রাইসা রিফাত জুইন

জুলাই বিপ্লব এ দেশের আপামর জনতার বিপ্লব। নির্দিষ্ট কোনো দল মত নয়, দেশের সব মতের, সব ধারার মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদানে জুলাই এ এক অভাবনীয় বিজয় এসেছে।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। প্রতিটি আন্দোলনই ২৪ এর জুলাই বিপ্লবকে রসদ জুগিয়েছে। কিন্তু জুলাইয়ের নিজস্বতা ছিল দেশের সব শ্রেণি পেশা, দল মতের অংশগ্রহণ। মিলিত ঐক্য ও সংহতিই জুলাই আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে রূপদান করে।

জুলাই এর সবচেয়ে আইকনিক ছবি শহীদ আবু সাঈদের প্রসারিত দুই হাত। এই আবু সাঈদ একেবারেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আবার আন্দোলনে ফারহান ফাইয়াজের মত উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও ছিল, হয়েছে শহীদ। ছিল প্রাইভেট ভার্সিটি পড়ুয়া সমাজের এলিট শ্রেণি বলে পরিচিত পরিবারের সদস্যরাও। রিক্সাচালক, গার্মেন্টস শ্রমিক যেমন ছিল তেমনি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ছিল ভবঘুরে নাম না জানা ঠিকানাহীন, কেউ আবার ছিল বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া। কেউ কৃষকের সন্তান, কেউ বা আবার রাজপথে অস্ত্র হাতে দাপিয়ে বেড়ানো পুলিশের সন্তান।

সম্মুখ সমরের যোদ্ধাদের পেছনে ছিল পুরো একটা দেশ, একটা জাতি। যে নারী রাজপথে নামতে পারেনি, তিনি ঘরে রান্না করে রেখেছেন, যাতে তার ক্ষুধার্ত অচেনা সন্তানেরা লড়াই এর ফাঁকে একটু খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে আবার ফিরতে পারে লড়াইয়ে। কেউ বাসার সামনে রেখেছেন পানির বোতল। এ আশায় যে কোনো যোদ্ধা হয়ত পিপাসার্ত হয়ে এ পথে যাবে, আর এক ঢোক পানি পান করে নেবে।

জুলাই একদিকে দেখিয়েছে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের অবিশ্বাস্য বর্বরতা, অন্যদিকে দেখিয়েছে মানবিকতার অনন্য বিজয়। সাভারে রিক্সাচালক রনির বুকে গুলি লাগলে কয়েকজন সহযোদ্ধা ছুটে যান তাকে উদ্ধার করতে। আহত, প্রবল কষ্টে আড়ষ্ট রনি বলেননি, ভাই আমাকে বাঁচান। বরং বলেছেন, সামনে আরেকটা বাচ্চার পায়ে গুলি লাগছে। আমি এমনিতেও বাঁচব না। আপনারা ওরে বাঁচান। এ যেন মুতার প্রান্তরে নিজে পানি পান না করে অপর ভাইয়ের জন্য ছেড়ে দেয়ার প্রতিযোগিতার অনুরূপ।

স্বৈরাচারের অস্ত্রধারী বাহিনী যত বেশি পৈশাচিক আক্রমণ করেছে তত ঐক্যবদ্ধ হয়েছে গোটা জাতি, তত বেশি দৃঢ় হয়েছে মনোবল। প্রথমে ছাত্ররা, তারপর একে একে শ্রমিক, পেশাজীবী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সব শ্রেণির মানুষ জড়ো হয়েছেন আন্দোলনে। এক সময় পুলিশে ভয় ছিল অনেকের। কিন্তু জুলাই দেখালো পুলিশ ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে বাধা দেয়া যায় অন্যায় গ্রেফতারে। প্রিজন ভ্যানের ফাঁক দিয়ে দ্রোহের আগুনে জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখ যেন পুরো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল।

জুলাই শুধু গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের একটি মাস নয়। জুলাই বাংলাদেশের আপামর জনতার ঐক্য, ত্যাগ আর সাহসের প্রতীক। জুলাই সকল জালেম, দেশ ও মানবতাবিরোধী শক্তির জন্য এক অমোঘ সতর্কবার্তা- যতবার এই দেশকে নিয়ে কেউ ষড়যন্ত্র করবে ততবার জুলাই ফিরে আসবে তার দ্রোহ আর ঐক্যের রূপ নিয়ে।

শিশু সংগঠক