মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী

২০২৪ সালের জুলাই মাস ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বাঁক পরিবর্তনের সময়। দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা যখন রাজপথে নেমে আসে, তখন তাদের কাতারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন আলেম-ওলামা ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। এই ঐতিহাসিক গণজাগরণ ৩৬ দিন ধরে চলেছিল-যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশসহ দেশের ওলামায়ে কেরাম ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর সরকারি বাহিনীর গুলি, হামলা ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুরু হলে হেফাজতসহ আলেম-ওলামা সরাসরি অবস্থান নেয় ছাত্র-জনতার পক্ষে।

১৮ জুলাই ঢাকা, রংপুর, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশবাহিনী নিষ্ঠুরভাবে গুলি চালিয়ে ছয়জন ছাত্রকে হত্যা করে। এমন বর্বর হামলা মানবাধিকার ও ইসলামী নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই ঘটনায় দুঃখ ও ক্ষোভে আলেমসমাজ ও মাদরাসার ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সারা দেশে নিজ নিজ অবস্থান থেকে তারাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কারণ, কোন ধরনের জুলুম ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলাম সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে। কোটা সংস্কারের দাবির সাথে মাদরাসা ছাত্রদের কোন সম্পর্ক নেই। এই আন্দোলনটি ছিল জেনারেল শিক্ষার্থীদের নিজস্ব দাবি নিয়ে। জালেমশাহীর অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। আলেমসমাজ মনে করেছে, এটা জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই। তাই তারা মজলুমদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

এ আন্দোলনে শহীদ দেড় হাজারের অধিক এবং আহত হয়েছে ত্রিশ হাজারের অধিক ছাত্র-জনতা। এর মধ্যে কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক শহীদ হয়ছে ৮৭ জন। এক রক্তক্ষয়ী গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশ নতুনভাবে স্বাধীন হয়েছে। যুগান্তকারী এই ইতিহাস বিনির্মাণে অংশ নিয়েছে জাতি-ধর্ম-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ। বিশেষ করে মাদরাসা শিক্ষার্থী ও আলেম-উলামার অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করেছে আন্দোলনের গতিপথ।

হেফাজতের নেতৃবৃন্দ সংগঠনের ব্যানার ছাড়াই তাদের নেতাকর্মী ও মাদরাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকাজুড়ে এবং সারাদেশে সক্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে সাভার-আশুলিয়া, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, চট্টগ্রাম ২ নং গেইট, পটিয়া, হাটহাজারী, সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুর রাজশাহী, খুলনা নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী এলাকায় তারা গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাজপথে অবস্থান নেন। হেফাজতের নেতাকর্মী ও কওমী মাদরাসাগুলো আন্দোলনকারীদের খাবার, পানি, বিশ্রাম, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং জানাজা ইত্যাদিতে সহযোগিতাও করেন।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া ও দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্ররা ১৭ জুলাই সমাবেশ করে সরকারের প্রতি তিনটি দাবি তোলে- ১) যৌক্তিক কোটা সংস্কার; ২) ছাত্রদের ওপর হামলা ও হত্যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা; ৩) হামলাকারীদের বিচার নিশ্চিত করা।

তারা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেয়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। দারুল উলুম হাটহাজারীর ছাত্ররা চট্টগ্রাম- খাগড়াছড়ী নাজিরহাট মহাসড়ক অবরোধ করে। তারা ঘোষণা দেয়-“আর এক মুহূর্তও এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখা যাবে না।”

চট্টগ্রামের পটিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে অংশ নিলে পুলিশের গুলিতে ৭৩ জনেরও বেশি ছাত্র আহত হয়।

আন্দোলনে মাদরাসাগুলো কেবল নৈতিক সমর্থনই দেয়নি, তারা সরাসরি লজিস্টিক সহায়তাও করেছে। এর উজ্জ্বল উদাহরণ জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদরাসা। ঢাকার নতুনবাজার এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের দরজা উন্মুক্ত রাখা হয়। পানি, স্যালাইন, শরবত, শুকনা খাবার এবং বিশ্রামের ব্যবস্থাসহ টয়লেট ও ওজুর ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়। মাদরাসা ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রাস্তাঘাট পরিষ্কার, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, খাবার বিতরণ এমনকি আন্দোলনকারীদের আনা-নেয়ার কাজও করে। হাজার হাজার লিটার শরবত ও শত-শত প্যাকেট খাবার বিতরণ করা হয়Ñসবই মাদরাসার নিজস্ব উদ্যোগে। এসব তদারকি করেন স্বয়ং মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুনির হোসাইন কাসেমী সাহেব নিজেই।

অন্যদিকে, আলেমদের আন্দোলনপন্থী খুতবার কারণে দেশের বিভিন্ন মসজিদের ইমাম-খতিব চাকরি হারান। তবুও তারা থেমে যাননি। জুমার বয়ানে তারা ফেরাউনের পতন, মুসার বিজয়ের উদাহরণ টেনে রাষ্ট্রীয় জুলুমের বিরুদ্ধে জাতিকে সজাগ থাকতে আহ্বান জানান। অনেকে নির্যাতনের শিকার হন, কিন্তু তবুও থামেননি।

এই পুরো আন্দোলনে মাদরাসা ও ইসলামি শক্তির অংশগ্রহণ কেবল আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছিল নাÑএটি ছিল সংগঠিত, সুপরিকল্পিত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রতিরোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এরপর ১, ২ এবং ৪ আগস্টে ধারাবাহিক বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলাম সরাসরি ছাত্র-জনতার এক দফার “ঢাকা চলো” কর্মসূচির সাথে একাত্মতা ঘোষণাপূর্বক সবাইকে ঢাকায় ছাত্র-জনতার পদযাত্রায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। হেফাজত দেখিয়েছে, অরাজনৈতিক দল হওয়া সত্ত্বেও ন্যায়ের প্রশ্নে কখনো নিরপেক্ষ থাকা বা আপস করা যায় না।

পরিশেষে, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছেÑবাংলাদেশের ছাত্র সমাজ ও আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ হলে কোনো স্বৈরাচারই টিকে থাকতে পারে না। এ লড়াই ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, এ লড়াই ছিল নাগরিকদের আত্মমর্যাদার জন্য, এ লড়াই ছিল আল্লাহর জমিনে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য।

আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন-জুলুমের বিরুদ্ধে সবসময় সত্যের পাশে দাঁড়ানোর। আমিন।