গবেষকরা দাবি করছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি আগামী এক দশকেরও বেশি সময় আগে থেকে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের চিকিৎসা ইতিহাস ও স্বাস্থ্য তথ্য বিশ্লেষণ করে ১ হাজারের বেশি রোগের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিরূপণ করা সম্ভব হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি অনেকটা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো কাজ করে। যেমন আবহাওয়ায় বলা হয় বৃষ্টির সম্ভাবনা ৭০ শতাংশ, তেমনি এআই ব্যবহার করে স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা শতাংশে জানা যাবে।

গবেষকরা মনে করছেন, আগেভাগে ঝুঁকিপূর্ণ রোগী শনাক্ত করলে চিকিৎসকরা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবেন। ফলে জটিল রোগও প্রতিরোধযোগ্য হতে পারে। একই সঙ্গে হাসপাতালগুলো ভবিষ্যতে কাদের চিকিৎসার চাহিদা বাড়তে পারে তা আগেভাগে পরিকল্পনা করতে পারবে।

এই প্রযুক্তি ডেলফি-২এম মডেলের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে, যা চ্যাটবটের মতো ভাষা এবং প্যাটার্ন শনাক্তকরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। চ্যাটবট যেমন ভবিষ্যতের শব্দ অনুমান করতে শেখে, ডেলফি-২এম তেমনি স্বাস্থ্য রেকর্ড থেকে রোগের ধরন ও ঝুঁকি শনাক্ত করতে সক্ষম। তবে এটি নির্দিষ্ট কোনো তারিখে কোনো রোগ হবে কি না তা জানাতে পারে না; বরং ঝুঁকির সম্ভাবনাকে শতাংশ হিসেবে প্রকাশ করে।

ইউরোপীয় মলিকুলার বায়োলজি ল্যাবরেটরির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ইওয়ান বার্নি বলেন, ‘এটি আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো। আমরা বলতে পারি, কোনো রোগ হওয়ার ৭০ শতাংশ সম্ভাবনা আছে। একই সঙ্গে একাধিক রোগের ঝুঁকি হিসাব করা সম্ভব।’

প্রাথমিকভাবে যুক্তরাজ্যের ইউকে বায়োব্যাংক প্রকল্পের তথ্য দিয়ে মডেলটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যেখানে ৪ লাখের বেশি মানুষের হাসপাতাল, চিকিৎসা ও জীবনধারার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। পরে ডেলফি-২এম মডেলের কার্যকারিতা যাচাই করা হয় ডেনমার্কের ১৯ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য রেকর্ডে। অধ্যাপক বার্নি জানান, মডেলটি টাইপ ২ ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক বা সেপসিসের মতো রোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। হঠাৎ ঘটে যাওয়া সংক্রমণ অনুমান করা তুলনামূলকভাবে কঠিন।

বর্তমানে অনেক রোগীর হৃদরোগ বা স্ট্রোকের ঝুঁকি অনুযায়ী কোলেস্টেরল কমানোর ঔষধ দেওয়া হয়। গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে এআই মডেলও একইভাবে ঝুঁকিপূর্ণ রোগী শনাক্ত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে ওষুধের পাশাপাশি জীবনধারাবিষয়ক পরামর্শও দেওয়া যাবে। যেমন যাদের লিভারের সমস্যা হতে পারে, তাদের মদ্যপান কমানো বা খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।

এআই প্রযুক্তি জাতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্য পরিকল্পনাতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো এলাকার সব স্বাস্থ্য রেকর্ড বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে রোগীর চাপ এবং চিকিৎসার চাহিদা নির্ধারণ করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, ২০৩০ সালে নরউইচ শহরে কতজন হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে, তা পূর্বাভাস দিয়ে হাসপাতালগুলো পরিকল্পনা করতে পারবে।

জার্মান ক্যানসার রিসার্চ সেন্টারের এআই ইন অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মরিটজ গেরস্টুং বলেন, ‘এটি মানবস্বাস্থ্য ও রোগের অগ্রগতি বোঝার এক নতুন যুগের সূচনা। জেনারেটিভ মডেল ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত চিকিৎসা এবং বৃহৎ পরিসরে স্বাস্থ্যসেবা পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল নেচার-এ। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, মডেলটি এখনও পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। এর সীমাবদ্ধতা হলো, এটি মূলত ৪০–৭০ বছর বয়সীদের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যা পুরো জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না।

গবেষকরা ভবিষ্যতে জেনেটিকস, রক্ত পরীক্ষা ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত ইমেজিংয়ের তথ্য যুক্ত করে মডেলটি আরও উন্নত করার পরিকল্পনা করছেন। অধ্যাপক বার্নি জানান, এটি এখনও গবেষণার পর্যায়ে, চিকিৎসায় ব্যবহারের আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সঠিক মূল্যায়ন অপরিহার্য।

তবে প্রযুক্তিটি ইতিমধ্যেই এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মানুষের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যঝুঁকি পূর্বাভাস দেওয়ার সম্ভাবনা এখন বাস্তব। গবেষণায় ইউরোপীয় মলিকুলার বায়োলজি

সূত্র: বিবিসি