীতে বন্যা হলে সারাদেশ কি পরিমাণ মাতামাতি হয়েছিল সেটা সবারই জানা। অথচ কুড়িগ্রামে নিয়মিত বন্য হওয়ার ফলে এটি সবার কাছে স্বাভাবিক ঘটনার মতই মনে হয়। সুতরাং কুড়িগ্রাম জেলাটি নিয়ে পূর্বে ও বর্তমানে কখনোই কারো নজর ছিল না এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের সন্তান তুহিন ওয়াদুদ লিখেছেন, ‘কয়েক দশক ধরে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলায় ব্রহ্মপুত্রের বা তীরে সীমাহীন ভাঙন চলছে। সেখানে ভাঙন বন্ধে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। কয়েক বছর আগে ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় অনেক বড় একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। সে প্রকল্পে কোনো ফল পাওয়া যায়নি। নদী খননের সে প্রকল্পের পরিবর্তে যদি রৌমারী-রাজীবপুরের মানুষের আবাসন-জমি সুরক্ষার কাজ করা যেত, এতে মানুষ বেশি উপকৃত হতো’। আবার ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে এক শীর্ষ জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল “বৈষম্য বিরোধী উপদেষ্টার জেলাপ্রীতি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও একই পথে “প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়, কুমিল্লা জেলায় বিশেষ প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে ২৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে, সাতক্ষীরা জেলায় বিশেষ প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে ২১৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে, অথচ কুড়িগ্রামে বিলাসী কোন প্রজেক্ট নয় শুধু আবশ্যিক প্রজেক্টই পায় না। যেখানে ৭০ শতাংশ উপজেলা সড়কই খারাপ। রাস্তাঘাট মেরামতের জন্য ৮০ কোটি টাকার বরাদ্দ চাওয়া হলে বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ৪০ কোটি টাকা। বর্তমান বাজেটে এডিপি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা অথচ কুড়িগ্রাম জেলা তথ্য বাতায়নে জেলা বাজেটে দেখা যায় মাত্র ১০ কোটি টাকা এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কি নিদারুণ বৈষম্য!

কুড়িগ্রাম জেলাটিতে বাংলাদেশের সৃষ্টির পর হতে আজ অবধি দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে এমন জনসংখ্যার হার সর্বদা সর্বোচ্চ ছিল এবং আজও আছে। যদিও দারিদ্র মানচিত্র ২০২২ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তবুও এ প্রতিবেদনে দারিদ্রের হার ৩১.৩ শতাংশের উপরে, অপরদিকে দারিদ্র মানচিত্র ২০১০ অনুযায়ী এ জেলাটিতে দারিদ্র ছিল ৬০.৫ শতাংশ। দারিদ্র নিরসনের জন্য সরকারের পাশাপাশি প্রায় ৭১ টি এনজিও কাজ করছে জেলাটিতে। দারিদ্র নিরসনে সরকারের দৃশ্যতো যে পদক্ষেপটি লক্ষ্য করা যায় তা হল VGF, OMS এবং VGD কার্ডধারীর মাধ্যমে বা বন্যা পরবর্তী সময়ে ২০-৩০ কেজি চাল বিতরণ করে দারিদ্র নিরশনের চেষ্টা করছে সরকার। এটি কখনোই একটি রাষ্ট্রের দারিদ্র নিরসনের সঠিক কাঠামো হতে পারে না। স্থায়ীভাবে দারিদ্র নিরসনের জন্য প্রয়োজন কর্মসংস্থান। যদি সঠিক কর্মসংস্থান তৈরি করতে না পারা যায় তাহলে কখনোই স্থায়ীভাবে দারিদ্রতা হ্রাস পাবে না। ২০-৩০ কেজি চাল বিতরণের ফলে যা হয় ওই অঞ্চলের মানুষ অলস হয়ে পড়ে, একেতো কাজ নেই তার উপর বিনামূল্যে ২০-৩০ কেজি চাল পাওয়া যায় তাহলে কাজের কি প্রয়োজন। এটি একটি রাষ্ট্রের সুস্থ মস্তিষ্কের চিন্তা হতে পারে না।

জেলাটির ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় একটি স্থালবন্দর রয়েছে। যে স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সাথে বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর কথা। সেখানেও রয়েছে এক অবহেলার ছাপ। স্থলবন্দরটি ২০১২ সালে অনুমোধন পেলেও চালু হয় ২০১৮ সালে এবং সীমিত সংখ্যক পণ্য আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ইমিগ্রেশন চালু হয়নি। এ স্থলবন্দরটি ব্যবহার করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ভুটানের অর্থায়নে এই অঞ্চলটিতে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বন্দোবস্ত করেছিলেন। কিন্তু গত ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে বেজার মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে সংস্থাটির নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘আগামী ২ বছরে হবে ৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চল’। যেখানে এই জেলাটি নেই। অথচ ১৮ ফেব্রয়ারী, ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভুটানের রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুয়েনৎসিল বিদায়ী সাক্ষাৎকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বলেন, উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে ভুটানি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (এসইজেড) কাজ দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, সেখানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ভুটানি বিনিয়োগকারীরা এখানে ভুটান ও আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন করবে’।

কিন্তু বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান কথা অনুযায়ী এ জেলাটি দারিদ্র থেকে উত্তরণের স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত হয়। বৈষম্যের শিকার হয় এ জেলাটি। যদি জেলাটিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলে দারিদ্র্যের হার নির্মূল না হলেও অনেকাংশেই কমে যাবে। কারণ প্রত্যক্ষভাবে যদি ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয় তাহলে পরোক্ষভাবে কম করে হলেও এক লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হবে। যা এ জেলাটির স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য নিরাসনে ভূমিকা রাখবে। আমাদের দেশ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দ্বারা প্রভাবিত। সুতরাং কুড়িগ্রাম অর্থনৈতিক অঞ্চলটি বিগত সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ আর এ কারণেই আগামী নির্বাচিত সরকার এটিকে পিছনে ফেলে রাখবে তা অনেকটাই অনুমেয়। তাই অন্তবর্তী কালীন সরকার যদি এটিকে অগ্রাধিকার না দেয় তাহলে কুড়িগ্রাম জেলার ভবিষ্যৎ কুয়াশাচ্ছন্ন। দারিদ্র নিরশনে আরো একটি পদক্ষেপ নিলে এই জেলাটি আরো বেশি দারিদ্র্যমুক্ত হবে। যদি চিলমারী নৌবন্দরটি পুনরায় চালু করা যায় তাহলে নেপাল, ভুটান ও ভারতের সাথে এমনকি চায়নার সাথেও বাণিজ্য প্রসার হতো, যা এ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে বাণিজ্য প্রসারে আরো বেশি বড় ভূমিকা রাখত। পাশাপাশি তিস্তা মহা পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে এ জেলাটি তথা পুরো উত্তরবঙ্গই সোনায় সোহাগায় পরিণত হবে। দারিদ্র চিরতরে মুক্ত হবে।

লেখক : ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক।