॥ অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ ॥

দেশের উন্নয়নের স্বার্থে আমাদের সকলেরই উচিত দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং আইন মেনে চলা। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশে আইন আছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আছে, আদালত থাকলেও আইনের শাসন মানার সংস্কৃতি পুরোপুরি গড়ে উঠেনি। আইন না মানার কারণে সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। দেশের প্রচলিত আইন অমান্য করলে, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। কেউ যদি আইন মেনে না চলেন বা আইন ভঙ্গ করেন বা আইন ভঙ্গের হুকুম দেন তখন সমাজের, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় ও বি শৃঙ্খলা দেখা দেয়। সে আইন যদি সমাজের, দেশের কোনো জনপ্রতিনিধি বা নেতৃস্থানীয় কোনো ব্যক্তি ভঙ্গ করেন বা আইন ভঙ্গের হুকুম দেন তাহলে তা জনগণের মাঝে আরো নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষ আইনের প্রতি যথেষ্ঠ শ্রদ্ধাশীল নয় এবং তারা যখন ইচ্ছা তখন আইন অমান্য করে। সচেতনতার অভাব আর যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় সমাজে বাড়ছে আইন না মানার প্রবণতা। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণি-পেশার কিছু মানুষের মধ্যেই এটি দেখা যায়। যেমন দেশে সড়ক পথে চলাচলের জন্য যেসব আইন-কানুন আছে, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা সেগুলো যথাযথ ভাবে মানেন না। আবার সাধারণ জনগণ সিগন্যাল না মেনে রাস্তায় চলাচল, ওভার ব্রিজ থাকার পরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড পার হওয়া, ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালানো নিষেধ হলেও অবাধে চালানো ইত্যাদি।

তাই সড়ক পথে দুর্ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানুষের জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে? যেন আইন ভাঙ্গার এক অশুভ প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে আমাদের দেশের এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, সে ঋণ আর ফেরৎ দেন না এবং গোপনে বিদেশে অর্থ পাচার করছেন। ফলে দেশের অর্থনীতির মেরুদ- ভেঙ্গে যাচ্ছে। এমন ব্যবসায়ীরা দেশের প্রচলিত আইন অমান্য করে এহেন অপকর্ম করছেন। সমাজ পরিবর্তন ও আধুনিকায়নে আইন গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। আইন নিঃসন্দেহে সমাজের শ্রেণীবৈষম্য দূর করতে এবং দুর্বল ও অসহায় শ্রেণীর নিরাপত্তায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আইন অমান্য করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে একদিনে গড়ে উঠেনি বরং দীর্ঘদিন ধরে এই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। কাজেই এ সংস্কৃতি থেকে আমাদের দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। আর আমরা যদি আইন অমান্য করি, তবে দেশে বিশৃঙ্খলা ক্রমশ বৃদ্ধি দিবে। কাজেই আমাদের নিজেদের স্বার্থে এবং দেশের স্বার্থে প্রচলিত আইন মানতে হবে। আইন যেমন সবাইকে সমানাধিকার দিয়েছে মানুষ হিসেবে, তেমনই তা মেনেও চলতে হয় সবাইকে। আইন কেউ মানবে না, আবার কাউকে মানতে বাধ্য করা হবে জোরপূর্বক এমনটা নয়।

যারা আইন মানতে চান না, নিজের সুখ-সুবিধাকে বড় করে দেখেন, প্রয়োজনে অন্যকে মেরে-ধরে নিজের ইচ্ছেকে পূরণ করতে চান অন্যায়ভাবে, তাদের জন্যই তৈরি হয় আইন-আদালত বা বিচারব্যবস্থা। বিচারব্যবস্থা হচ্ছে সভ্যতার অবদান। আইন দেশের শৃঙ্খলা রক্ষা ও অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ়করণের চালিকাশক্তি। আইন অমান্য করা করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে সকলেরই বেরিয়ে আসতে হবে। আইন দেশের শৃঙ্খলা রক্ষা করা ও অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ়করণের চালিকাশক্তি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচারহীনতা যেমন অগ্রহণযোগ্য, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতাও অনুরূপভাবে অগ্রহণযোগ্য। কোনো অপরাধীকে অপরাধ সংঘটনের দায়ে গ্রেপ্তার ও বিচারে সাজাপ্রাপ্ত হতে দেখলে অনুরূপ ব্যক্তিরা সতর্কতা অবলম্বন করে অপরাধ করা ও তজ্জন্য সাজা ভোগ থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে সচেষ্ট থাকবে। প্রতিটি নাগরিকের মনে বিশেষ করে অপরাধ প্রবণ ব্যক্তির মনে এমন ভীতি জন্মাতে হয় যে অপরাধ করে কোনো ভাবেই ছাড় পাওয়া যাবে না, বিচারের আওতায় আসতেই হবে। সমাজে কে কোথায় কোনো অপরাধমূলক কাজের গোপন পরিকল্পনা ও তৎপরতায় লিপ্ত গোয়েন্দা বাহিনীকে তা উদঘাটনে সচেষ্ট থাকতে হবে। অপরাধকে সমাজ থেকে নির্মূল করতে হলে আইন সহায়তাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশের ভূমিকা অপরিহার্য। পুলিশ কথাটির অর্থ সাহায্যকারী। সমাজে নিরীহ জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পরিচিত পুলিশের হাতে ন্যাস্ত। পুলিশ তৎপর হলে অপরাধী চক্র সতর্কতা অবলম্বন করে সাবধান হয়। কিন্তু পুলিশ যদি অবহেলার সাথে দায়িত্ব পালন করে কিংবা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে তবে অপরাধ দমন তো দূরের কথা, তা আরও বিস্তার লাভ করে। আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে ফৌজদারী অপরাধের অভিযোগ করা হয় থানা সমূহে। আবার যে ক্ষেত্রে থানায় অভিযোগ গ্রহণ করতে পারেনা সেক্ষেত্রে কোর্টে অভিযোগ দায়ের করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে থানায় এজাহার দায়েরের মাধ্যমে ফৌজদারী মামলার সূত্রপাত ঘটে এবং থানা পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আদালতে মামলা সমূহের বিচার কার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই, ফৌজদারী মামলার মূল ভিত্তি এজাহার দূর্বল হলে, মামলার ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই দূর্বল এজাহারের বা বস্তুগত তথ্য বিভ্রাটের কারনে ফাইনাল রিপোর্টের মাধ্যমে মামলার অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটে।

এছাড়াও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের অভাবের কারণে মামলার চার্জশীটে প্র কৃত ঘটনা প্রতিফলিত হয় না। তদন্তের লক্ষ্যে বের করে আনতে হবে অপরাধ সংঘটনের পেছনের কারণ, অপরাধের পরিকল্পনা এবং কে ও কারা এর সঙ্গে জড়িত এবং তাদের বর্তমান অবস্থান। অপরাধ ঘটার পর সংক্ষিপ্ততম সময়ে সফল তদন্ত কার্যক্রম সমাপ্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয়া তদন্ত কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। প্রকৃত অপরাধের ক্ষেত্রে মামলার এজাহার গ্রহণ ও তদন্তপূর্বক চার্জশীট প্রদানে থানা পুলিশের দক্ষ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর শুরু হয় মূল বিচারকার্য। এই অবস্থায় প্রকৃত ভিকটিমকে ন্যায় বিচার প্রদানের মূল দায়িত্ব বিজ্ঞ বিচারক ও বিজ্ঞ আইনজীবীদের উপর এসে যায়। সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে অপরাধমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে হবে। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বকে নির্বাচন করতে হবে যাতে তারা অপরাধীকে প্রশ্রয় না দেয়। অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। আদালতে সাক্ষ্যদানের প্রয়োজন হলে সাক্ষ্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাক্ষ্যের অভাবে অনেক অপরাধী খালস যায়। সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সাক্ষীরা স্বঃতস্ফূর্ত ভাবে সাক্ষ্য প্রদানে এগিয়ে আসলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত অনেক সহজ হয়ে যায়। সমাজ বিনির্মাণের অর্থ সমাজের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের পরিবর্তন।

আইন তখনই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, যখন তা সমাজের সমর্থন লাভে সক্ষম এবং তা মেনে চলে। সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে বহুবিদ কারণ থাকে। এর মধ্যে আইনের প্রতি আস্থাহীনতা অন্যতম বড় কারণ। আইন অমান্য করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসলে বিশৃঙ্খলা মুক্ত সমাজ গড়ে উঠবে। আইনের শাসন বাস্তবায়নে নজরদারির পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে এ সম্পর্কিত বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়দায়িত্ব যাদের, তাদের ন্যায়নিষ্ঠ ভূমিকা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন জরুরি। একই সঙ্গে সামাজিক উদ্যোগও দরকার। সমাজ প্রতিনিধিদের সম্মিলিত কার্যক্রম সমাজের বৈরিতা নিরসনে সহায়ক হতে পারে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে হল আইনের প্রতি সবার শ্রদ্ধা ও আস্থা রাখা। পাশাপাশি অপরাধ প্রবণতা রোধে রাষ্ট্রকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করেই সেটা করতে হবে। তাহলে অন্যরাও অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে। এতে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে এবং দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি হবে। সর্বত্র আইন মানার সংস্কৃতিও গড়ে তুলতে হবে। দেশের নাগরিক হিসাবে আমাদের সকলেরই উচিত দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলা। এতে আমাদের সকলেরই মঙ্গল।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।