॥ মোঃ আনসারুজ্জামান সিয়াম ॥

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র ও জনতার নেতৃত্বে সংঘটিত একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন- জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪, যা পরবর্তীতে ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে পরিচিতি পায়। দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে যাবার পরও সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলোতে বিতর্কিত কোটাপদ্ধতি বহাল রেখেছিলেন। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো ছাত্রসমাজ কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে নামে এবং সেসময় সরকার কোটা ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেয়। কিন্তু ২০২৪ সালে হাইকোর্ট সে সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলন নতুনভাবে শুরু হয়।

১৪ জুলাই, ২০২৪ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের চীন সফর নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ আখ্যায়িত করলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়। সেদিন রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগরসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা স্লোগান দিতে থাকে- “তুমি কে, আমি কে? রাজাকার রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!” এ স্লোগান ঘিরেই উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতে থাকেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা- ওবায়দুল কাদের, মোহাম্মদ এ আরাফাত, মহিবুল হাসান চৌধুরী, নওফেল, আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রমুখ। ওবায়দুল কাদের বলেন, “এসব রাজাকারদের প্রতিহত করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট।”

১৫ জুলাই-ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দামের নেতৃত্বে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয় এবং নারী শিক্ষার্থীদেরও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। তবুও নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এসময় সরকারের উদাসীনতা এবং দমননীতি আন্দোলনের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সরকার নানা রকমের অপবাদ ও ট্যাগিং দিয়ে আন্দোলন ব্যর্থ করতে চাইলেও তা ব্যর্থ হয় নি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্তৃক নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা শুরু হয় রাতের বেলায়। তবে এ আন্দোলন শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এতে অংশ নেয়।

১৬ জুলাই- সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। আন্দোলন এক নতুন মাত্রা পায় এবং সাধারণ মানুষও এতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।

১৭ জুলাই- এইদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়েবানা জানাযা আয়োজন করতে গিয়ে পুলিশের হামলার শিকার হন শিক্ষার্থীরা। সেদিন সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। একই রাতে যাত্রাবাড়ীতে হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

১৮ জুলাই- সারাদেশে সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা বাড়তে থাকে। ব্রডব্যান্ড সংযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯ জুলাই-‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয় এবং রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেন, ৯ দফা দাবি মানা না হলে এ কর্মসূচি চলতেই থাকবে।

২০ জুলাই- সারাদেশে সেনা মোতায়েন এবং সাধারণ ছুটি ও কারফিউ জারি করা হয়। এদিন আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র নাহিদ ইসলামকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ২১ জুলাই- দেশের সর্বোচ্চ আদালত কোটা পুনর্বহালের হাইকোর্ট রায় বাতিল করে। একইসাথে আন্দোলনকারীরা ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে চার দফা বাস্তবায়নের দাবি জানান। ২২ জুলাই- সরকার আদালতের রায় অনুসারে কোটা সংস্কার প্রজ্ঞাপন জারি করে এবং সীমিতভাবে ব্রডব্যান্ড সংযোগ পুনরায় চালু করে।

২৫ জুলাই-চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও তিনজন শহীদ হন। ২৬ জুলাই- আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার সংখ্যা ৬,২৬৪ ছাড়িয়ে যায়। একই দিনে আরও তিনজন শিক্ষার্থী মৃত্যুবরণ করেন এবং আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্ব নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও বাকের মজুমদারকে গোয়েন্দা হেফাজতে নেওয়া হয়। ২৭ জুলাই-আরও দুই নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস গ্রেপ্তার হন।

২৮ জুলাই-গোয়েন্দা হেফাজতে থাকা ছয় নেতার ‘সর্ব কর্মসূচি প্রত্যাহারের’ ঘোষণা দেওয়া ভিডিও বার্তা গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। পরে মাহিন সরকার বলেন, “অস্ত্রের মুখে এ ভিডিও বার্তা রেকর্ড করা হয়েছে।” ওই দিন মোবাইল ইন্টারনেট পুনরায় চালু হয়।

৩০ জুলাই- শহীদদের স্মরণে ফেসবুক প্রোফাইল লাল রঙে রাঙানো হয়। ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৩১ জুলাই-‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস’ কর্মসূচির ঘোষণা আসে। ১ আগস্ট-আটককৃত ছয় নেতাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এদিন জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ করে সরকার। ৩ আগস্ট-শহীদ মিনার থেকে এক দফা দাবি হিসেবে সরকারের পদত্যাগ দাবি করা হয়। ৪ আগস্ট-ঢাকায় লং মার্চের কর্মসূচি ঘোষণা হয়।

৫ আগস্ট- ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলায় অসংখ্য মানুষ নিহত হন। দুপুর ১২টায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা দেন। রাজধানীজুড়ে ছাত্র-জনতার ঢল নামে।

৩৬ জুলাইর মধ্য দিয়ে উদিত হয় একটি সম্ভাবনাময় নতুন বাংলাদেশের সূর্য। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের ঘুষ, দুর্নীতি, ধর্ষণ, গুম, খুন, টেন্ডারবাজি এবং মাদকের বিরুদ্ধে এ গণঅভ্যুত্থান ছিল জাতির জাগরণের প্রতিচ্ছবি। ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, মাদক সাপ্লাই, শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, ট্যাগিং ও ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ দাঁড়িয়ে গেছে দৃঢ়ভাবে। ভবিষ্যতে যাতে কেউ এমন অপকর্ম করার দুঃসাহস না দেখায়, সেজন্য ছাত্রসমাজের ভূমিকা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার ও জনগণের যৌথ প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করে দিয়েছে, এদেশের মানুষ নিরাপদ আগামীর জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত, কিন্তু কোনো স্বৈরশাসকের হাতে প্রিয় মাতৃভূমিকে তুলে দিতে রাজি নয়।

শহীদদের আত্মত্যাগ জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে চিরকাল। জাতির প্রত্যাশা, শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবিলম্বে স্বৈরাচারী সরকারের সকল অপকর্ম ও গণহত্যার বিচার সম্পন্ন করবে।

লেখক : শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী, গণবিশ্ববিদ্যালয়, সাভার।