॥ আলী আহমদ তাহ্কীক ও মোহাম্মদ মামুনুর রহমান ॥

জুলাই কন্যারা কী চাপা পরে গেল শিরিন কমিশন প্রতিবেদনে? এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন-এর প্রতিবেদন দেখে। ইতিহাসের পাতা থেকে জুলাই বিপ্লবে নারীদের আবদান ধুয়ে-মুছে ফেলা হল। বিপ্লবীরা কিভাবে দাবি করবে জুলাই আন্দোলনে ১১ জন নারী শাহাদাত বরণ করেছে। রক্তের দাগ শুকানোর আগেই লাখ লাখ নারীর কঠিন সংগ্রামকে অস্বীকার করা হল। বাংলার বাঘিনী বলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যাদের খেতাব দেওয়া হল। কমিশন কেন তাদের মুছে ফেললো। নাকি কমিশন সদস্যদের অভিধানে জুলাই বিপ্লব বলে কোন কিছু ছিল না ?

বিপ্লবোত্তর নোবেল বিজয়ী মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আমরা এক সুবর্ণ সময় পার করছিলাম। ইসলামপন্থীরা তার নেতৃত্ব খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিলেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের আলেমরা প্রায় প্রতিটি মাহফিলে সরকার প্রধানের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করছিলেন। যেটা ৫০ বছরের ইতিহাসে অনেকটা বিরল। ড. ইউনুস আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু নারী কমিশন-এর প্রতিবেদনটিতে তথাকথিত উগ্র-নারীবাদী ও নাস্তিকদের পরামর্শক্রমে কিছু বিতর্কিত সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করায় ঐক্যের দেয়ালটা ধসে পরার উপক্রম হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এটি যারা করেছেন। অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন। বিগত ৮ মাসে নারীর অধিকার নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে আলেম সমাজ অনেকটা ইতিবাচক ছিলেন। সাম্প্রদায়িক বিরোধ নিরসনে তারা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন । রাতের পর রাত হিন্দু মন্দির পাহারা দিয়েছে। ৩০০ আসনে নারী সদস্য মনোনয়নে বা রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে নারী নেতৃত্ব বিষয়ে তাদের নীরব সমর্থন ছিল। আমরা দেখেছি, নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে নারীর অবস্থা ও অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়ে ইসলামপন্থীদের ইতিবাচক অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। এ অবস্থায় নারী ক্ষমতায়নের অনেক কৌশলগত বিষয়কে এগিয়ে নেওয়ার এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিল। কিন্তু যারা বিতর্কিত ধর্মীয় বিষয় উত্থাপন করে নারী কমিশন-এর পুরো প্রতিবেদনটি প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন। দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছেন। তাদের উদ্দেশ্য সন্দেহজনক। আপাতদৃষ্টিতে দেশের আলেম সমাজ-এর সাথে সরকারের দূরত্ব তৈরি করার জন্যে এটি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

দেখা যাক প্রতিবেদনে কী আছে। একাত্তরের নারী আন্দোলনকারীদের বীরাঙ্গনা উপাধি ও স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন সুবিধাদির বিষয়ে তাদের কথা অন্তত ১৭ বার প্রতিবেদনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের নারীদের অবদান আমরা সবসময় শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই। কিন্তু এখন যাঁদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে এ প্রতিবেদন লেখা হচ্ছে, তাঁরা কেন উপেক্ষিত। ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবের নির্যাতিত নারীদের কথা একবারও উল্লেখ করা হয়নি। বিষয়টি উদ্বেগের। প্রতিবেদনটি পড়তে গেলে মনে হতে পারে আমরা ১৯৯২ সালের প্রতিবেদন পড়ছি। পরিকল্পিতভাবে ২০২৪-এর নারী যোদ্ধারা উপেক্ষিত হল প্রতিবেদনে। যেখানে ১১ জন নারী শাহাদাতবরণ এবং শত শত নারী আহত হলেন। না আছে তাঁদের স্বীকৃতির দাবি, না আছে চিকিৎসার দাবি। কথা হচ্ছে ২০২৪-এ যে নারীরা রাস্তায় নেমেছিল এরা কারা ? এরা কি নারী ? যাদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে প্রতিবেদন তাঁদের কিভাবে উপেক্ষা করা হল? এর দায়ভার কি শুধুই কমিশিন-এর সাথে সংশ্লিষ্ট সদস্যরা। না উপদেষ্টাও কিছু দায়ভার নিবেন।

প্রতিবেদনের ১.২ অধ্যায়ে (পৃষ্ঠা ২২) বলা হয়েছে ১৯৯২ সালের জাহানারা ইমাম-এর নেতৃত্বে নারী আন্দোলনের সফলতা পেয়েছে ২৯ জানুয়ারি ২০১৫ সালে [ফ্যাসিস্ট হাসিনার হাতে] গেজেটের মাধ্যমে। এতে কী বার্তা দিতে চেয়েছেন ? প্রতিবেদন পড়ে মনে হচ্ছে বিগত ১৫ বছরে তথাকথিত নারীবাদীরা স্বর্গে বাস করছিলেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পলাতক হাসিনার গৃহীত সকল নীতির প্রশংসা করেছেন এবং তার বাস্তবায়ন চাচ্ছেন । ছাত্রলীগ নেতাদের শততম ধর্ষণ উদযাপন নিয়ে কোনো প্রসঙ্গ উল্লেখ তো দূরের কথা জুলাই-এ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রীরা ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীর হাতে রক্তাক্ত হলেন তার কোনো বর্ণনা নেই।

এরা নারী ক্ষমতায়ন বলতে কি বুঝতে চেয়েছেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আছে শুধু কিছু উস্কানিমূলক এজেন্ডা। যা প্রকৃতঅর্থে নারী ক্ষমতায়নের সাথে সাংঘর্ষিক। সুপারিশ ৩.২.১.৪ এ সিডও এর ধারা বাস্তবায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে। সিডও ১৯৮৪ সালেই স্বাক্ষর করে সরকার। তবে এর কিছু ধারা যেমন ধারা- ২; ১৩ (এ ); এবং ১৬ (১.সি, এফ ) সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে যা আমেরিকাসহ পৃথিবীর বহু উন্নত দেশ এখন পর্যন্ত মোটেই স্বাক্ষর করেনি। সুপারিশ ৬.৩.১.১ এ ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড বা সর্বজনীন পারিবারিক আইন আনা হয়েছে। কোন মুসলিম দেশ তো দূরে থাক ভারতের মত হিন্দু অধুষ্যিত দেশেও এটি অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয় । অপ্রাসঙ্গিকভাবে ৯.৩.১.১ এ ২০১০ সালের কথিত শিক্ষানীতির কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে হাসিনার প্রণীত বিতর্কিত নারী নীতি ২০১১ সহ বিভিন্ন নীতির বাস্তবায়ন চায়। তেমনিভাবে ৯.৩.১.৩ তে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বাধ্যতামূলক যৌন শিক্ষার অন্তর্ভুক্তিকরণ সুপারিশ করা হয়। যা পশ্চিমা রীতিতেও বাধ্যতামূলক নয়। সুপারিশ ১২.৩.১.১ যৌন কর্মীদের স্বীকৃতির দাবির মধ্যমে নারীর চরম অবমাননা হয়েছে । তেমনিভাবে ধর্ষণ এবং ধর্ষকের বিচার নিয়ে কিছু আসেনি। প্রতিবেদনের ১৪ নম্বর পাতায় দাবি করা হয়েছে দেশে বর্তমানে ১১.৮ কোটি উদ্যোক্তার মধ্যে ৭.৮ ভাগ নারী উদ্যোক্তা। সংখ্যাটি যে কাউকে অবাক করবে। বর্তমানে কর্মক্ষম জনসংখ্যার চেয়ে উদ্যোক্তা বেশি! তথ্যসূত্র ছাড়া এরকম বহু অবাস্তব পরিসংখ্যান প্রতিবেদনের পাতায় পাতায় রয়েছে।

হুলুদ রং এর প্রচ্ছদে জাতীয় শহীদ মিনারে কিছু বিমূর্ত পুরুষের মিছিল দেখা যাচ্ছে। রিপোর্টটা উৎসর্গ করা উচিত ছিল জুলাই বিপ্লবের নারী শহীদের। কিন্তু করা হয়েছে হাসিনার পৃষ্ঠপোষক হিসাবে পরিচিত আয়েশা খানমকে। যিনি সারাজীবন ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে হাসিনার পক্ষ হয়ে উগ্রনারীবাদীর মত ধর্মকে নারী ক্ষমতায়নের অন্তরায় হিসাবে বয়ান করেছেন। যার মৃত্যুতে হাসিনা অতিমাত্রায় শোকাহত হয়। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে শেষ পাতা পর্যন্ত কোথাও ’২৪ নারী আন্দোলন কিংবা জুলাই বিপ্লবের কোন ছিটেফোঁটা দেখা মিললো না। ’২৪কে ধারণ করা তো দূরের কথা। এটাকে পরিকল্পিতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। উপরšুÍ অপ্রাসঙ্গিকভাবে সামনে আনা হয়েছে ’৯২ এর নারী আন্দোলনকে ।

নারীর ক্ষমতায়ন বলতে এরা কী বুঝাতে চেয়েছে ? সেটা বুঝার চেষ্টা করলাম। শতভাগ আসনে নারী বসিয়ে দিলে কি নারীর ক্ষমতায়ন হবে? টানা ১৫ বছর নারী প্রধানমন্ত্রী থাকার পরও তবে তা কেন হল না? নারীকে আসনে বসিয়ে দিলেই নারীর ক্ষমতায়ন হয় না। এটা প্রমাণিত। যেটা বলা দরকার ছিল তা হচ্ছে “জেন্ডার সংবেদনশীল সাংসদ”। উচিত দাবি হতে পারতো ৩০০ এ “জেন্ডার সংবেদনশীল” সংসদ সদস্যের মনোনয়ন চাই । নারী হলেই জেন্ডার সংবেদনশীল হবে এমন দাবি পৃথিবীর কোন নারীবাদী করে না। সেটি সংবেদনশীল মেয়ে বা ছেলে উভয় হতে পারে। মজার বিষয় হচ্ছে, যে প্রক্রিয়ায় নারী সদস্যের নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে তাতে হাসিনার মত অনেক ফ্যাসিস্ট নারী যে ফিরে আসবে তা অনেকটা নিশিচত করে বলা যায়। ধর্ষক বা কোনো নারী নির্যাতনকারী ব্যক্তি যেন সংসদে আসতে না পারে, রিপোর্টে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব।

যাইহোক, জুলাই কন্যাদের অবদানকে অস্বীকারকারী নাস্তিক আর উগ্র নারীবাদীদের অবাস্তব সুপারিশমালা নিয়ে আমরা কতদূর যেতে পারবো। নারীর ক্ষমতায়নের জন্যে যারা কাজ করে তাদের মতে, “শিরিন কমিশন প্রতিবেদন বাংলাদেশের নারীদের শুধু অবমূল্যায়নই নয় বরং নারী আন্দোলনকে অন্তত আরও ৫০ বছর পিছিয়ে দিল”।