॥ নূর মোহাম্মদ ॥

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক ও উপকূলীয় দেশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের অন্যতম শিকার। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা এবং লবণাক্ততার বিস্তার দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও প্রকৃতিকে করে তুলছে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে। এমন প্রেক্ষাপটে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ একান্ত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে প্রযুক্তিগত ও পরিবেশগত দিকগুলো সমানভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। আধুনিক ও শক্তপোক্ত বাঁধগুলো হতে হবে:

১. উচ্চতা ও প্রশস্ততায় আধুনিক মানসম্পন্ন: জলস্তরের উচ্চতা এবং ভবিষ্যৎ প্রবল জলোচ্ছ্বাসের প্রেক্ষিতে বাঁধের উচ্চতা নির্ধারণ করতে হবে। প্রশস্ততাও এমন হতে হবে যাতে সহজে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

২. ইকো-ফ্রেন্ডলি ডিজাইন: বাঁধের আশেপাশে ম্যানগ্রোভ বন রোপণসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে প্রাকৃতিকভাবেই ঢেউয়ের তীব্রতা হ্রাস পায়।

৩. দীর্ঘস্থায়ী উপকরণ ব্যবহার: বাঁধ নির্মাণে কংক্রিট, জিওটেক্সটাইল ও পাথরসহ এমন উপকরণ ব্যবহার করতে হবে যা দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

৪. নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণযোগ্য: বাঁধ নির্মাণের পর নিয়মিত তদারকি, সংস্কার ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে যাতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়রোধ করা যায়।

৫. জনসম্পৃক্ত পরিকল্পনা: স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হলে বাঁধ কার্যকরভাবে টিকে থাকতে পারে।

টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে নানাবিধ বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম:

১. জীবন ও সম্পদের ক্ষতি: ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় বাঁধ ভেঙে গেলে মানুষের প্রাণহানি ও বাড়িঘর ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

২. চাষযোগ্য জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি: লবণাক্ত পানি ঢুকে কৃষিজমি অনাবাদি হয়ে পড়ে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

৩. বিশাল জনসংখ্যার বাস্তুচ্যুতি: বাড়ি ও জমি হারিয়ে অনেক মানুষ শহরমুখী হয়ে পড়ে, যার ফলে শহরগুলোর ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।

৪. অর্থনৈতিক বিপর্যয়: কৃষি, মৎস্য ও পশুপালন নির্ভর অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। অনেক অঞ্চলে দরিদ্র্যতা চরমে পৌঁছে যায়।

৫. প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি: বারবার জলোচ্ছ্বাসে বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যায়, যা জলবায়ুর ভারসাম্যহীনতা আরও বাড়িয়ে তোলে।

মোদ্দাকথা : জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তবতা এবং এটি মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ শুধু একটি উন্নয়ন প্রকল্প নয়, বরং এটি লাখো মানুষের জীবন, জীবিকা ও ভবিষ্যৎ রক্ষার পূর্বশর্ত। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে একসঙ্গে কাজ করা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এই প্রতিরক্ষা বলয় গড়ে তুলতে হলে এখনই নিতে হবে সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।