DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

পাঠকের অভিমত

থামাতে হবে পৈশাচিকতার উৎসব

পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট আজকের পৃথিবীতে। আমাদের চারপাশে আজ নৈতিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়।

Printed Edition

॥ আজহার মাহমুদ ॥

পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয়ের ছাপ স্পষ্ট আজকের পৃথিবীতে। আমাদের চারপাশে আজ নৈতিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। ভীতসন্ত্রস্ততা, অশান্তি ও অস্থিরতা বাড়ছে পুরো পৃথিবীজুড়ে। ফলে পারিবারিক কলহ, অবাধ যৌনাচার, অশ্লীলতা, যৌন বিকৃতি, কুরুচিপূর্ণ সমকামী ও বহুকামিতার মতো পশুসুলভ যৌন আচরণ সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ার খবরের প্রায় ৫০% খবরই সমাজিক অবক্ষয়ের। পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, প্রেমিকার হাতে প্রেমিক খুন, প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা খুন, ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, ছেলের হাতে মা খুন, পুত্রের হাতে পিতা খুন ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন খুন, ধর্ষণ, গুমের খবর তো নিয়ম মাফিক সংবাদে পরিণত হয়েছে।

এছাড়াও বর্তমান সময়ে অবাধে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনাগুলো ভয়াল আকার ধারণ করেছে। কোনভাবেই যেন ধর্ষণের মতো এ ঘৃণ্য অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে পৈশাচিক ধর্ষণ। এ অবস্থায় আইন ও বিচারের পাশাপাশি ধর্ষণ প্রতিরোধে প্রয়োজন গণসচেতনতা এবং সামাজিক আন্দোলন। যদিও আমি মনে করি সচেতনতার পাশাপাশি আইনের শাসন আরও জোরালো হলেই ধর্ষণ রোধ হতে পারে। এছাড়াও ধর্ষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশা। এ মেলামেশার কারণে সৃষ্টি হয় যৌন আকর্ষণ। যা একসময় ধর্ষণের মতো অপরাধের দিকেও ধাবিত করে। তাই এজন্য আমি দায়ী করবো পুরো সমাজকেই। যারা অভিভাবক রয়েছেন তাদেরকেই এ দায় নিতে হবে। সন্তানকে এ বিষয়ে সঠিকভাবে জ্ঞান দিতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে অবাধ মেলামেশার ক্ষতি কী। শুধু তাই নয়, ধর্ষণ রোধে প্রয়োজন ধর্মীয় মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। আমরা যতই আধুনিক হচ্ছি, ততই এগিয়ে যাচ্ছি নোংরামির দিকে। আমাদের ভেতর থাকছে না ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার ভয়। যার কারণে এসমস্ত কাজ করতে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও চিন্তা করি না। আমাদের ভেতর এখন শিষ্টাচার এবং নৈতিক মূল্যবোধের মাত্রা নেই বললেই চলে। যার কারণে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা এখন সমাজের চোখেও একটি সহজ বিষয় হয়ে উঠেছে। আমাদের ভেতর এখন চক্ষুলজ্জাও নেই।

আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের ঘটনাগুলোর দিকে নজর দিই, দেখা যাবে আশংকাজনক হারে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে গেছে। পত্রিকার পাতা থেকে নিকট অতীতের কিছু সংবাদ জানিয়ে দিতে চাই আপনাদের। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় মহান শহীদ দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে ফুল সংগ্রহ করতে যাওয়া এক স্কুলছাত্রীকে (১১) ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় এক গৃহবধূকে (২২) ট্রলারে করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে পদ্মার চরে নিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিন জনকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। গত ৫ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাটের এক গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়, এ ঘটনায়ও তিন আসামীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার গজনী অবকাশ পিকনিক স্পটে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক মাদ্রাসাছাত্রী। গত ৬ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ধারালো অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে ধলেশ্বরী নদীর তীরে এক পোশাককর্মীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে।

এসব সংবাদ পত্রিকার পাতা থেকেই তুলে ধরলাম। আর অল্প সংবাদই তুলে ধরেছি, সব তুলে ধরতে গেলে কী অবস্থা হবে সেটা কল্পনাও করা যাবে না। আজকাল বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালের একটি অংশ থাকে ধর্ষণের খবরের জন্য। যেখানে গেলে পাওয়া যায় সব ধর্ষণের খবর। ভেবে দেখুন এ ধরনের ঘটনা কত পরিমাণ ঘটলে এমনটা হয়। মূলত পারিবারিক ও সামাজিক প্রথা ও সংস্কার ধূলিসাৎ, সামাজিক ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয়, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার বিশেষ করে ল্যাপটপ-কম্পিউটার-মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও জবাবদিহিতা বিহীন ব্যবহারের সুযোগ, পর্নগ্রাফির অবাধ বিস্তার, বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক দিকের আগ্রাসনই ধর্ষণের ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, দুর্বল সামাজিক কাঠামো, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র ও বিচারহীনতা। আরও রয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় সংস্কৃতি চর্চার অভাব, সুষ্ঠু ও সুস্থ ধারার বিনোদনের অনুপস্থিতি, কিশোর-কিশোরীদের ক্রীড়া-কর্মকান্ডের অভাব ইত্যাদি। সমাজে যতসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, ততটার বিচারের খবর আমরা পাই না। গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর তেমন একটা দেখা যায় না বললেই চলে। বরং অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষকরা শুধু পারই পায় না, পুরস্কৃতও হয়।

ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র। যদি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যায়, তাহলে এ ঘটনা হ্রাসের পাশাপাশি বন্ধও হতে পারে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সমাজ এবং পরিবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের মাত্র যেভাবে বাড়ছে তাতে আমাদের সকলের এক হয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। এসব আন্দোলনের মাধ্যমেও যৌন নির্যাতনের ঘটনা হ্রাস সম্ভব। এতে ধর্ষক ও নিপীড়ক বার্তা পায়। ফলে দুর্ঘটনা হ্রাস পেতে পারে।

আমরা মূলত বিখ্যাত লেখক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে যৌনতাকে ব্যাখ্যা করে থাকি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের যৌন বাসনাগুলি যদি ভালভাবে পূর্ণ না হয়, তবে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতি আর সময়ের পরিবর্তনে যৌনতা আরও বিস্তৃত এবং পরিশীলিত হয়েছে। যেহেতু ধর্মে-সমাজে, রাষ্ট্রে-আইনে যৌনতা নিষিদ্ধ নয়, তাই এটা থাকবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দরকার নৈতিক অনুষঙ্গ। নৈতিক মোড়ক না থাকলেই দেখা দেবে বিশৃংখলা। তাই সামাজিক ও জাতীয় জীবনে নৈতিক মূল্যবোধ সুগঠিত ও সুসংগঠিত করতে হবে।

তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার ও অশুভ বিস্তার ঠেকাতে হবে। বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক উপাদানও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এসবের দায়িত্ব রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের। পাশাপাশি আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করতে হবে। তাহলে যদি অশুভের এই সুনামি প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়া কখনও এই অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এজন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাও অত্যন্ত জরুরী।

লেখক : সাংবাদিক।