মুহসিনা তায়্যিবা
দেশের পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন থাকলেও আন্দোলন-সংগ্রামে আগে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা হয়ে ওঠেনি। ছোটো থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভোকাল হওয়া, সোশ্যাল মিডিয়া হোক, হোক রাস্তায়, অন্যায় দেখার সাথে সাথে তা প্রতিরোধ, প্রতিবাদ করা একটা সময় ভুলেই গেছিলাম। আওয়ামী লীগ সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে ২৪’ এর জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের সেই প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে যেন জীবন্ত করে তোলে।
২০২৪ সালের ১৫ জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নিরস্ত্র সহপাঠী ওপর ছাত্রলীগের নারকীয় হামলা হলো। ১৬ জুলাইয়ের ৬ জন শহীদ হওয়ার পর ঢাবিতে যে গায়েবানা জানাজা ও প্রতীকী কফিন মিছিলের কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়, তা থেকে আমার বিরত থাকা সম্ভব ছিলনা। যদিও লীগ তখন ফুল ফর্মে ছিল, কে কোন পক্ষে তা নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না এবং কাকে বিশ্বাস করবো, কাকে করবো না, সে সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার পরেও বাসায় বসে থাকা সম্ভব হয়নি। আমাদের ক্লাসের এক সহপাঠী তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, মামলা, হামলার ভয় দেখাতে শুরু করে। মনে হতে লাগলো, দিনে দুপুরে এইভাবে অন্যায় করতে থাকা মানুষগুলো কিভাবে পাড় পেয়ে যাবে! আর আমার নিরপরাধ, কেবল ন্যায়ের জন্য লড়ে যাওয়া ভাই-বোনগুলো, তাদের পরিবারের পরিণতি কি এই হিংস্রতার শিকার হবে। আমাদের কি কিছুই করার নেই? ইতিহাসের অন্ধকার জগতের মধ্যে হারিয়ে যেতে চাইনি, চাইনি কোনো নিরপরাধ ন্যায়প্রত্যাশী মানুষের নির্মম পরিণতি। কিন্তু, এই নগণ্য ভীতু মানুষ হয়ে আমি কি করতে পারবো? মৃত্যুর ভয়, আহত হওয়ার ভয় মামলার ভয়, এবং একটা মেয়ের মধ্যে আর যত কিছু হারানোর ভয় থাকে, সবই আমার মধ্যে ছিল।
১৭ই জুলাই। দিনটা আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। একটা দিন আর কিছু শব্দগুচ্ছ। চারপাশে যখন থমথমে পরিস্থিতি, ক্যাম্পাসে প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা, বিজিবি, পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের অবস্থানÑ তখনও আমার মনে এক দৃঢ় সংকল্প ছিল। ১৫, ১৬ জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিবাদ কর্মসূচি হিসেবে শহিদদের গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের ডাক দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজু ভাস্কর্যে ঘোষিত এই কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার তাগিদ আমাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। সঙ্গীর অভাবে একাই আসি। পরিস্থিতি অনুকূল নয়, মনে ভয় ঢুকতে শুরু করে। তবে, মেট্রোরেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে নামার সময় ২-৩ জন আপুকে দেখে আমার ভীত মনে কিছুটা সাহস আসে। নিচে নামতেই ঘিরে ধরা ২-৩ জন বিজিবির প্রশ্ন কোথায় যাচ্ছেন? এখন কোথাও যাওয়া যাবে না। ফেরত যান। আমি ভীত। তবে, পাশের আপুর দৃঢ় কণ্ঠে, “আমার ‘হল’ এ আমি কেন যেতে পারবো না?” এই শব্দগুলো আমার মনে নতুন করে শক্তি জোগায়। মেট্রো থেকে টিএসসি, রোকেয়া হল হয়ে ভিসি চত্বর পর্যন্ত প্রতিটি পয়েন্টে আমি দেখলাম সারি সারি বিজিবি ও পুলিশ সদস্য, রাজু ভাস্কর্যও তাদের দখলে। ভিসি চত্বরে স্বল্প সংখ্যক মানুষের ভিড়ে লাঠি হাতে নিলাম, মাথায় পতাকা বাঁধলাম। গায়েবানা জানাজার পর আমরা পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালনের জন্য স্লোগান দিতে দিতে রাজুর দিকে অগ্রসর হলাম। কিন্তু মাত্র দুই মিনিট এগোতেই বিকট শব্দে ককটেল, টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেডের আঘাতে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। ভয় পাই, নিজের জীবন নিয়ে ভয় পাই। দিশেহারা হয়ে আমিসহ কয়েকজন কলাভবনে আশ্রয় নেই। প্রথমে টিয়ারশেলের ঝাঁঝে চোখ জ্বালা করছিল, সাথে ছিল জীবনের ভয়, এই না গুলি করে বসে, ঠিক সেই সময় এক আপু জোড় গলায় বলে উঠে, “আল্লাহর গজব পড়বে, গজব”। শব্দগুলোর ভার এতো বেশি ছিল, এরপর নিজের জীবন নিয়ে এ অব্দি আর দ্বিতীয়বার চিন্তা করিনাই। নিজের ঝং ধরা বিবেক যেন শাণিত হয়েছিল, যেই ধার অনুভব করছিলাম সেই মুহূর্তে। এই স্বাদ পেয়েই মানুষ আসলে বিপ্লবী হয়ে উঠে। আস্তে আস্তে টের পাচ্ছিলাম। চিন্তা হলো, বেঁচে থাকার জন্য না, উলটো কিভাবে আমি সবার হয়ে কাজ করে যেতে পারি।
সেই শুরু, এরপর ১৮ই জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমার সক্রিয় অংশগ্রহণ চলমান থাকে। ইন্টারনেট শাটডাউনের মধ্যেও বাইরের দেশের পরিচিতদের মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়াকে অনবরত ইমেইল করা এবং সর্বাত্মভাবে নিজেদের সংগঠিত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি মিরপুরের রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে গেছি। ৫ই আগস্টের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে বাবার বারণ সত্ত্বেও আমার যুক্তি ছিল একটাই: “আমি যদি আজ না যাই, আমার ভাই-বোনগুলো তো যাবে, ওদের বিশ্বাস ছিল আগের মানুষদের পাবে। এখন কি করে আমি তাদের সাথে এই প্রতারণা করি?” আলহামদুলিল্লাহ। আমরা এ যাত্রায় সফল হই, দ্বিতীয় স্বাধীনতা পাই। তবে, একটা দুঃখ আছে, দুঃখ’টা হচ্ছে, আল্লাহ এবার আমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করলেন না।আমাদের এই গণঅভ্যুত্থানকে সফল করার পেছনে রয়েছে দেশের আপসহীন যোদ্ধাদের অবদান; তাঁদের জীবন, সময়, শ্রম, চিন্তা, কৌশল এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমেই এটি সম্ভব হয়েছে। আর তাঁদের প্রতি আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ এবং অবশ্যই অবশ্যই আল্লাহর অশেষ রহমত ছিল।
তবে, বর্তমানে জাতীয় ঐক্যের ভাঙন, বিচার ও অনুসন্ধানের অভাব, দুর্নীতির নতুন চিত্র, আওয়ামী লীগের বিচারের অগ্রগতিহীনতা, গণমানুষের আস্থা সংকট, এই বিষয়গুলো দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটকে জটিল করে তুলেছে। এইসব পরিস্থিতিই আজকাল হতাশ করে তোলে। অথচ জুলাই এ আমাদের স্পিরিট ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীন হওয়া। এই স্পিরিটকে পূণরুজ্জীবিত করতে হবে, লালন করতে হবে। ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে ধৈর্য্য, একতা, চিন্তাশীলতা, বিচক্ষণতা, সহনশীলতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোসহীন অবস্থান এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণকে ত্বরাণ্বিত করবে, ইনশাআল্লাহ।