॥ অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান ॥

সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হলো অধিক নিরাপদে স্বাচ্ছন্দে ভারসাম্য নিয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন। একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ, দেশ ও বিশ্বকে কল্যাণময় করতে সংস্কৃতির ভূমিকা অনেক। সংস্কৃতি হলো সে সমষ্টি যা জ্ঞান বিশ্বাস, নৈতিকতা, আইন, রীতিনীতি, দক্ষতা, শিল্পকলা, অভ্যাস, পরিশীলিত আচা-আচরণ ও দেহ। মন ও আত্মার সুকোমল অভিব্যক্তি কথা, ধ্বনি, যন্ত্রধ্বনি, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক প্রচার মাধ্যম এর সমষ্টি।

ইংরেজি Culture এর বাংলা প্রতিশব্দ সংস্কৃতি। কালচার অর্থ বর্ষণ বা কালটিভেশন অর্থাৎ অনাবাদী অনুর্বর জমি কালচারের উপাদান নয় যে জমি কর্ষণের মাধ্যমে কোন কিছু উৎপাদনের উপযোগী হয়, তখন সেটা কালচারের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। ভাষা, সাহিত্য,জ্ঞান, বিজ্ঞান,প্রযুক্তি, প্রজ্ঞা, মূল্যবোধ এসবই সংস্কুতি। প্রচলিত অর্থে গান, বাজনা, ক্রীড়া-কৌতুক, আনন্দ উৎসব, শিল্পকলা, বিচিত্রানুষ্ঠান,সংগীতানুষ্ঠান, নাটক, চলচ্চিত্র, রেডিও, টেলিভিশন ইন্টারনেটের নানাবিধ চিত্তবিনোদন মূলক ব্যাবহারকে সংস্কৃতি হিসেবে পরিগণিত হলেও আদতে এগুলো সংস্কৃতির প্রশাখা মাত্র। মূলত সংস্কৃতির মূলকা- ও শাখার বিস্তৃতি আরও ব্যাপক। যেমন- জীবনধারা, মননশীলতা, বিশ^াস, নৈতিকতা, সভ্যতা বিকাশের মানসিক ও বস্তুগত প্রকাশ ভঙ্গির সমন্বয়। দয়া-মায়া, প্রেম-প্রীতি, ¯েœহ-ভক্তি, সৌজন্যতা, শালীনতা, কল্যাণকামীতা,আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, চলন-বলন, শিল্প- নৈপূণ্য, মানবিক দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ, সাম্য-মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব, দেশপ্রেম, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার মানসিকতাই সংস্কৃতির বুনিয়াদী শিক্ষা।

সংস্কৃতি এমন এক অস্ত্র যা দিয়ে খুব সহজে একটি দেশের মানুষের মন ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা যায়। সংস্কার থেকে সংস্কৃতি শব্দের সূচনা। যার অর্থ উৎকর্ষ সাধন, উন্নতি বিধান, ত্রুটি বা অপূর্ণতা সংশোধন। সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতি ও চিন্তার উন্নতি ও পরিশুদ্ধি এবং নৈতিকতা এবং সভ্যতার পরিপূর্ণতা বিধান করা। সংস্কৃতি এখন দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পরেছে। পৃথিবীর বহুদেশের মানচিত্র বিভাজন হয়েছে ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতাকে কেন্দ্র করে। ডান আর বাম ধারার সংস্কৃতির শ্রেণি সংগ্রাম থেকে একটি দেশের মানচিত্র বিভাজন হতে পারে। অথচ সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির ভাবধারা চাপিয়ে দেয়া ষড়যন্ত্র সারাবিশে^ চলমান। সংস্কৃতি কেবল গায়িকার সুরে, নায়িকার নিক্কনে, বাদ্যযন্ত্রের ঝংকারে, কুস্তিগীরের পেশীতে, খেলোয়াড়ের ক্রীড়ানৈপুণ্যে, কবি-সাহিত্যিকের প্রতিভা প্রকাশে, ধর্মীয় নেতার আলোচনা, কথা শিল্পীতে সীমাবদ্ধ নয়, এসবের সমন্বিত রঙ্গে যে জীবন-প্রকৃতি সাজ-সজ্জায় সুশোভিত আলপনায় উন্মোচিত। বিকশিত বিবেক বোধের বুনিয়াদী স্বর্ণদুয়ার হলো সংস্কৃতি। সুতরাং সংস্কৃতি প্রতিটি মানুষের জ্ঞানালোকের আধুনিক কর্মযজ্ঞের দিকদর্শন এবং জীবনের অভিব্যক্তির একান্ত অনুসঙ্গ বিষয়। যে সব সংস্কৃতি মানুষকে সভ্য করে সেটিই হল আসল সংস্কৃতি আর যে সংস্কৃতি মানুষকে অসভ্য করে সেটিকে সংস্কৃতি না বলে অপসংস্কৃতি বলাই শ্রেয়। সুতরাং অপসাংস্কৃতি কোন সভ্য মানব জাতির কাম্য হতে পারে না।

আমাদের সুস্থ ও বিবেক সম্পন্ন মানুষের সারা জীবন এটি মনে রাখতে হবে, “পাপের আনন্দের চেয়ে পূণ্যের মহৎ বেদনা অনেক উত্তম”। এটি কেবল একটা শান্ত¡না নয় এর পুরস্কার প্রাপ্তির আগাম ঘোষণা বিদ্যমান রয়েছে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে। আমাদের আরও মনে রাখতে হবে, দুনিয়াতে অসৎ পথে যত মজা করবো, পরকালে ততই সাজা পাবো। সংস্কৃতির আবির্ভাব শুধু বিনোদন নয়, এতে মানসিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও শারীরিক যোগ্যতা ও সুস্থতার বিষয়সমূহ এর মৌলিক উপাদান। অপরদিকে সাবলিন বিনোদনের বিপরীত মানবকূলের অকল্যাণকর প্রচলিত সংস্কৃতিই হলো অপসংস্কৃতি। যার প্রভাবে চিত্তবিনোদনের নামে মানবসমাজ বিবেকবর্জিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। অদৃশ্য অশরীরি শয়তান ও তার দোষররা এ ধরণের অপসংস্কৃতি চর্চার প্রনোদনা দিয়ে মানব সমাজকে পথভ্রষ্ট করে থাকে। সুতরাং এদর ষড়যন্ত্র থেকে সুলীলসমাজ ও সচেতন মানুষকে সাবধান থাকা অনষিকার্য।

সম্প্রতি আমাদের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের মাসব্যাপি লোককারুশিল্পমেলা ও লোকজ উৎসবের এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন, ‘আমাদের ধর্ম আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়’। তিনি একজন মুসলমান হয়ে এটা বলে মূলত ইসলামকে সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। মূলত যুগ যুগ ধরে জীবন-দর্শন, জীবন-প্রকৃতি ও ধর্মচর্চার প্রতিপালিত নিয়ম-নীতির সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করার ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য এ বিষয়টি নিয়ে গত ২১ জানুয়ারী ২০২৫ তারিখে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় একটি জ্ঞানগর্ব সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটি দেশ-বিদেশের পাঠক সমাজে ও সচেতন সুধী মহলে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

ইসলাম হলো সর্বজনীন সর্বকালের সর্বযুগের সকল মানুষের জন্য নিরাপদ জীবনাদর্শ। তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত, তামান্না, তাক্ওয়া, জান্নাত ও জাহান্নাম এই বয়েকটি বিষয়ের মধ্যে ইসলামের সংস্কৃতির সৌন্দর্য় বিকশিত হয়ে থাকে। ইসলামের তাহজীব-তামাদ্দুন তথা সভ্যতা সংস্কৃতিকে পরিত্যাগ করে কোন সংস্কৃতিই সর্বজনীনভাবে নিরাপদ ও কল্যাণকর নয়। ইসলাম মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষথেকে নাযিলকৃত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এখানে মানব জীবণের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, দর্শন, সভ্যতাসহ এমন কিছু অবশিষ্ট নেই যা আল কুরআনে বর্ণিত হয়নি। আসলে অধিকাংশ মানুষই কুরআনকে যেভাবে অধ্যয়ন করার কথা বলা হয়েছে সে হক আদায়ের মতো অধ্যয়ন করি না বা করার মতো যোগ্যতার দৈণ্যতা রয়েছে।

পৃথিবীর সব ধরনের যোগ্যতা অর্জিত হলেও যে ব্যক্তি আল কুরআনের ভাব, ভাষা, জ্ঞান ও উদ্দেশ্য-লক্ষ্য সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারনা নেই সে ব্যক্তি এখনও পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হতে সক্ষম হতে পারেননি। কুরআন একটি মহাগ্রন্থ, যাতে পৃথিবীর এমনকোন বিষয় ইন যা বর্ণিত হয়নি। এটি সর্বকালের সর্বযুগের মানুষের কল্যাণের জন্য আবির্ভূত হয়েছে। মানূষ যদি এ জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারনা অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং সে আদেশ-নিষেধ ও উপদেশ মেনে চলতে পারে, তবেই পৃথিবীর জমিনে মহাশান্তির সভ্যতা ও সংস্কৃতির পুলকধারার সুবাতাস বইতে শুরু করবে। ইসলাম অন্যান্য ধর্মের ন্যায় পুঁজা, অর্চনা ও উপাসনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং ইসলাম হলো একটি নিরাপদ জীবনাদর্শ। যে ইসলাম একটানা ৫‘শ বছর অর্ধ পৃথিবী শাসন করে প্রমাণ করেছে, যা অন্যকোন ধর্ম প্রমাণ দিতে পারবে না।

প্রচলিত অর্থে নাচ-গান, নাটক, যাত্রা চিত্রকলা বা বিনোদনকে বোঝানো হয়ে থাকে। আদতে এটা পুরোপুরি সত্য নয় । সংস্কৃতি মূলত: মানবজীবনের শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ, চাল-চলন, কথা-বর্তা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি-রাজনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ বিনোদন, সৃজনশীলতা এবং যুদ্ধ বিগ্রহ, নিয়ম-অনিয়মের সকল বিষয়াদীর ব্যখ্যাা বিশ্লেষণ, ব্যবহার ও প্রয়োগ পদ্ধতিই সংস্কৃতি।সংস্কৃতি শব্দের উৎপত্তি সংস্কার থেকে। সংস্কার অর্থ বিশুদ্ধিকরণ।

একটি জাতিকে সহজেই চেনার সহজ উপায় তিনটি, ১. শিক্ষা ২. সভ্যতা, ৩. সংস্কৃতি। এ তিনটি উপাদানের রুপচিত্র যতটা উন্নত, সে জাতি ততটাই উন্নত। একটি জাতির শিল্প -সাহিত্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি জীবনাচরণ, চলাফেরা, ওঠাবসা, সততা, সদাচার, পোশাক পরিচ্ছেদ, ভাষার ব্যবহার, মানবিক স্বভাব থেকে শুরু করে জাতীয় চিন্তা- চেতনা, ভাবধারা, দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছবিই হলো বুনিয়াদী টেকসই সভ্যতার মাপকাঠি। যে জাতির জীবন-প্রকৃতি যত উন্নত, সে জাতি ততই উন্নততর সভ্যশৈলীর অধিকারী। যে সমাজে, যে দেশে এ সব গুণাবলীর অধিকারী মানুষ যত বেশি, সে জাতি মানবতা ও মানবাধিকার অটোভাবেই লাভ করে থাকে। আর এভাবেই প্রতিষ্ঠিত ও বিনির্মাণ হয় নিরাপদ সোনালী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

সর্বোপরি শিক্ষা ও সাংস্কৃতির লক্ষ্য হল মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর নির্দেশিত পদ্ধতিতে দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করা। শিক্ষা যেমন একজন মানুষকে বিনয়ী, কোমল হৃদয়, ধৈর্য্যশীল করে গড়ে তোলে তেমনি অন্যায়, অবিচার মূলক কোন কাজ করা দেখলে কৌশলগতভাবে তীব্র প্রতিবাদী ও চরম কঠোর হয়ে ওঠে, এমন কী সে অন্যায় প্রতিরোধ করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে শহীদের মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে একদম দ্বিধা করে না এটাও শুদ্ধ সংস্কৃতি। সুস্থ্য সংস্কৃতির আর একটি উদাহরণ হলো ‘আবেকের ঘোড়া যত দ্রুতই ছুটুক- বিবেকের লাগাম তাকে পড়াতেই হবে; এক্ষেত্রে বলা যায় যে, সংস্কৃতির নামে আগ্রাসী সংস্কৃতির অপতৎপরতা নিরবে মৌল সংস্কৃতির উপর প্রভাব ফেলছে, সেটি হল প্রকাশ্যে ধুমপান, মদ্যপান, নেশাদ্রব্য সেবন ও গ্রহণ করে মাতলামী করা, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নোংরামী কর্মকা- করা, ইভটিজিং, ছিনতাই, রাহাজানি, বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা, সহশিক্ষা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, অবৈধপ্রেম করে দৈহিক, বিজাতীয় পোশাক-পরিচ্ছেদ, দাড়ি-গোফ- লোম পরিপাটি না করা, নগ্নদেহ প্রদর্শন, বহুগামিতা অশ্লীল ম্যাগাজিন পাঠ, ছবি দেখা, কুচিন্তা, হস্তমৈথুন, অবাধ মিলন, দলবেঁধে ধর্ষণ, অন্যায়ভাবে খুন, গুম করা ইত্যাদি।

মদের বার, সিনেমা হল, নাটক, যাত্রাপালা, সিনেমা এমন কী নিষিদ্ধ ভবন উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে অনেক ক্ষেত্রে মিলাদ পড়ানোর রেওয়াজ, শহীদ মিনারে চলছে নাচ-গানের আসর, এসব কী শুদ্ধ সংস্কৃতি? দিয়াশলাই, আগ্নেয়াস্ত্র, মোবাইল, কলম, ধাতবদ্রব্য, ভেষজদ্রব্যের অপব্যবহার মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই বয়ে আনছে। অনুদান, ধর্মীয় উপাসনা, রাজনৈতিক কর্মকা- প্রদর্শনেচ্ছা ও স্বার্থবাদিতার সংস্কৃতির চর্চা যারা করেন,আদতে তারা সংস্কৃতির নামে অপসাংস্কৃতির ধারক-বাহক, প্রচারক ও প্রতারক। আদতে সুস্থ্য সংস্কৃতিতে অপসাংস্কৃতির অশ্লীলতার কোন স্থান নেই। ধর্ম ও দর্শনের ভিত্তিতে যে শিল্প-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির শুদ্ধ স্বরুপ বিকশিত ও প্রকাশিত হয়, সেটিই মূলত মানব জাতির সভ্যতা ও কল্যাণের সংস্কৃতি। এ ধরণের সুস্থ ধারার সংস্কৃতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে উদাসীনতা মানে নিরবে জনবিবেক হত্যার করে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণের পথ সুগম করা। লেখক: সাংবাদিক।