পাঠকের অভিমত
মত অভিমত
হোমিওপ্যাথি কেন স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি
এখন থেকে দু’শতাধিক বছর আগে আবিষ্কৃত হয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞান। বিশ্বব্যাপী এ চিকিৎসা পদ্ধতিকে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হয়। আমাদের দেশের সরকার এ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রতি বছর প্রায় দু’শ’
Printed Edition
ডাঃ মোঃ নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া
এখন থেকে দু’শতাধিক বছর আগে আবিষ্কৃত হয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞান। বিশ্বব্যাপী এ চিকিৎসা পদ্ধতিকে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হয়। আমাদের দেশের সরকার এ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রতি বছর প্রায় দু’শ’ কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে। তবে দু:খের বিষয় হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চিকিৎসা ব্যবস্থা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা বিজ্ঞানকে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে স্বভাবতই এতে দেশের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সমাজ ক্ষুব্ধ। তারা চান তাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের কর্তৃত্ব তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক। এদেশের রোগার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হোক।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোগারোগ্যের সফলতা ১৯৮৪ সনে উপলব্ধি করেছিলেন বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক মরহুম ড. মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে স্বাস্থ্যখাত সংস্কারে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সমাজের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পৃঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করা রয়েছে। কিন্তু উক্ত প্রতিবেদনে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি কিংবা বিকল্প চিকিৎসা সেবা (এএসসি) সম্পর্কে কোন পদক্ষেপ নেই।
যদিও ২০১৫ সালের এক জরিপ অনুযায়ী দেশের প্রায় ৪০% মানুষ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকে। ১৯৮৩ সালে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেসরকারিভাবে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে এবং ১৯৮৯ সালে ঢাকার মিরপুরে সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (১০০ শয্যাবিশিষ্ট) প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখানে এমবিবিএস সমমানের বিএইচএমএস (ব্যাচেলর অফ হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন এন্ড সার্জারি) ডিগ্রি কোর্স চালু আছে। কোর্সটির মেয়াদ ১ বছর ইন্টার্নিসহ মোট ৬ (ছয়) বছর। এমবিবিএস এর ন্যায় কোর্সটির ভর্তি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশন। এছাড়া সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ৬৬টি বেসরকারি হোমিওপ্যাথিক ডিপ্লোমা মেডিকেল কলেজে ডিএইচএমএস (ডিপ্লোমা ইন হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন এন্ড সার্জারি) কোর্স চলমান। এ কোর্সটির মেয়াদ ৬ মাস ইন্টার্নিসহ মোট সাড়ে ৪ (চার) বছর। বর্তমানে দেশে প্রায় ২৪০০ (চব্বিশ শত) রেজিস্টার্ড বিএইচএমএস এবং ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) ডিএইচএমএস রেজিস্টার্ড চিকিৎসক আছে। এছাড়া রেজিস্ট্রেশন বিহীন আছেন আরও প্রায় কয়েকগুণ। যারা দেশের মানুষকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়ের অধীনে বিকল্প চিকিৎসা সেবা (এএমসি) হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে ১৯৭২ সালে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার অভিভাবকত্বের লক্ষ্যে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিশনার্স অধ্যাদেশ জারি হলে বোর্ডটি স্বায়ত্তশাসনের অধীনে আসে। ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক প্রাকটিশনার্স অধ্যাদেশ ১৯৮৩ রহিতকরণ করে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা আইন ২০২৩ সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয় এবং ১৩ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে আইনটি বাংলাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ড হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিলে পরিণত হয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে উক্ত কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং রেজিস্ট্রার উভয়েই যথাক্রমে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও উপ-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং কাউন্সিলের অতিরিক্ত দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। এখন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সমাজ আশা করছে, সরকার অনতিবিলম্বে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের সমন্বয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানসহ পূর্ণাঙ্গ কাউন্সিল গঠন করে প্রকৃত অংশীজনদের নিকট হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।
এখানে সকলের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করা যেতে পারে, সুস্থ মানবদেহে ঔষুধের লক্ষণ উৎপাদন ক্ষমতা পরীক্ষিত, ক্ষুদ্রতর থেকে ক্ষুদ্রতম মাত্রা অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্রতম মাত্রায় ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব অনুযায়ী শক্তিকৃত ওষুধের উৎপাদন ক্ষমতার সাথে রোগীর নিকট থেকে প্রাপ্ত লক্ষণের সদৃশ, সূক্ষ¥মাত্রায় ১টি মাত্র ঔষধে চিকিৎসা পদ্ধতির নাম হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি।
কিন্তু প্রকৃত হোমিওপ্যাথরা দায়িত্বে না থাকায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ও শিক্ষা বেহাল দশায় রয়েছে। ফলে সুস্থ মানবদেহে পরীক্ষা ছাড়াই প্রস্তুতকৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষধের নামে তথাকথিত ঔষধ নামীয় পেটেন্ট, টনিক, মিকচার বাজারজাত করে আসছে তথাকথিত ঔষুধ ব্যবসায়ীগণ। যা আদৌ হোমিওপ্যাথিক ঔষুধ হতে পারে না। তাছাড়া রোগীকে এক সময়ে ১টি মাত্র ঔষধ প্রয়োগের বিধান থাকলেও হোমিওপ্যাথির নামে একই সময়ে একাধিক ঔষুধ একসাথে প্রয়োগ করা হচ্ছে। তাতে জনসাধারণ এবং অসুস্থ মানুষ অর্থনৈতিক এবং রোগজ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ সমস্ত অবৈধ কর্মকাণ্ড দেখভাল করার সরকারি কোন প্রতিষ্ঠান নেই। ওষুধ সূক্ষ্ম মাত্রায় ব্যবহারের পরিবর্তে বৃহৎ মাত্রায় ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকিস্বরূপ। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্থ হচ্ছে মেটেরিয়া মেডিকা, অর্গ্যানন অব মেডিসিন এবং ক্রনিক ডিজিজ ইত্যাদি। এসব মৌলিক গ্রন্থের অনুসরণে ঔষুধ নির্বাচনে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার অতীব জরুরি।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য নিম্নের প্রস্তাবনাগুলো স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনে অন্তর্ভুক্তির জন্য একান্ত অনুরোধ জানানো যাচ্ছে: ১) হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। ২) আইন অনুযায়ী পেশার সাথে সম্পৃক্ত চিকিৎসকদের সমন্বয়ে অতি তাড়াতাড়ি চেয়ারম্যানসহ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা কাউন্সিল গঠন করা হোক। ৩) হোমিওপ্যাথিক সেক্টরের সকল নিয়ন্ত্রক পদে পেশার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হোক। কাউন্সিলের প্রতিনিধি নির্বাচনে সরাসরি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকদের ভোটাধিকার দেওয়া হোক। ৪) সরকারি উদ্যোগে পূর্ণাঙ্গ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, হোমিওপ্যাথিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা, বিশেষায়িত হাসপাতালে হোমিওপ্যাথিক ইউনিটসহ পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা হোক। ৫) সকল হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে ইনডোর ও আউটডোর হাসপাতালে ইন্টার্নী চিকিৎসকদের ভাতা চালু এবং উচ্চ শিক্ষার অধিকারসহ ডিপ্লোমা চিকিৎসকদের পূর্বের ন্যায় বিএইচএমএস ৪র্থ বর্ষে ভর্তির সুযোগের ব্যবস্থা করা হোক। ৬) হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ সরকারিকরণ, হোমিওপ্যাথদের সনদের মান নির্ধারণ, ২০১২ সালের চিকিৎসক নিয়োগের স্থগিতাদেশ বাতিল এবং নিয়োগ বাস্তবায়ন করা হোক। ৭) রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টার ব্যক্তিগত চিকিৎসক, সকল সরকারি হাসপাতাল, পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, সিটি কর্পোরেশন, কমিউনিটি ক্লিনিক, দাতব্য চিকিৎসালয়, সশস্ত্র বাহিনী, কারাগার, পূণর্বাসন কেন্দ্র, হজ্জ যাত্রী স্বাস্থ্য সেবা নীতিমালা এবং বিসিএস (স্বাস্থ্য) সার্ভিসে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
৮) জনস্বার্থে অবিলম্বে পেটেন্ট-টনিক-মিকচারের অনুমোদন বাতিলসহ বিদেশ থেকে পেটেন্ট/ কম্বিনেশন আমদানি ও দেশীয় কম্বিনেশন বা মিশ্রণ ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ফার্মাকোপিয়ায় লিপিবদ্ধকৃত অর্গানন অব মেডিসিন, ক্রনিক ডিজিজসহ হোমিওপ্যাথির মৌলিক নীতিমালা পরিপন্থী সকল ধারা-উপধারা বাতিল করতে হবে। জনস্বার্থে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার নামে প্রতারণা এবং ঔষুধের অপব্যবহার বন্ধ করতে অভিযান চালুসহ হোমিওপ্যাথিক ঔষুধের নামে ভেজাল ঔষধ এবং রেকটিফাইড স্পিরিট বিক্রেতাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে। ৯) নিরাময় অযোগ্য রোগীদের প্যালিয়েটিভ সেবায় হোমিওপ্যাথদের যুক্ত করে গবেষণার দ্বার উন্মোচন এবং ড্রাগ ডিরেক্টরীসহ জাতীয় তথ্য বাতায়নে হোমিওপ্যাথি সেবা যুক্ত করতে হবে। ১০) হোমিওপ্যাথিক ঔষুধ মূলত এক প্রকার অদৃশ্য শক্তি। শক্তির কোন সৃষ্টি কিংবা বিনাশ নেই- আছে কেবল রূপান্তর। শক্তিকৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষুধের শক্তিকে পচনরোধক সুরাসারের মাধ্যমে বোতলে বাজারজাত করা হয়। এর আদৌ পচন বা কার্যকারিতা নষ্টের সম্ভাবনা নেই। সুতরাং শক্তিকৃত হোমিওপ্যাথিক ঔষুধের অযৌক্তিক মেয়াদকাল বাতিল করতে হবে। ১১) ড্রাগ লাইসেন্স (হোমিওপ্যাথি) নামে আলাদা ফরমেট চাই। রেজিস্টার্ড প্র্যাক্টিশনারদের নিজস্ব ফার্মেসীর ড্রাগ লাইসেন্স প্রথা বাতিল করতে হবে। লাগামহীন ঘুস-দুর্নীতি ও হয়রানি এড়াতে ড্রাগ লাইসেন্সের আবেদন ও নবায়নে শতভাগ অনলাইন সিস্টেম নিশ্চিত করতে হবে। ১২) সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রসার অত্যাবশ্যক। এমতাবস্থায় কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য বাজেটের ২০% অর্থ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নে বরাদ্দ চাই। ১৩) হোমিওপ্যথিক চিকিৎসক রেজিস্ট্রেশন নবায়ন প্রথা বাতিলসহ বিএমডিসি’র আদলে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক যাচাইকরণ ওয়েবসাইট চালু করতে হবে। সেসাথে মহান হোমিওপ্যাথিক পেশাকে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনে অন্তর্ভূক্তকরন এখন জাতীয় দাবী।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও চিকিৎসক।