আতহার নূর

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হলো দেশের জনগণের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠন ও নীতিনির্ধারণ করা। রাষ্ট্র যদি সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, বরং জনবিচ্ছিন্ন, সমাজ-বাস্তবতা বিবর্জিত ও ধর্ম-সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ কিছু ব্যক্তিকে নারী সংস্কারের মতো একটি সংবেদনশীল বিষয়ে দায়িত্ব দেয়, তাহলে তা নিছক অব্যবস্থাপনাই নয় বরং সাংস্কৃতিক আত্মবিক্রয়ের সূচনা।

সম্প্রতি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন কিছু বিতর্কিত প্রস্তাব পেশ করেছে, যেখানে অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে একটি অধ্যাদেশ জারির সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া বৈবাহিক সম্পর্কে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করার কথাও প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ স্পষ্টত এ প্রস্তাবগুলো দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বাংলাদেশ একটি ধর্মীয় মূল্যবোধ ভিত্তিক সমাজ। এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান জনগণ তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় বিধিবিধান অনুযায়ী পারিবারিক জীবন পরিচালনা করে। ইসলামে বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নির্ধারিত, যাকে মুসলিম পারিবারিক আইন হিসেবে রাষ্ট্রও স্বীকৃতি দিয়েছে। একইভাবে হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক আইন বিদ্যমান। এছাড়া অভিন্ন পারিবারিক আইন জারি করা মানে হলো সব ধর্মের নিজস্ব বিধানকে অগ্রাহ্য করে একক একটি আইন চাপিয়ে দেয়া, যা সংবিধানের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। ধর্মীয় আবেগে আঘাত করে কোনো সংস্কার কখনোই সফল হয় না। ইতিহাস বলে, ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইন জনগণ মেনে নেয় না, বরং তা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

ধর্ষণের সংজ্ঞায় বৈবাহিক সম্পর্কের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিও স্পষ্ট, এবং এটিকে বিবেচনা না করে কোনো আইন প্রণয়ন করা অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত হবে। যা পারিবারিক শৃংখলা ও মূল্যবোধ ধ্বংসের মুখে দাঁড় করাবে।

এ প্রস্তাবগুলো সমাজে বিশৃঙ্খলা ও ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করবে। যা ইতোমধ্যে হেফাজতে ইসলামের মতো ধর্মীয় সংগঠনের ঢাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ ডাক দেওয়া থেকে আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। তাই সরকারের উচিত হবে জনগণের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে এমন প্রস্তাব পর্যালোচনা করা এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, সমাজের মূলধারার নারীদের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই, ইসলাম সম্পর্কে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ও বাস্তব অভিজ্ঞতাহীন সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিশন ধর্মকে নারীর বৈষম্যের মূল উৎস বলে দাবি করেছে। এ বক্তব্য যেমন হাস্যকর, তেমনি বিপজ্জনক। যারা ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা জানেন, তারা জানেন, ইসলাম নারীকে দিয়েছে মর্যাদা, অধিকার ও নিরাপত্তা। নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিয়ে স্বাধীনতা ও দায়িত্ব দুটোই দিয়েছে। ধর্মকে দোষী সাব্যস্ত করা আত্মপরিচয় বিসর্জনের ফল।

এ কমিশনের অধিকাংশ সদস্য এমন নারী, যারা তথাকথিত ‘মুক্তমনা’ এবং শুধুমাত্র সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ধর্ম ও সমাজ-বাস্তবতা সম্পর্কে তারা প্রায়শই অজ্ঞ বা উদাসীন। তাদের চিন্তা ও অবস্থান পশ্চিমা নারীবাদী ডিসকোর্স দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের তৃণমূল ধর্মপ্রাণ নারীসমাজকে বাদ দিয়ে তাদের ‘সংস্কার’ কাদের জন্য? এ রাষ্ট্র কি আজ আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের চেতনা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে? নাকি একটি পশ্চিমাপন্থী সংখ্যালঘু শ্রেণির আদর্শকে চাপিয়ে দিতে ব্যস্ত? বিষয়টি নিয়ে রীতিমত রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।

বিগত স্বৈরাচারী শাসনের সময় রাষ্ট্র যে প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের হাতে দায়িত্ব, নেতৃত্ব এবং প্রভাবশালী প্ল্যাটফর্ম তুলে দিয়েছে, তাতে দেশের বিরোধী মত, দল এবং চিন্তার জায়গাগুলোকে প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে। ধর্মপ্রাণ জনগণের চিন্তা ও প্রত্যাশাকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং আলেম সমাজের সঙ্গে একদিকে প্রতারণা, অন্যদিকে তাদের ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহারের এক নিষ্ঠুর প্রবণতা গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্র আজ যেন ধর্মকে বিশ্বাস নয় ব্যবহারের বস্তু হিসেবে দেখছে।

এমন প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো গঠিত কমিশন একধাপ এগিয়ে ‘পতিতাবৃত্তি’কে শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রশ্ন ওঠে, একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এ ধরনের প্রস্তাব কীভাবে বিবেচনায় আসে? আমাদের সমাজে কি নারীর সম্মানজনক পেশার অভাব? যারা আজ পতিতাবৃত্তির মতো পেশায় বাধ্য হয়েছেন, তারা কি তা স্বেচ্ছায় করেছেন? না কি দারিদ্র্য, পাচার, শোষণ, ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বাধ্য হয়েছেন এ পথে নামতে? পতিতাবৃত্তি কোনো ‘আদি পেশা’ বলে তার বৈধতা চাওয়া একধরনের নৈতিক বিভ্রান্তি। যদি তাই হতো, তাহলে কি আমরা দাসত্ব, কৌলিন্য প্রথা, কিংবা বর্ণবাদের মতো আদিম ব্যবস্থাকেও ফিরিয়ে আনতে চাই? এ পেশার পেছনে রয়েছে যৌন রোগের বিস্তার, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, মানবপাচার এবং নারীর স্থায়ী পণ্যায়ন। এটি কোনোভাবেই একটি সম্মানজনক ‘কর্মসংস্থান’ হতে পারে না। বরং রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, এই নারীদের পুনর্বাসনের সুযোগ তৈরি করা স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম চালু করে তাদের সম্মানজনক জীবনে ফেরানো।

আমেরিকার বেশিরভাগ রাজ্যে আজও পতিতাবৃত্তি অবৈধ। ইউরোপের যেসব দেশে এটি বৈধ, সেখানে একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে এ ব্যবস্থায় নারীরা অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে পড়েছেন, পাচারের মাত্রা বেড়েছে, এবং সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আসে আমরা কেন সে ধ্বংসাত্মক নীতি গ্রহণ করবো? বাংলাদেশ একটি ধর্মপ্রাণ, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনে গঠিত সমাজ। এখানে নারীর মর্যাদা পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে স্বীকৃত। এ দেশ পশ্চিমা সমাজ নয়, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে সমাজ ও নৈতিকতা ভেঙে পড়েছে। আমাদের রাষ্ট্র যদি সত্যিই জনগণের, তাহলে জনগণের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে কেবল কিছু এনজিও-সমর্থিত চেতনার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না।

আজ সময় এসেছে, এ প্রশ্নগুলো রাষ্ট্রকে জোর গলায় ছুঁড়ে দেওয়ার। নারী উন্নয়ন ও অধিকারের নামে যদি নারীর মর্যাদা ধ্বংস করা হয়, তাহলে তা কোনো সংস্কার নয় বরং আত্মঘাতী পথ। পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া মানে নারীকে স্থায়ীভাবে ভোগ্যপণ্যে রূপান্তরিত করা। আর এ নীতির বিপরীতে দাঁড়ানো মানে সত্য, ন্যায় এবং মানুষের সম্মান রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেওয়া। যা কোন সভ্য ও মূল্যবোধভিত্তিক সমাজে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।