এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী
জুলাই বিপ্লব জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের নাম। আত্মপরিচয় ও আত্মগৌরবে অভিষিক্ত হওয়ার উজ্জ্বল অভিযাত্রা ৩৬ জুলাই। স্বতন্ত্র জাতিসত্তার অভিধায় পরিচিত ও স্বকীয় চেতনার আলোকে জাতীয় পতাকা সমুজ্জ্বল করার দুর্বার এক স্বপ্ন। স্বাধীনতার গৌরবদীপ্ত ঘোষণার আরেক নাম, অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের এক রক্তিম অধ্যায়।
জুলাই অভ্যুত্থান কেবল আত্মদানের আর বেদনার গল্প নয়, গণমানুষের বিজয় ও সাহসের গল্প। নারী-পুরুষ সহ সমাজের আপামর জনতার মাঝে যে অভূতপূর্ব ঐক্য ও সম্মিলিত প্রত্যাশার প্রকাশ এই আন্দোলনে দেখা গেছে তা অকল্পনীয়। নারী ও পুরুষের মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আন্দোলন ধাপে ধাপে এগিয়েছে এবং সফলতার মুখ দেখেছে। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন বাংলাদেশের অকুতভয় নারীরা। পুরুষের সঙ্গে সমানতালে মাঠে সরব থেকে আন্দোলনকে চাঙা রেখেছিলেন বেশীরভাগই নারী শিক্ষার্থী। তারা ছিলেন এই আন্দোলনের প্রথম সারির যোদ্ধা। তাদের সাথে একাত্ম হয়ে গৃহিনী থেকে শুরু করে সমাজের সকলশ্রেণী পেশার নারীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। বাংলার সাহসী নারী সমাজ কখনো মা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, বোন, কন্যা ও ছাত্রী হিসেবে, একজন শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, নাট্য ও চলচ্চিত্র শিল্পী, কন্ঠ যোদ্ধা, কলম যোদ্ধা, শ্রমিক, মুটে-মজুর, গার্মেন্টস কর্মীসহ সকলে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী এ আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে বীর গাঁথা রচনা করেছেন। সংগ্রাম করেছেন, জীবন দিয়েছেন, ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শহীদ হযরত সুমাইয়ার মত শহীদের খাতায়ও তারা নাম লিখিয়েছেন।
শুধুমাত্র মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে মোট ১৩২ শিশু-কিশোর এবং ১১ জন নারী শহীদ হয়েছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ এ তথ্য দিয়েছেন। হতাহত হয়েছেন, চোখ হারিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন নাম না জানা শত শত মা বোন।
আমরা ইসলামের ইতিহাসে যদি চোখ বুলাই তাহলে দেখতে পাবোÑ নারীরা যে শুধুমাত্র জালিম ও জুলুমের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান রেখেছেন তা নয়, উম্মে আম্মারা, হযরত সুফিয়া এ খাওলার মত শত শত মহিলা সাহাবিরা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, মোটিভেশন দিয়েছেন, যুদ্ধ ক্ষেত্রে যুদ্ধাহত সাহাবিদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। বাংলাদেশে স্বৈরাচার জালিমের উৎখাতে, ন্যায় ও ইনসাফের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে ২৪ এর জুলাই বিপ্লবেও নারীদের অবদান পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলনা। ছাত্র-জনতর এ আন্দোলনে বিশ্ববাসী নারীদের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখেছে। ইসলামী আন্দোলনের আদর্শবাদী নারী সমাজসহ সমাজের সকল স্তরের সকল মতাদর্শের নারীরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধ ফুঁসে উঠেছিল। এমন মাতৃরুপী মমতাময়ী নারীদের সরকারী নির্মমতা ও পৈশাচিকতায় রাগে কাঁপতে দেখেছে, দুঃখে কাঁদতে দেখেছে, চরম দুঃসময়ে সহায়তার হাত বাড়াতে দেখেছে, আহত হতে দেখেছে, শুশ্রƒষা করতে দেখেছে। ইতিহাসে হুদায়বিয়ার সন্ধির সময়ে উম্মে সালামার মত বিচক্ষণতায় আন্দোলনের নীতিনির্ধারণ থেকে শুরু করে সশস্ত্র আক্রমণ মোকাবিলায় সকল ক্ষেত্রেই শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিলেন এদেশের নারী সমাজ।
নারীদের অসামান্য অংশগ্রহণ ২৪-এর আন্দোলনকে নিশ্চিত বিজয় এনে দিয়েছিল। নারীদের অংশগ্রহণই ছিল এই বিপ্লবের বিজয়ের নির্ধারক। স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা নেমে এসেছিলেন, নেমেছেন শ্রমজীবী নারী, এমনকি গৃহবধূরাও। সন্তানের পাশে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন তাদের রক্ষায়। ২৪ জুলাই আন্দোলনে মা-বোন, মেয়েরা যদি অংশগ্রহণ না করত হয়তোবা এত তাড়াতাড়ি এ বিজয় আসত না। ২০২৪-এর মতো সংগ্রাম বোধ হয় পৃথিবী আগে কখনো দেখেনি। নারীদের ত্যাগ ও নেতৃত্ব ছিল এবারের গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সাফল্যের অন্যতম মূল ভিত্তি।
২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমগ্র জাতিকে এক করেছিল। ২৪ সালের ১৪ জুলাই তৎকালীন ফ্যাসিষ্ট প্রধানমন্ত্রী এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে অবমাননাকর সম্বোধন করেন। তার সেই বিতর্কিত ও কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্যে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হল ও বেগম রোকেয়া হলের ছাত্রীরা। ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠা ওই ছাত্রীরা হলের গেট ভেঙে রাস্তায় নেমে আসেন, আর তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় এক ঐতিহাসিক স্লোগান- ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’
▪ বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে নারীরা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে:
বিশেষ করে ২০১৮ সালের ঐতিহাসিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা দেখেছি নারী শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের গেট ভেঙে আন্দোলনে বেরিয়ে আসে। তাদের এই সাহসই আন্দোলনকে বেগবান করার সাহস যুগিয়েছিল আমাদের। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবেও নারীরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নারীদের এই অবদান কোনোভাবেই ভোলার নয়। গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিল বৈষম্যমুক্ত সর্বজনের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের আকাক্সক্ষা। এই আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল বিশাল। এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, শুধু পুরুষদের জন্য না, নারীদের। সক্রিয় উপস্থিতি ও অংশগ্রহণে এই আন্দোলন সফল হয়েছে।
যখন ছেলেরা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাদের অনেকে জেলে বন্দি ছিলেন, তখন নারীরা রাজপথের আন্দোলনে সম্মুখভাগে চলে অসেছিলেন আবার কেওবা স্বামী সন্তানকে মাঠে নীমিয়ে দিয়ে পরিবারকে আগলে রেখেছিলেন। এ আন্দোলনে আমাদের মা, বোন, মেয়েরা যদি অংশ না নিতেন, তাহলে স্বাধীনতার স্বপ্ন অধরাই রয়ে যেত। জুলাই বিপ্লবে আমাদের বোনেরা ওহুদের যুদ্ধের মত একদিকে মাঠের যোদ্ধাদের জন্য পানি সরবরাহ করেছেন, খাবার রান্না করে এনেছেন, কখনো মানব ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন।কখনো রোযা রেখে, জায়নামাজ চোখের পানিতে মহান রবের কাছে ধর্না দিয়েছেন। অনেক নারীরা লীগের গুন্ডাবাহিনীর বলাৎকারের শিকারেও পরিণত হয়েছেন।
▪ ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এক কালো দিন:
এদিন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলা ও নির্যাতনের ফলে শত শত নিরপরাধ ছাত্র-ছাত্রী রক্তাক্ত হন। ঢাবিতে যখন স্বৈরাচারের ছাত্র সংগঠন পাষণ্ডরা শিক্ষার্থীদের উপর যখন ইতিহাসের বর্বরতম হামলা চালাচ্ছিলÑ আমরা দেখেছি, সেদিন কিভাবে ভাইকে রক্ষায় বোনেরা সামনে দাঁড়িয়ে গেছেন। নারী শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছিলেন, তাঁরা কেবল নিজেদের অধিকারের জন্য নন, সহপাঠীদের রক্ষার জন্যও প্রাণপণে লড়াই করতে প্রস্তুত।
বিজয় একাত্তর হলে সরকারদলীয় ক্যাডাররা বেশ কয়েকজন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীকে আটক করে রাখে। এ খবর শুনে বিক্ষোভকারীরা তাঁদের মুক্ত করার জন্য হলে এগিয়ে যান। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই, হলের ছাদ থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করা হয়। এরপর তারা লাঠি, রড, এবং অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে সরাসরি আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়।
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এক বিরল দৃশ্যের অবতারণা হয়, যেখানে নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীরা একে অপরের জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়ান। যখন সন্ত্রাসীরা নারী শিক্ষার্থীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে, তখন পুরুষ শিক্ষার্থীরা তাঁদের রক্ষা করতে ছুটে আসেন। আবার যখন পুরুষ শিক্ষার্থীরা হামলার শিকার হন, তখন সাহসী নারী শিক্ষার্থীরা তাঁদের আশ্রয় দেন।
ফ্যাসিস্ট সরকারের চোখ রাঙানি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর্যুপরি গুলির সামনে বুক চিতিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমাদের সাহসী নারীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডাকে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত মাঠে নেমে পড়েছিলেন ছাত্রীদের সাথে নারীসমাজ। বুলেট-বোমার সামনে তারা ছিলেন নির্ভীক। গুলিবিদ্ধ খাদিজা আক্তার তিনি বলেন- ‘চোখের সামনে একটি ছেলেকে কন্ঠনালীতে গুলি করে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে বুক চেপে ঘাড়টি মটকে দেয়া হয়। এমন নৃশংসতা দেখে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়, পরিবারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ময়দানে দ্বিগুন গতিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।’
এক কথায় বলা যায়, আন্দোলনে একটি বড় শক্তির জায়গায় স্থান করে নিয়েছিলেন দেশের সাহসী নারীরা। গুম হওয়া ব্যারিষ্টার আরমানের স্ত্রী তাহমিনা ইয়াসমিন জানায়Ñ দীর্ঘ ৮ বছর পরিবারকে প্রায় গৃহবন্দী করে রেখেছিল। প্রায় যৌথ বাহিনী এসে বাসায় হানা দিত। তাদেরকে মানসিক টর্চার করা হতো। এর মাঝেও তারা এ আন্দেলন দেখে সাহসে বুক বেঁধেছিল।
▪ আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পেশাজীবী নারীরা ছিলেন সমান সক্রিয়:
২ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগ ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌসের প্রতিবাদী আগুনঝরা কণ্ঠে শুনেছি আমরা। তিনি পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমার ছাত্রের মুখ চেপে ধরার সাহস কে দিয়েছে আপনাকে?’ ‘আমার ছাত্রের কলার ধরার সাহস কে দিয়েছে আপনাকে? আসেন, চালান গুলি, তুলে নিয়ে যান, সেই ১৯৭১ সালের মতো ২৬-এ মার্চের কালো রাত, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা শুনেছি তো, এখন বাস্তবে তা দেখছি।’
৩ আগষ্ট ‘আন্দোলন- ফীড ব্যাক মূল্যায়ন’ এর উপর সেনা দপ্তরে যখন এক ভার্চুয়ালী মতবিনিময় অনুষ্ঠান শুরু হয় তখন তরুন সেনাদের ৬/৭ জনের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর বক্তব্যে রাজশাহীর মেজর হাজেরা জাহানের আবেগ ঘন বক্তৃতায় বলেন- দেশের সব মাকে মৃত্যু স্পর্শ করেছে এবং সব মা কাঁদছেন। তিনি নারী ও শিশুদের প্রতি আক্রমনের ব্যাপারে নযায় বিচারের দাবী জানান, দেশের জনগনের সেনা বাহীনির প্রতি অসন্তোষ বৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্যেগের কথা জানান। মূলতঃ তার এ বক্তৃতার মাধ্যমে শেখ হাসিনার স্বৈরাচার সরকারের বিদায়ী ঘন্টা বেজে যায়।
শিক্ষার্থীদের পুলিশের লাঠিপেটা ও গ্রেপ্তার থেকে রক্ষা করার জন্য নিজেকে ঢাল হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রভাষক ও বর্তমান সহকারী প্রক্টর শেহরীন আমিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেশের সর্বস্তরের নারীদের অভূতপূর্ব উপস্থিতি ছিল। নারীরা এ সময় যেমন রাজপথের লড়াইয়ে সক্রিয় থেকেছেন, তেমনি সোচ্চার থেকেছেন অনলাইনে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা যেমন এ আন্দোলনের সম্মুখভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি শিক্ষার্থী-জনতার দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ঘরে-বাইরে-প্রবাসে নারীরা প্রকাশ্য রাজপথে ও অনলাইনে সোচ্চার থেকেছেন।
▪ আন্দোলনের একটি বড় অংশ মায়েরা তাদের সন্তানের হাত ধরে নেমে এসেছিলেন রাস্তায়:
আন্দোলনের সময় এক অসুস্থ মা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলছিলেন, ‘বাবা, আমি অসুস্থ, তাই তোমাদের সঙ্গে যেতে পারছি না। তোমাদের জন্য দোয়া করেছি, তোমরা বিজয় নিয়ে আসবে।’ অনেক মা তাদের কোলের শিশুদের নিয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘আমার তো বড় কোনো সন্তান নেই, তাই এই কোলের শিশুকে নিয়েই আন্দোলনে এসেছি।’
অনেক ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশের সঙ্গে নারীরা তর্ক করছেন। তারা শক্তিশালী যুক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আন্দোলনের কণ্ঠস্বর হয়ে দাঁড়ানো এই অসম সাহসী নারীর অনেকেই শেষপর্যন্ত মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন। সরকার পতনের দিন ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে সাভার থানা রোডে নিহত হন নাফিসা। একই দিনে বেলা ১১টায় গাজীপুরের ২ নম্বর ওভারব্রিজের কাছে মিছিলে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান রিতা আক্তার। হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে নিহত হয় নারায়ণগঞ্জের বাসার ছাদে খেলতে থাকা মাত্র ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ। উত্তরাতেও হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে প্রাণ হারায় দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাইমা সুলতানা।
▪ জুলাই বিপ্লবে নূসরাত নূর-ভাইয়ের জন্য বোনের প্রতিবাদ প্রতিরোধের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়:
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান টুম্পা নামে এক তরুণী পুলিশের প্রিজনভ্যানের পথ রোধ করে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে সাহসিকতার অন্যতম এক প্রতিচ্ছবি। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাইকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রিজনভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন নুসরাত। নূসরাতের মত নারী শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছিলেন, তাঁরা কেবল নিজেদের অধিকারের জন্য নন, সহপাঠীদের রক্ষার জন্যও প্রাণপণে লড়াই করতে প্রস্তুত।
জুলাইয়ের শেষদিনে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি সফল করতে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন সেই আন্দোলনে। হাইকোর্টের সামনে জড়ো হতেই পুলিশের অতর্কিত হামলা। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে হাইকোর্ট এলাকা থেকে নূর আলম হাসানকে পুলিশ ধরে নিতে চাইলে, নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে প্রতিরোধ করেন নুসরাত। এমনকি নূর আলমকে ভ্যানে তোলা হলে প্রিজনভ্যানের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ান তিনি। সাহসী এই তরুণী চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আমার ভাইকে ধরে নিয়ে যেতে হলে আমার লাশের ওপর দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার ভাইকে ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে এক ইঞ্চিও নড়ব না।’
নুসরাতের সেই অদম্য সাহসিকতার গল্প দেশের অনেকেরই জানা। নুসরাতের সাহসিকতায় সেই সময় আটক হওয়া শিক্ষার্থী নূর আলমও বিস্মিত হন। তিনি বলেন, ‘নুসরাতের মতো এমন সাহসী বোনদের জন্যই বাংলাদেশ দেখেছে এক নতুন সূর্য। সেদিন সে আমাকেই শুধু অবাক করেনি, পুরো বাংলাদেশ ও বিশ্ব তার সাহসিকতায় অবাক এবং বিস্মিত।’
▪ অভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো:
৫ আগস্ট টঙ্গীতে এইচএসসি পরীক্ষার্থী নাফিসা হোসাইন মারওয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। বেলা দুইটার দিকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তিনি বাবাকে ফোনে বলেছিলেন, ‘আব্বু, আমি মারা যাচ্ছি। লাশটা নিয়ো।’ এই কথাগুলোই বলে দেয়, নারীরা কী পরিমাণ সাহস ও প্রতিজ্ঞার সঙ্গে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী সেদিন দৃঢ় প্রত্যয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের একটি মেধা পড়লে ১০টি কোটা গিলে খাব। গিলে খাব মানে গিলে খাব। বাবাকে বলে এসেছি, যদি মরে যাই বিজয়ের পর যেন আমার লাশ দাফন করা হয়।’
এই অভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রীরা সবকিছু ভঙ্গ করে হল থেকে, ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আন্দোলন চলাকালীন একজন ছাত্রী বলেছে, ‘আমার পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা, পেছনে ফিরলেই পুলিশ গুলি করবে। সুতরাং আমরা স্বাধীনতার দিকেই অগ্রসর হব।’ একজন নারীর মুখ থেকে বের হওয়া এই বক্তব্যটি পুরো জাতির জন্যই একটি আইকনিক স্টেটমেন্ট। এটা যে কত বড় কথা, যে কথাটি এই নারীর মুখ থেকে বেরিয়েছে। এই কথাটি পুরো জাতির জন্য প্রযোজ্য। জুলাইয়ের সেই সাহসী ও দেশের জন্য আত্মত্যাগী সে সব নারীর প্রতি প্রকৃত সম্মান, আসনে বসাতে হবে জাতিকে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে যেসব নারী শিক্ষার্থী অগ্রভাগে ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেনÑ উমামা ফাতেমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই অন্যতম সমন্বয়ক উমামা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরুতে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম ছিল। কিন্তু সময় যত গড়ায়, বিশেষ করে জুলাই মাসে যখন মূল আন্দোলন শুরু হয়, তখন ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রী হল থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে গ্রন্থাগারের সামনে এসে জড়ো হতেন এবং সেখান থেকে শাহবাগ মোড়ে যেতেন। পরবর্তী সময়ে পুরো আন্দোলনের গতিমুখ নির্ধারিত হয়েছে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের কারণে।
উমামা ফাতেমা বলেন, নারী শিক্ষার্থীরা যদি এত ব্যাপক হারে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা না রাখতেন, তাহলে আন্দোলনের ওপর অত্যাচারের মাত্রাটা অনেকখানি বেড়ে যেত এবং আন্দোলন সফল না হওয়ারও আশঙ্কা ছিল। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের মেয়েরা এমন শক্তি দেখিয়েছেন, যা অন্য কোনো দেশের মেয়েরা এখনো দেখাতে পারেনি।
জুলাইয়ের আরেক অগ্নিকন্যা ফারজানা সিঁথি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় বেশ কয়েকবার আলোচনায় এসেছিলেন, বিশেষ করে একজন সেনা কর্মকর্তার সাথে তর্কে জড়িয়ে জুলাইয়ের বাঘীনি নামে ভূষিত হয়।
জুলাইয়ের বিজয়ী কন্যা মোহসিনা তাইয়্যেবা- সে ঢাবির রসায়নের ছাত্রী। অনন্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি বলেন- “আমরা ১৫ বছর ধরে এমন ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছিলাম যে, কেও প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। কিন্তু ১৫ জুলাইয়ের নারকীয় হামলার ঘটনার পর থেকে হলের ছেলেমেয়েরা সবাই রাস্তায় নেমে আসে। ১৬ জুলাইয়ে ৬/৭ জন শহীদ হয়।”
▪ জুলাইয়ে নারীরা হিমালয়ের মত দাঁড়িয়েছিল : অগ্নিকন্যা তামান্নার শ্লোগান ছিল প্রতিবাদের আগুনে ঘী ঢালার মত-
“কে এসেছে কে অসেছে?
পুলিশ এসেছে—
কি করছে—
স্বৈরাচারের পা চাটছে।”
দুই বোন মিতু আর মিমের কাঁধে তাদের একমাত্র ভাইয়ের লাশ। স্বৈরাচারের লেজুড় সংগঠন টুডেন্টস এগেইনস্ট সভেরেন্টির সন্ত্রাসী হামলায় দমে না যাওয়া আরেক অগ্নিকন্যা শ্রেষ্ঠা। তার মাথার দুই জায়গায় ৬ ইঞ্চি করে মোট ১২টি সেলাই লেগেছিল এবং পা-ও ভেঙ্গে গিয়েছিল। তারা শ্রেষ্ঠাকে টার্গেট করে মেরেছিল। সবাই যখন নিজের প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াচ্ছিলো শ্রেষ্ঠা তখন ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো। একজন নারী শিক্ষার্থীর উপর এমন হামলা ছিল কাপুরুষতার শামিল। জুলাই আন্দোলনের সময় সে মোহাম্মদপুর থেকে ঢাবিতে এসে আন্দোলন করেছে। শ্রেষ্ঠার ছোট ভাইকেও মোহাম্মদপুরের কাউন্সিলর তুলে নিয়ে সারাদিন নির্যাতন করেছিল।
চলচিত্রশিল্পী আজমেরী হক বাঁধন বলেন- ৫ আগষ্ট পরিবারের সবাই যখন বাঁধা দিচ্ছিল বের হতে তখন বলেছিলাম- তোমরা আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো! আজ না গেলে আমি নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবোনা। বেরিয়ে পড়লাম। একহাতে স্টেইলেস স্টিলের একটি লাঠি, আরেক হাতে বাংলাদেশের পতাকা। মুখে হিযাব, চোখে কান্নাÑ সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত দীপ্তি আমার চোখে মুখে।
দুপুর দেড়টার দিকে ফোনে এক বন্ধুর কাছে প্রথম শুনতে পেলাম হাসিনা পালিয়েছে- ‘কেউ আনন্দে কাঁদছিল, কেউ চিৎকার দিয়ে শ্লোগান দিচ্ছিল। মুক্তির স্বাদ, এই কান্না , এই সাহস এই সবকিছু নিয়েই জুলাই-আগষ্ট’
৩৬ জুলাইয়ে বিপ্লব সফল হবার পেছনে ছিল এমন হাজারো নারীর ত্যাগ আর কুরবানীর অনন্য উপাখ্যান। নারী সমাজের এ অবদানকে অবশ্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। নারীদের এই সাহস এবং শক্তিকে বিশ্বমানবতার কল্যাণে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে একটি টেকসই স্থিতিশীল উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব। জুলুমতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীদের এ অসামান্য অংশগ্রহণের বিষয়টি যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। ইতিহাসের স্মরণীয় অংশ হিসেবে স্থান দিতে হবে।
মহান আল্লাহ্ আমাদের এ বিজয়ের কাক্সিক্ষত স্বপ্নকে সমুন্নত রাখার তৌফিক দিন।
নির্বাহী সদস্য,
লিগ্যাল এইড বাংলাদেশ।