DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

পাঠকের অভিমত

জাতীয় সংসদে আলেমগণের ভূমিকা

আমাদের দেশে সাধারণত আলীয়া কারিকুলামে কামিল এবং কওমীতে দাওরায়ে হাদিস পাস করলে তাদেরকে আলেম বলা হয়। আমাদের দেশের রাজনীতি-সমাজনীতিতে আলেম সমাজ বেশ পিছিয়ে। এর মাঝেও কোন কোন মাওলানা সমাজ ও রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

Printed Edition

॥ হামদুল্লাহ আল মেহেদী ॥

আমাদের দেশে সাধারণত আলীয়া কারিকুলামে কামিল এবং কওমীতে দাওরায়ে হাদিস পাস করলে তাদেরকে আলেম বলা হয়। আমাদের দেশের রাজনীতি-সমাজনীতিতে আলেম সমাজ বেশ পিছিয়ে। এর মাঝেও কোন কোন মাওলানা সমাজ ও রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭৯’র ২য় সংসদে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান কলকাতা আলীয়া থেকে কামিল পাস করেছিলেন। নামের সাথে মাওলানা না লাগালেও এ মাওলানা সাহেব সংসদ ও দেশ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ঐ সময়ের সংসদে আরো ৩ জন মাওলানার ভূমিকা স্মরণীয় থাকবে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন আইডিএলের (জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত) মাওলানা আবদুর রহিম (রাহি:)। যিনি একজন বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ এবং পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে সাহসিকতার সাথে, অথচ অত্যন্ত বিনয়ীভাবে সংশোধনের উদ্দেশ্যে সরকারের সমালোচনা করতেন।

আইডিএলের (জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত) আরেকজন সদস্য মাওলানা আবদুস সোবহান। তিনিও যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন। বিএনপির এমপি জমিয়তুল মোদাররেছিনের সভাপতি মাওলানা এম এ মান্নান মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে যথেষ্ট কাজ করেছিলেন। মাওলানা এম এ মান্নান প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সময় ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৬ সালে এমপি হয়ে এরশাদ সরকারের ধর্মমন্ত্রী হন। তিনি ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বও সফলতার সহিত পালন করেন।

ঐ সময় মাওলানা এম এ মান্নান অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে দিয়ে করান। মাদ্রাসার পূর্ণাঙ্গ এমপিওকরণ, দাখিল ও আলিমকে এসএসসি ও এইচএসসির সমমান প্রদান, রোববারের পরিবর্তে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডকে আধুনিকায়ন, মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার ইত্যাদি কাজ তাঁর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

তিনি দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠা করেন। ইনকিলাব জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থীদের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ইসলামের মূল চেতনাকে জাগ্রত করতে দৈনিক ইনকিলাবের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ কে এম মহিউদ্দিন সম্পাদক ও মাওলানা কবি রুহুল আমিন খান পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব অত্যন্ত আন্তরিকতা ও দক্ষতার সহিত পালন করতেন। ইনকিলাব হাউজ থেকে সাপ্তাহিক পূর্ণিমা বের হত। জনপ্রিয় সাপ্তাহিকীটিতে এ কে এম মহিউদ্দিনের ক্ষুরধার কলাম এখনও মনে রেখাপাত করে। মাওলানা এম এ মান্নানকে আলেমদের মধ্যে সমাজসেবা ও রাজনীতিতে অত্যন্ত সফলতম ব্যক্তি মনে করা হয়। তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন।

১৯৯১’র ৫ম সংসদে জামায়াতে ইসলামী ১৮ টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। এর মধ্যে সম্ভবত ১৪ জনই মাওলানা ছিলেন। জামায়াত সংসদীয় দলের নেতা ছিলে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। তাঁরা বিরোধী দলের হলেও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, ইসলামী তাহজিব-তামুদ্দুন পরিপালন ও সুস্থ রাজনৈতিক গতিধারার পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও বিএনপি ও ইসলামী ঐক্যজোট থেকে নির্বাচিত দু’জন মাওলানা শোভাবর্ধন ছাড়া কী করেছেন জানি না। কিশোরগঞ্জ-৩ এ বিএনপির মাওলানা আতাউর রহমান খান মাঝে মধ্যে মুনাজাত পরিচালনা করতেন। আর সিলেট-৫ এর ইসলামী ঐক্যজোটের এমপি মাওলানা ওবায়দুল হক সংসদে আসা যাওয়া ছাড়া তেমন কোন ভূমিকা ছিল না।

আলোচিত দু’জন মাওলানা ১৯৯৬ সালের ৭ম সংসদে ছিলেন। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পিরোজপুর-নাজিরপুর-ইন্দুরকানি থেকে শুধাংশু শেখর হালদারকে হারিয়ে নির্বাচিত হন। বিরোধী দলের এমপি (জামায়াত) হওয়ার কারণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে না পারলেও কিছু কর্ম ও বক্তব্যে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সংসদে প্রবেশের সময় মাথা নিচু করা শিরক- সেটা তিনি জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছিলেন এবং তিনি প্রবেশের সময় কখনো মাথা নিচু করেননি। শোক প্রস্তাবের পর ১ মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনের সময় সুরা ফাতিহা, ইখলাছ ও দরুদ শরিফ পাঠ করার প্রস্তাব তিনিই করেছিলেন।

মাওলানা নুরুল ইসলাম জামালপুরের সরিষাবাড়ী থেকে বিএনপি মহাসচিব ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদারকে হারিয়ে নির্বাচিত হন। তাঁকে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মাওলানায় সমৃদ্ধ সংসদ ছিল ২০০১ এর ৮ম জাতীয় সংসদ। উক্ত সংসদে যতদূর মনে পড়ে- জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট মিলে ১৭ জন মাওলানা এমপি ছিলেন।

এদের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী প্রথমে কৃষিমন্ত্রী পরে শিল্পমন্ত্রী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আব্দুস সোবহান সরকারি হিসাব সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হলে তিনি এ দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাঁরা ইসলাম, ইসলামী শিক্ষা ও মাদ্রাসার (আলীয়া-কওমি) উন্নয়নে যথেষ্ট পজিটিভ ভূমিকা রাখেন। যমুনা গ্রুপের এলকোহল মিশ্রিত পানীয় ক্রাউন ও হান্টার নিষিদ্ধকরণে জাতীয় সংসদে হুংকার দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও ফজলুল হক আমিনী।

উল্লেখ্য যে, মাওলানা এম এ মান্নান, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও মাওলানা আবদুস সোবহান নিজ নিজ এলাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে দ্বীনি ও আধুনিক ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, ইয়াতিমখানা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে একজন মহিলা হাফেজ-মাওলানা সদস্যও ছিলেন। ১৯৯১ সালের ৫ম সংসদে বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থনের বিনিময়ে জামায়াত দু’জন মনোনীত মহিলা এমপি পেয়েছিল, তাদের একজন ছিলেন আসমা খাতুন, যিনি হাফেজ এবং মাওলানা ছিলেন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ লেবার পার্টি।