পাঠকের অভিমত
মত অভিমত
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ভাবনা
প্রতিবছরই আন্তর্জাতিক নারী দিবস এলেই যেন নারী শুভাকাক্সক্ষীরা নড়ে চড়ে বসেন। শুরু হয়ে যায় সেমিনার-সিম্পোজিয়ামসহ নানা আয়োজন।
Printed Edition
নূরুন্নাহার নীরু
প্রতিবছরই আন্তর্জাতিক নারী দিবস এলেই যেন নারী শুভাকাক্সক্ষীরা নড়ে চড়ে বসেন। শুরু হয়ে যায় সেমিনার-সিম্পোজিয়ামসহ নানা আয়োজন। সভা, সংগঠনগুলো মুখরিত হয়ে ওঠে বিভিন্ন প্রোগ্রাম নিয়ে। আন্তর্জাতিকভাবে একটা প্রতিপাদ্য বিষয়ও নির্ধারণ হয়ে যায়। এবারও হয়েছে ২০২৫ সালের জন্য -“অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, নারী ও কন্যার উন্নয়ন”।
নারীর 'অধিকার' সংক্রান্ত আলোচনা খুবই পুরনো, ‘সমতার’ বিষয়টিও চলমান। ইদানিং ‘ক্ষমতায়ন’ বিষয়টিকে খুব বেশি সামনে আনা হচ্ছে কয়েকবছর ধরেই। এবারে ২৫শে এসে নবনিযুক্ত হয়েছে “উন্নয়ন” শব্দটি। বিশেষভাবে নারী ও কন্যার জন্য আইন করে প্রতিষ্ঠা করা ‘উন্নয়ন’ শব্দটি খুবই অনভিপ্রেত। বেদনার সাথে বলতে হচ্ছে প্রদত্ত প্রতিপাদ্যে যে বিশেষণগুলো বিশেষায়িত করা হয়েছে তার আলোচনা-পর্যালোচনা প্রতিবারই নতুন করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে কিন্তু কার্যত কিছুই হচ্ছে না। দিবস শেষ হলেই যেনো সব শেষ। অথচ আল্লাহ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেই কবে ১৫০০ বছর আগেই শেষ নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে আল কুরআনে নারীদের অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন সব কিছুরই একটা রূপরেখা দিয়ে রেখেছেন।
১. সৃষ্টিগতভাবে নারীর মর্যাদা : “আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এটি একটি যে তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জুড়ি, যেন তোমরা তাদের সাহায্যে সাহচর্যে পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করতে পারো। এ উদ্দেশ্যেই তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া অনুকম্পা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। চিন্তাশীল লোকদের জন্য এতে বহু নিদর্শন রয়েছে।” (আর রূম: ২১)
২. অধিকার ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের ভারসাম্য : “নারীদের জন্যও ঠিক তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের অধিকার। কিন্তু উভয়ের মধ্যে নারীদের উপর পুরুষদের একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী সবার উপরই আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, বিজ্ঞ ও সুবিবেচক। (সুরা আল বাকারাঃ ২২৮)
৩. সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় প্রতিরোধে নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস : “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী পরস্পরের বন্ধু ও সাথী। তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, নামায কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। অবশ্যই আল্লাহ এসব লোকদের প্রতিই দয়াবান হবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও পরম জ্ঞানী।” (আততওবা : ৭১)
৪. কঠিন যুগসন্ধিক্ষণেও নারীপুরুষের যৌথ ভূমিকা : “যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে বিনা অপরাধে নির্যাতন করে ও কষ্ট দেয়, তারা নিঃসন্দেহে বিরাট মিথ্যার দোষ ও গুনাহের বোঝা নিজের উপর চাপিয়ে নিয়েছে।” (আল আহযাব : ৫৮)
৫. অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে নারীপুরুষের সমতা : “পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদের জন্য যেমন নির্ধারিত অংশ রয়েছে, তেমনি তাতে তা যতই কম বা বেশী হোক নারীদেরও অংশ নির্ধারিত রয়েছে। আর এ নির্ধারণ আল্লাহর পক্ষ থেকে।” (আননিসা : ৭)
৬. হিযরতকালেও পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণের ক্ষমতা : “হে ঈমানদার লোকেরা! যখন তোমাদের সাথে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে ঈমানদার মহিলারা হিযরত করে মদীনায় আসে তখন তোমরা তাদের ঈমানের ব্যাপারটা যাচাই করে নাও।” (আল মুমতাহিনা : ১০)
৭. সত্য যাচাইর জন্য বা অপরাধ দমনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা : “হে নবী বলে দাও, এসো আমরা আমাদের ও তোমাদের স্ত্রী-পরিবার, ছেলে মেয়ে ও আপনজনকে ডেকে নেই।” (এ আহ্বান হচ্ছে সত্য যাচাই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের। আলে ইমরান : ৫৯-৬১)
মূলত স্বল্পপরিসরের এ কয়টি উদাহারণ থেকে যে বিষয়টি প্রচ্ছন্ন হয়ে আসে তা হচ্ছে, একটি সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান দায়িত্ব, কর্তব্য রয়েছে যা প্রতিষ্ঠায় অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন এমনকি উন্নয়নও অবধারিত তা হোক পুরুষ কি নারী। এর জন্য চাই সুষ্ঠু, আদর্শিক, আল্লাহর সার্বভৌমত্বে গড়া একটি রাষ্ট্র যেখানের আইনে নারী পুরুষের জন্য প্রদত্ত প্রতিটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। পৃথক করে আর নারীদের জন্য ভাবতে হবে না। এমন একটি রাষ্ট্র গড়তে হলে প্রথমেই তার শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে যেখানে নারী পুরুষ উভয়ই জানতে পারবে যার যার দায়িত্ব কর্তব্যসহ স্বীয় উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে। দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় একদল শুধুই বস্তুবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের অধিকার মর্যাদা সম্পর্কে যেমনি অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে তেমনি আরেক দল শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে দুনিয়া বিমুখ হয়ে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইন সম্পর্কেও থাকছে নিস্পৃহ। উপরন্তু জানতেও পারছে না রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর কী দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। বস্তুতঃ ঘর থেকেই নারী পুরুষের শিক্ষার হাতেখড়ি।
সুতরাং নারীর মত পুরুষকেও জানতে হবে ইসলামের বিধানসমূহ তাহলে সেও তার ঘরের নারীদের অধিকার, মর্যাদার প্রতি সচেতন হয়ে উঠতে পারবে। যে সমাজে পুরুষরাই পিছিয়ে, পুরুষরাই বৈষম্যের শিকার, নির্যাতিত সে সমাজে নারীর অগ্রগতি কোন পথে? কেন আসবে? আমরা প্রতিবছর যতই ঢাক ঢোল পিটাই না কেন তা নিতান্তই গলাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। মূলতঃ আমাদের কাজের চেয়ে কথা বেশিÑ এ বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে অচিরেই। এ জন্যই প্রয়োজন প্রদত্ত বিধানকে প্রতিষ্ঠার জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করা। যেখানে আর সুযোগ থাকবে না পৃথকভাবে নারী ইস্যুকে কেন্দ্র করে অন্য কোন অভিসন্ধিকে সোচ্চার করার।
লেখিকা : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা