॥ মুহাম্মদ আসাদ উল্লাহ আদিল ॥
ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরস্পর Interrelated. রাষ্ট্রের একক হচ্ছে পরিবার। পৃথিবীর প্রথম পরিবার হযরত আদম (আ:) ও হাওয়া (আ:) এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। বৈধ পন্থায় সম্পর্কিত একজন পুরুষ, একজন নারী ও তাদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে গড়ে ওঠে একটি পরিবার। এভাবে প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় বিস্তার লাভ করে পরিবারের ধারা। “হে মানব সকল নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি অতঃপর তোমাদের সাজিয়েছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো।” (সুরা হুজরাত : ১৩)
পরিবারকে আমরা ছোট্ট সমাজ সংস্থার (Small Community) পাশাপাশি একটি টেকসই মানবীয় সংস্থা (Stable Human Institution) ও স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান (Natural Institution) হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি।
মানবসমাজে মনুষ্য সৃষ্টি সম্বন্ধে দুটি মতবাদ প্রচলিত। তার একটি হচ্ছে মানুষ এক আদমের বংশজাত। “আর তিনি (আল্লাহ) তাদের দুজন থেকেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য পুরুষ ও নারী।” (সূরা নিসা : ১) অন্যদিকে, বিবর্তনবাদীরা যারা ডারউইনের “Theory of Evolution” এর সমঝদার, তারা মনে করেন শেওলা, কেঁচো, সাপ, শিম্পাঞ্জি ও বানরের পরিবর্তিত ধারাবাহিক রূপান্তর মানুষ। মুসলিম দর্শন অনুযায়ী পরিবার গঠনের মূল ভিত্তি হচ্ছে বিবাহ। “এবং তার (আল্লাহর) একটি নিদর্শন এ যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও মমতা সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (আর-রূম: ২১)
ব্যক্তির সমষ্টি পরিবার, আবার সে পরিবারই মানুষ গড়ার কারখানা। পরিবার থেকেই পৃথিবীর প্রায় সকল মহামনীষীদের শিক্ষার হাতেখড়ি। একটি শিক্ষিত, রুচিশীল ও সমৃদ্ধ পরিবার যেন একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, উদার ও উন্নত রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি। একটি পরিবারের মৌলিক উপাদান হচ্ছে-পরস্পর শ্রদ্ধাবোধ ও স্নেহ-মমতা, ঐক্য, পারস্পরিক পরামর্শ, সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা, নির্দিষ্ট পরিকল্পনা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সম্মিলিত প্রয়াস, পারস্পরিক সুসম্পর্ক, সুখ-দুঃখের অংশীদার, ভিন্ন মতকে গ্রহণ করা বা সহ্য করা।
মা ও বাবা দু’জনের একজনকে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী আর অপরজনকে প্রেসিডেন্ট ও পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে রাষ্ট্রের জনগণ হিসেবে ধরে নিলে একটি পরিবারের কাঠামো একটি রাষ্ট্রের কাঠামোর প্রতিবিম্ব হিসেবে কাজ করে। যদিও দার্শনিক প্লেটোর মতে, “পরিবার হচ্ছে সমাজ জীবনের সব অনৈক্যের (discord) মূল কারণ। কারণ পরিবার ওই মানুষকে শিক্ষা দেয়: আমি ও তুমি, আমার ও তোমার।”
পরিবার হচ্ছে একটি পাঠশালা আর মা-বাবা সে পাঠশালার নিঃস্বার্থ শিক্ষক আর ছেলে মেয়ে হল সে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। আরবি কবির ভাষায় “মাতৃক্রোড়ই হচ্ছে সন্তান-সন্ততির জন্য অনবদ্য শিক্ষালয়”। পারিবারিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য একটি সম্মানের বেড়ে ওঠার নিয়ামক শক্তি। Family Manners ও Etiquette সন্তান-সন্ততির মাঝে রুচি, মননশীলতা ও মূল্যবোধ তৈরি করে। পারিবারিক ঐক্য ও বন্ধন বৃহত্তর ঐক্যের শিক্ষা দেয়। পরিবারের একজন সদস্যের ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমালোচনা শুনা ও সহ্য করার দীক্ষা পাওয়া যায়। পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রজ্ঞা বৃহত্তর অঙ্গনে স্থিতিশীলতা সৃষ্টির লব্ধ জ্ঞান। যৌথ পরিবার প্রথা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হলেও পশ্চিমা সভ্যতার (western civilization) প্রভাবে আজ সেটি ক্ষীয়মান।
পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত দার্শনিক অধ্যাপক সরোকিন বর্তমান পারিবারিক ব্যবস্থার ব্যাপারে বলেন, “পূর্বে মানুষ আনন্দ লাভ ও চিত্ত বিনোদনের উদ্দেশ্যে ফিরে যেত পরিবারের নিভৃত আশ্রয়ে, কিন্তু বর্তমানে মানুষ তার জন্য চলে যায় সিনেমা-থিয়েটার নাচের আসর ও ক্লাবঘরের গীত মুখর বেষ্টনীতে। পূর্বে পরিবার ছিল আগ্রহ-ঔৎসুক্য ও আনন্দ-উৎপলতার কেন্দ্রস্থল। পারিবারিক জীবনেই আমরা সন্ধান করতাম শান্তি, স্বস্তি, তৃপ্তি ও আনন্দের নির্মলতা। কিন্তু এখন পরিবারের লোকজন হয়ে গেছে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত।”
আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পারস্পরিক প্রীতি, মাধুর্য, অকৃত্রিম আন্তরিকতা। পার্থিব স্বার্থের মোহ, জীবন মান উন্নত করার প্রতিযোগিতা ও প্রবণতা আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত ঐতিহ্যকে চূর্ণ করে দিচ্ছে। কেউ কারোর ধার ধারে না, পরোয়া করে না। আপন সন্তান সন্ততির পার্থিব ও ক্যারিয়ার গঠনে মা বাবা যেন আজ নির্ঘুম ক্লান্তিহীন কারিগর। Social Status Maintain করতে গিয়ে অনেকের সন্তান-সন্ততির ইচ্ছার বিরুদ্ধে wrong decision গ্রহণ করছে। সবার মাঝে অজানা অদৃশ্য কিছু অর্জনের চরম ও পরম আকাক্সক্ষা। পারিবারিক ও সামাজিক মেলবন্ধন আজ হারিয়ে যাচ্ছে। বিবাহের ক্ষেত্রে Arranged Marriage এর সংস্কৃতি প্রায় লুপ্ত। Affairs Marriage এর ফলে পারিবারিক বন্ধন সংস্কৃতি যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চরমভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। একদিকে অপরিনত বয়সে বিবাহের সংখ্যা ও Love Marriage যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি ব্যাপক হারে বিবাহ বিচ্ছেদও ঘটছে। ২৭ আগষ্ট ২০১৮ দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতি ঘন্টায় একটি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, যেখানে ২০০৬ সালে পুরো বাংলাদেশে প্রতি হাজারে বিচ্ছেদের হার ছিল ০.৬ জন, বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১.১ জন। এক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষিতদের হার ১.৭ জন। আর অশিক্ষিতদের হার ০.৫ জন। [সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো]বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য ২৫-২৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আবেদন করছে। এক্ষেত্রে নৈতিক স্খলন, পরস্পর সন্দেহ প্রবণতা ও পরকীয়া বিচ্ছেদের মূখ্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা।
চট্টগ্রামেও বর্তমানে বিবাহ বিচ্ছেদের হিড়িক পড়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী ১৫৭৯ টি বিচ্ছেদের আবেদন করা হয়েছে। তন্মধ্যে প্রতিমাসে গড়ে ৩৮৪ টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। সে হিসেবে প্রতিদিন বিচ্ছেদ ঘটছে ১৫ টি আর প্রতি দু’ঘন্টায় ২/১ টিরও বেশি আবেদন জমা পড়ছে। যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আবেদন কারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ নারী বিচ্ছেদের আবেদন করছে। (সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩১ জুলাই ২০১৯)
ফলে অনেক ছেলে-মেয়ে মা বাবার অযতেœ ও অবহেলায় বেড়ে উঠছে। ভাল পরিবারে জন্ম নেয়ার পরও সামাজিক অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছে। পারিবারিক শিক্ষা ও Nursing এর অভাবে এবং western culture এর নগ্ন থাবায় আমাদের পরিবার ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুনে ধরেছে। পশুত্ব বিরাজ করছে সবখানে। মনুষ্যত্ব, মানবতা, মহানুভবতা ও উদারতা আজ ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে যাচ্ছে। ফলে সমাজ জীবনে যে ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা শুধু সভ্যতাকেই ধ্বংস করছে না, মনুষ্যত্ব ও মানবতাকেও দিচ্ছে প্রচ- আঘাত।
মাছ চাষ, পশু পালন, ক্ষেত-খামার সকল কিছুতে সফল হওয়ার জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ ও জ্ঞান দরকার আর সৃষ্টির সেরা মানব সন্তান লালন পালনের জন্যও অবশ্যই পরিকল্পনা, চিন্তা ও Study প্রয়োজন। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, সহনশীলতা, লৌকিকতা ও অহংকার ত্যাগ, ছেলে-মেয়ের Worldly Career এর পাশাপাশি Spiritual Career গঠনে মনোযোগী হওয়া, পরিবারের সদস্যদের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, অপরের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন থাকা, নৈতিকতার ব্যাপারে ছাড় না দেয়া, বিভিন্ন বিষয়ে counselling করা, সন্তান-সন্তুতিদের ধীরে ধীরে বুঝতে শেখানো, মাসিক পারিবারিক বৈঠক করা, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পরামর্শ করা, বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করতে শেখানো, Morality Development Motivation অব্যাহত রাখা, প্রত্যেকটি পরিবারকে Training Centre বানানো, সর্বোপরি মহান রবের কাছে আমাদের মোনাজাত হোক-“হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তান সন্ততিদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ কর।” (সূরা ফুরকান : ৭৪)
তবেই সম্ভব একটি প্রীতিময় পারিবারিক বন্ধন তৈরি করা। আর সেটি হোক সমৃদ্ধ ও শান্তিময় বাংলাদেশ গড়ার প্রথম প্রয়াস (First Initiative)।
লেখক : অধ্যক্ষ, ন্যাশনাল ইংলিশ স্কুল চিটাগং।