॥ তোফাজ্জল হোসাইন ॥

বিতর্কিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনাকারী সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনটি নির্বাচনে বিগত সরকারকে টানা জয় এনে দেয়ার ক্ষেত্রে এরাই মূল কারিগর। একের পর এক জয় পেয়েই ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে একতরফা নির্বাচনের যেসব নজির রয়েছে তার মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্যতম। সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী সে নির্বাচন বয়কটের প্রেক্ষাপটে অর্ধেকের বেশি আসনে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৪৬টি আসনে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘একতরফা বিনাভোটের’ নির্বাচন আয়োজনের অন্যতম কারিগর কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ বারিধারায় তার নিজ বাসভবনে রয়েছেন। স্ট্রোক করায় তিনি গুারুতর অসুস্থ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিতর্কিত একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ‘দিনের ভোট রাতে’ করার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। নির্বাচন পরিচালনা করেন সাবেক আমলা তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। ফলে নির্বাচনের পর থেকে নুরুল হুদাকে ‘রাতের ভোটের’ সিইসি বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। এছাড়া নানা কারণে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের সদস্যদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়িও ছিল তীব্র।

গত ২২ জুন রাজধানীর উত্তরার একটি বাড়ি থেকে সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেন স্থানীয় জনতা। পরে বিএনপির করা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। নুরুল হুদাকে গ্রেফতারের পর তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। নেটিজেনরাও সাবেক এ সিইসির কর্মকা-ের তীব্র সমালোচনা করছেন। কেউ কেউ তার সে সময়ের নানা বক্তব্য-বিবৃতি নিয়ে হাসি-ঠাট্টায়ও মেতেছেন। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় ও একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদর মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করে ‘আমি-ডামি’ ভোট উপাধি পায় কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। এ কমিশনারের বেশির ভাগ কার্যক্রম নিয়েই হয়েছিল চরম বিতর্ক। ওই নির্বাচনে ভোটের হার নিয়েও বড় ধরনের বিতর্ক হয়। ভোটের দিন বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ ভাগ ভোট পড়ে বলে জানানো হলেও এক ঘণ্টার ব্যবধান ভোট পড়ার হার বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ দেখানো হয়। অবশ্য ভোটের হার ঘোষণার সময় সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রথমে ২৮ শতাংশ ভোট পড়ার কথা বলে পরে তা সংশোধন করে ৪০ শতাংশের কথা বলেন। ‘আমি-ডামি’ হাবিবুল আউয়াল রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নিভৃতে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি বাসা থেকে খুব একটা বের হন না।

তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী স্বৈরাচারকে প্রতিষ্ঠিত, প্রলম্বিত ও বৈধতা দেয়ার দায়ে সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বিএনপি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন মামলার আসামি। আসামিরা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে ভয়ভীতি দেখিয়ে জনগণের ভোট ছাড়াই নির্বাচন করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। বলা বাহুল্য, সব নষ্টের মূলে যে তিন নির্বাচন কমিশন, তাদের প্রধানসহ সব সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যের বিরুদ্ধে অনেক আগেই মামলা করা উচিত ছিল। আশা করা হয়েছিল, অন্তর্র্বর্তী সরকারের তরফে মামলা দায়ের করা হবে। সরকার তা করেনি।

তিন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ছিল প্রচ-। পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন ভোটারবিহীন, ভুয়া, পরিকল্পিত ও চক্রান্তমূলক হওয়ায় জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দেশের মালিক হয়েও পছন্দের শাসক বা সরকার নির্বাচন করতে পারেনি। অন্যদিকে, এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার তার অবস্থান ও শক্তি বৃদ্ধি করেছে, নিজেকে বেপরোয়া করে তুলেছে। বিগত সাড়ে ১৫ বছর দেশে অনাচার, অবিচার, অত্যাচার, নির্যাতন, গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, রাষ্ট্রীয় অর্থের লুট ও পাচারসহ যত অন্যায় কাজ হয়েছে, তার জন্য পতিত ও বিতাড়িত স্বৈরাচার এককভাবে দায়ী। আর এ স্বৈরাচারকে ক্ষমতায় রাখার বৈধতা দিয়েছে কথিত তিন নির্বাচন কমিশনার। স্বৈরাচার দেশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দিয়েছে। গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে, রাজনৈতিক অধিকার অগ্রাহ্য হয়েছে, সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। সংবিধান ইচ্ছামতো কাটাছেড়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়েছে। বিচার বিভাগ, পুলিশ ইত্যাদি দলীয়করণ করে অকার্যকর করা হয়েছে। মিডিয়াকে সম্পূর্ণ করায়ত্ত করা হয়েছে। সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে ফেলা হয়েছে। দেশকে কার্যত ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা হয়েছে। স্বৈরাচার একদিনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। দিনে দিনে তার প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। আওয়ামী স্বৈরাচারের বেড়ে ওঠা, বৈধতা ও প্রতিষ্ঠা লাভের পেছনে সবচেয়ে নিয়ামক ও কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন তিন নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন কমিশনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, যার সিদ্ধান্ত ও কর্মের সাথে শাসক বা সরকার নির্বাচনের সম্পর্ক ওতপ্রোত, তার জবাবদিহি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্যই তিন নির্বাচন কমিশনের সব সদস্য ও সংশ্লিষ্টদের বিচার করে আইন মোতাবেক শাস্তি দিতে হবে। ভবিষ্যতের যেকোনো নির্বাচন কমিশনের জন্য এটি হবে একটি সতর্ক বার্তা ও শিক্ষা। নির্বাচন কমিশন নির্বাহী বিভাগের এক্সটেনশন বা বারান্দা, এ ধারণা ভাঙার সময় এসেছে এবং অবশ্যই তা ভাঙতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক।