৫ আগস্ট ২০২৪। সকালটা আর দশটা সাধারণ সকালের মতো নয়, সারাটা রাত তীব্র উৎকণ্ঠায় জেগে থাকা। উৎকণ্ঠিত দেশবাসী একটা সুসংবাদের অপেক্ষায় টেলিভিশনের পর্দার সামনে প্রায় নিষ্পলক তাকিয়ে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব। চারদিকে গুজব আর সত্যের মিশেলে আনন্দ-উৎকণ্ঠার দোলাচল। হঠাৎ সব কল্পনার অবসান। জনতার রুদ্র রোষ থেকে প্রাণে বাঁচতে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলে দম্ভোক্তি করা ফ্যাসিস্ট তার অগণিত নেতাকর্মীকে ফেলে শুধু পদত্যাগই নয়, বরং লুটেরা ছোট বোন রেহানাসহ হেলিকপ্টারে উঠে কর্গো বিমানে ভারতে পালিয়ে যান।
রক্তস্নাত সেই জুলাই-আগস্ট এক বছর পর আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। দীর্ঘ ১৬ বছর ফ্যাসিস্টদের নির্মম অত্যাচার, নির্যাতন, গ্রেফতার হত্যা, খুন, গণতন্ত্র ধ্বংস এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল আওয়ামী শাসক গোষ্ঠী। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদদের পতন ঘটেছে। সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু সেই চিত্র কোথায়, এমন জিজ্ঞাসা সবার।
মূলত গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, সেটি হলো বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া। অনেকেই অভিযোগ করছেন, বৈষম্যহীন দেশ গড়ার কাজ তো শুরুই হয়নি। দেশে আবারো ফ্যাসিবাদের দোসররা স্বোচ্চার হচ্ছে। দখল, চাঁদাবাজি, নির্যাতন আগের তুলনায় যেন বেড়েছে। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা ছিল এই অন্তবর্তী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। জুলাই অভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারের ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনীয় সংষ্কার করা, এই এই কাজগুলো হচ্ছে, কিন্তু যে গতিতে হওয়া দরকার সেটা হচ্ছে না। নির্বাচন, সংস্কারে দুই একটি দলকে প্রাধান্য দেয়া, একটি গোষ্ঠীর দেশব্যাপী দখল চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আরেক পক্ষের স্বোচ্চার হওয়া। এসব কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম নেয়। সেই অবিশ্বাস থেকেই ঐক্যে ফাটল ধরে। সরকার চাইলে এখনো সেটা ফিরিয়ে আনতে পারে। তবে এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বই বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জুলাই অভূত্থানের আগে গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে সরব ছিলেন সবাই। কেউ কেউ মনে করেন, ফ্যাসিবাদ হটানোর আন্দোলনে যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল তাতে অনেক ভাটা পড়েছে। বিশেষ করে বিদ্যমান প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে যেভাবে কাদা ছোড়াছুড়ি লক্ষ করা যায় তা বেশ অস্বস্তিকর। তারপরও সবাই ঐক্যের কথা বলছেন। এটাকে গণতন্ত্র বলে প্রচার করছেন। তবে সত্যটা হচ্ছে, যে ঐক্যের ভিত্তিতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সকল রাজনৈতিক দল ও শ্রেণি, পেশার মানুষ আন্দোলন
শুধুমাত্র বিএনপির কারণে সেই ঐক্য ধরে রাখা যায়নি বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র যুগ্ম আহবায়ক মনিরা শারমিন। তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র, সংষ্কার, নির্বাচন ইস্যুসহ রাজনৈতিক দলগুলোও যখন কোনো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে, তখন বিএনপি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারা ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার কিছু বিষয় জিইয়ে রাখতে চায়। তবে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ইমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, সেই ঐক্য পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। আমি মনে করি, এখনো আমাদের মধ্যে ঐক্য আছে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পৃথক কর্মসূচি থাকবে, তারা সে অনুযায়ী কাজ করবে। একটি দেশে সবাই একটি বিষয়ে একমত হবে এমন তো না। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান আসবে। কিন্তু আলোচনায় একমত হতে না পারার অর্থ এই নয় যে, আমাদের মধ্যে ঐক্যমত নেই। আমরা মনে করছি, একটা নির্বাচনের মাধ্যমে সেই ঐক্য আবার পুনর্পতিষ্ঠা হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, গত বছরের জুলাইয়ে যে আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের ৮০ ভাগ ছিল শ্রমজীবী মানুষ আর ২০ ভাগ উচ্চ শ্রেণির মানুষ। যে ৮০ ভাগ শ্রমজীবী মানুষ অংশ নিয়েছিলেন, তারা কিন্তু আন্দোলনের পর ঘরে ফিরে গেছেন। এখন সেই ঐক্য নিয়ে যারা দেনদরবার করছেন, তারা উচ্চ শ্রেণির। এখানে তাদের স্বার্থের সংঘাত আছে। ফলে তারা কখনো একত্রিত হতে পারবে না। কারণ, তাদের স্বার্থ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। ফলে, যেটা ঘটার ছিল, সেটাই ঘটেছে বলে আমি মনে করি।
আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বেসরকারি সংস্থা খান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রোকসানা খন্দকার বলেন, আজকে এই ঐক্যে ফাটল ধরার কারণ সরকার নিজেই। মানুষ যে আকাঙ্খা নিয়ে আন্দোলন করেছিল, সেই আকাঙ্খা থেকে সরকার অনেক দূরে। মানুষের মূল আকাঙ্খা ছিল গণতন্ত্র পূণঃপ্রতিষ্ঠা। সেটা কি হয়েছে? আমরা বলতে পারি এখনো হয়নি। তরুণ সমাজকে এই এক বছরে আমরা কী দিতে পেরেছি?
চব্বিশের জুলাই –আগস্টের অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানের পর বছর ঘুরে আবার এসেছে সেই ৫ আগস্ট। দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ বিক্ষোভ, প্রতিরোধ ও জনবিস্ফোরণ যাবতীয় রাজনৈতিক সমীকরণ ভেঙে দেয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কর্মীদের যুদ্ধংদেহী হিংস্র আচরণ কিংবা পুলিশ বাহিনীর চূড়ান্ত নৃশংসতা, কোনো কিছুই ছাত্র-জনতার দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ থামিয়ে রাখতে পারেনি। খণ্ড খণ্ড মিছিলে প্রতিদিন যুক্ত হতে থাকে ক্ষুব্ধ, অত্যাচারিত মানুষের ঢল। ৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে গুটিকয় শিক্ষার্থীর ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে যে সমাবেশ শুরু, তা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে আকারে ও প্রত্যয়ে সুবিশাল হয়ে ওঠে। পর্যায়ক্রমে এই আন্দোলন দেশের ওপর চেপে বসা শেখ হাসিনা সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শক্তিতে গর্জে ওঠে। স্বৈরাচারী সরকার নিজের দেশের মানুষের বুকেই নির্বিচারে গুলি ছোড়ে, অন্তত দুই হাজার শহীদ হন। চোখ-হাত-পাসহ নানা অঙ্গহানির শিকার হন আরও ২০ হাজার ছাত্র-জনতা। ৫ আগস্ট মহাপরাক্রমশালী শেখ হাসিনার সরকার তাসের ঘরের মতো লুটিয়ে পড়ে, তিনি সরকারি হেলিকপ্টারে দেশত্যাগ করেন। বিজয়ী মানুষের ঢল পৌঁছে যায় গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।
চব্বিশের জুলাই কি কেবল শেষ পর্যন্ত সরকারবিরোধী বৃহৎ ও সফল আন্দোলনের স্মৃতিবাহী? না, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান প্রবল ক্ষমতাবানের চোখে চোখ রেখে সাধারণ মানুষের কথা বলবার অপ্রতিরোধ্য শক্তির অনন্য উদাহরণ। ‘চাকরি মুক্তিযোদ্ধার নাতিরা পাবে, নাকি রাজাকারের নাতিরা পাবে!’ তৎকালীন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দাম্ভিক এই উক্তির ভেতরের তুচ্ছার্থে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ছাত্রীদের সুদীর্ঘ মিছিল বের হয় মধ্যরাতে। ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার, রাজাকার/ কে বলেছে? কে বলেছে?/ স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ সেই প্রথম রক্তচক্ষু শাসককে সরাসরি স্বৈরাচার হিসেবে প্রকাশ্যে উচ্চারণ করে ছাত্রসমাজ। এরপর দ্রুত ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত ছাত্র আবু সাঈদের বুকে সরাসরি গুলি করে পুলিশ। সেদিন ৬ ছাত্র নিহত হয় সারাদেশে। আন্দোলন ঘন হয়ে ওঠে। ছাত্রদের মিছিলে যুক্ত হতে থাকে সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ প্রবল ক্ষমতাবান সরকারের সকল অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের ধমক-হুমকি-গুলি কোনো কিছুই আর দমিয়ে রাখতে পারেনি সম্মিলিত ছাত্র-জনতাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরপরই যদি অভ্যুত্থানজয়ী ছাত্ররা জুলাই সনদ তৈরি করে তাতে অটল থাকতে সমর্থ হতো, তবে বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সংশয় সৃষ্টি হয় না। সম্ভবত আন্দোলনরত ছাত্ররা নিজেরাই জানত না, পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে! অথবা ঘটনার প্রবহমানতা এতই তীব্র ও অবিশ্বাস্য ছিল যে, তাদের পক্ষে আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই সরকার ১১টি বিষয়ে কমিশন গঠন করে। জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কমিশনের সুপারিশের কোন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত কিংবা ভিন্নমত, তা আলোচনার মাধ্যমে অদ্যাবধি সমাধানের চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে সৃষ্টি হ্র্র্র্র্র্রয অনিশ্চয়তা ও সংশয়।
জুলাই সনদের আলোচনার মূলে ছিল প্রচলিত রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামো এবং পদ্ধতির মধ্যে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতন্ত্রের পথ বিস্তৃতকারী বিধিগুলো বাদ দিয়ে জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। সরকারের প্রধান ব্যক্তি যেন নিজেকে রাজা মনে না করেন, তার উপায় বের করে কিছু বন্দোবস্ত বিহিত করা। এসবের মধ্যে দেশের মধ্যে শুরু হয় দখল, চাঁদাবাজি। অনেকেই বলেছেন, এসব কর্মকাণ্ড গণঅভ্যুত্থানের অর্জনকে ম্লান করে দেয়। সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধ দমনে সরকারের অকর্মণ্য আচরণ যেমন প্রশ্ন জাগায়, অভীষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সরকারের দোদুল্যমানতা একই সঙ্গে উদ্বেগ তৈরি করে। জুলাইয়ের সুস্পষ্ট প্রত্যয় ও সাহসের সঙ্গে সরকারের এই আচরণ ছিল বেমানান। একইভাবে সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অনাস্থা গণঅভ্যুত্থানের অসামান্য শক্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণই বলা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর্জা গালিব একটি সেমিনারে বলেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় যে জাতীয় ঐক্য ছিল, তাতে ফাটল ধরেছে। এমন অনৈক্য চলতে থাকলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন ব্যর্থ হবে। এই অনৈক্য যদি চলতে থাকে এবং আমরা যদি জাতীয় স্বার্থকে আমাদের সবকিছুর ওপরে স্থান দিতে না পারি, তাহলে এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন কিন্তু ব্যর্থ হবে। আজকে এটা অত্যন্ত ক্লিয়ার (স্পষ্ট) যে এই ফ্যাসিবাদ যারা তৈরি করেছিল, তাদেরকে যদি আমরা একটি ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়ে না নিতে পারি, তাদের জবাবদিহি যদি আমরা নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে তারা সারা বাংলাদেশকেই আগামী দিনে গোপালগঞ্জ বানিয়ে ফেলবে।
মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর আবদুর রব বলেন, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারলে শহীদদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব হবে না। বিবাদ-বিভাজনের রাজনীতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে, জুলাইয়ের ঐক্য ধরে রাখতে হবে, না হলে ফ্যাসিবাদী শক্তি আবার ফেরত আসবে।
‘জুলাই অভ্যুত্থান’ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। এ আন্দোলনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল সর্বজনীনতা। যেখানে ভেদাভেদ ভুলে মানুষ একত্র হয়েছিল ও জীবন দিয়েছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের তরুণ-তরুণী, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া থেকে শুরু করে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিলেন এই অভ্যুত্থানে। বোরকা আবৃতের পাশে জিনস-টি-শার্ট পরা তরুণী একসঙ্গে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, রাজপথের কিশোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বনানী-গুলশানের তরুণের সঙ্গে, একযোগে। বিশেষ করে বিভিন্ন বয়সের নারীদের উপস্থিতি এই আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির কারণেই কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের বহুল ব্যবহৃত ‘সন্ত্রাসবাদী’ বয়ান কাজে আসেনি। গণতন্ত্রের পক্ষে, নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে, লুটপাটের বিপরীতে নিজেদের কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নিজেদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের মানুষ ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী জুলাইয়ে রাজপথে নেমেছিল। হাসিনা সরকারের পতনের পর জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার দরকার ছিল। কিন্তু সেই বোঝাপড়া তো হয়ইনি, বরং ক্ষমতা, নিজেদের সুবিধা, ভাগ নিয়ে দৃষ্টিকটু কাড়াকাড়ি পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে তা হাসিনাবিরোধী সর্বজনীন ঐক্যকেও বাধাগ্রস্ত করে তুলেছে।
এই সর্বজনীন ঐক্য বিনষ্ট হলে কার লাভ ও কার ক্ষতি, তার হিসাব-নিকাশও দরকার। চব্বিশের ছাত্র-জনতার সুদৃঢ় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা সদলবলে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক আটক হয়েছে। জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের সাথে জড়িত তাদের অনেকে এখন বিচারের সম্মুখীন। দাবি উঠেছে, আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের অপরাধের বিচার না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচন যেন না করা হয়। আবার এরূপ অভিমতও রয়েছে, নির্বাচন ও বিচারপ্রক্রিয়া একই সাথে চলতে সমস্যা নেই। কারো আশঙ্কা যে, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে। লক্ষ করা যাচ্ছে যে, পতিত আওয়ামী লীগাররা বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে নানাবিধ ফন্দিফিকির করছে। যার কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, আমরা একটি যুদ্ধাবস্থায় আছি। অশুভ চক্র আমাদের স্বপ্নকে, আমাদের ঐক্যকে ভেঙে দিতে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, গত জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ আবার নতুন করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসা জালিমের হাত থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মানুষ মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারছে। দেশের মানুষ কথা বলার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে এবং শান্তিতে স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারছে। পতিত সরকারের দোসররা এবং দেশের কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বিদেশী আধিপত্যবাদী শক্তির সহায়তায় ছাত্র-জনতার এ গণ-আন্দোলন ব্যর্থ করে দিতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা দেশকে আবার অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে এবং পতিত স্বৈরাচারকে ফিরিয়ে আনার অপতৎপরতা শুরু করেছে। এমতাবস্থায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। শান্তি ও স্বস্তির নতুন বাংলাদেশ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
রাজনৈতি বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এইচ আর এম রোকন উদ্দিনের ভাষায় বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আজ ঐক্যই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। জাতীয় ঐক্য মানে মতভেদের অনুপস্থিতি নয়- এটি মানে অভিন্ন লক্ষ্য ও দায়িত্বের উপস্থিতি। যদি সব রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী, নাগরিক সমাজ ও দেশপ্রেমিক জনগণ একসাথে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ নেয়, তাহলে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি- ‘হ্যাঁ, বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে- একটি ঘুঁটি নয় বরং একুশ শতকের একটি স্বাধীন, আত্মনির্ভর ও কৌশলগতভাবে দক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে। বাংলাদেশ এখন যে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি, তা জটিল ও বহুমাত্রিক। এসব চ্যালেঞ্জ অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং বহিরাগত হুমকি থেকে উদ্ভূত- যা আজ একে-অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, যেকোনো মূল্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য টিকিয়ে রাখতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। জাতীয় ঐক্যকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে চর্চা করতে হবে।
এনসিপির অন্যতম মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, জুলাইয়ের ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তির প্রতি আহ্বান- যে বিভাজনটা অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের মধ্যে এসেছে, সেই বিভাজনকে দেশ ও জাতির স্বার্থে মিটিয়ে ফেলতে হবে। এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এবং পতিত ফ্যাসিবাদের নগ্ন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তির জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। দেশ ও জাতির জন্যই এবার আমাদের এক হয়ে স্বদেশকে বিনির্মাণ করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য এই ঐক্য নয়, বরং আমাদের দেশের জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই।
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ‘ঐক্য বজায় রাখা’র আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, যেকোন মূল্যে বীরের এই রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা যেন বৃথা না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঐক্য বজায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের সামনে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, নতুন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার, তা আমাদের দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিরোধী লড়াইয়ে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য দেখা গিয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের এক বছর অতিক্রান্ত না হতেই সে ঐক্যে চিড় ধরার বিষয়টি প্রকাশ্যে। আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসতে আসতে সংস্কারের নানা ইস্যু, ভোটের সময়সীমাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে এই দূরত্ব আরও বাড়বে, এমনটা মনে করছেন সংগঠনগুলোর নেতারা। দেখা যাচ্ছে, প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি আলাদা ভাষায় কথা বলছে। একটি গণঅভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগ বিতাড়নেও এলো না ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐক্য। এ পরিস্থিতি জনগণের দিক থেকে নিঃসন্দেহে হতাশাজনক।