মাহমুদ শরীফ
ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের লক্ষ্যে ছাত্রজনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৭ জন শহীদ হয়েছেন। এ সময় অন্তত এক শতাধিক আহত হয়েছেন। সবাই পুলিশ ও আওয়ামীলীগের গুলিতে শহীদ ও আহত হন। নিহতদের পরিবারে কান্নার রোল থামছে না। আহত অনেকেই অর্থাভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না।
নিহত ৭ জনের মধ্যে রিক্সা চালক, শ্রমিক, কাঠমিস্ত্রী ও ছাত্র রয়েছে। প্রতিটি পরিবারই অস্বচ্ছল বলে জানা গেছে। একজন ছাড়া সবাই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে নিহত হয়। শহীদদের মধ্যে দুইজন জামায়াত কর্মী, দুইজন বিএনপি কর্মী, একজন ছাত্র শিবির কর্মী, একজন ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ও একজনের কোন দলের সাথে সম্পৃক্ততা ছিল না বলে তথ্য পেয়েছে দৈনিক সংগ্রাম। ছয় জন গত ৫ জুলাই শহীদ এবং বিভিন্ন দিনে আহত হয়েছেন অন্যরা।
ঢাকার সাভারে মিছিলে যেয়ে শাহাদাত বরণ করেন কুমারখালী উপজেলার সুলতানপুরের ব্যাংকার মহিউদ্দিনের ছেলে মেধাবী শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। তিনি সাভার সরকারি কলেজের ছাত্র ছিলেন। পুলিশ তাকে মেরে গাড়ী থেকে ফেলে দিয়েছিল, সেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। একই এলাকায় মিছিলে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন বিএনপি কর্মী রিক্সা চালক জামাল উদ্দিন শেখ। তিনি কুমারখালীর ভাড়রা গ্রামের আজগর আলী শেখের ছেলে। তিন সন্তানের জনক ছিলেন জামাল উদ্দিন। চিটাগাং রোডের শিমরাম মোড়ে মিছিলে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন জামায়াত কর্মী কাঠ মিস্ত্রি আব্দুস সালাম। তিনি কুমারখালীর চরভবানীপুর গ্রামের সরোয়ার বিশ্বাসের ছেলে। একই সময় পুলিশের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন অপর জামায়াত কর্মী উপজেলার কশবা গ্রামের ইজাই হোসেনের ছেলে শ্রমিক আলম হোসেন। এই চিটাগাং রোডের শিমরাম মোড় এলাকায় এসময় গুলিতে আরো শহীত হন নিরপেক্ষ কাঠ মিস্ত্রি সেলিম মন্ডল। তিনি চর ভবানীপুরের ওহাব মন্ডলের ছেলে। এছাড়াও ৫ জুলাই ঢাকার আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া মাদ্রাসার ছাত্র হাফেজ জুবায়ের আহমাদ ঢাকার খিলগাঁওতে পুলিশের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন। তিনি কুমারখালীর চাপড়া গ্রামের কামাল উদ্দিনের সন্তান ছিলেন।
৪ জুলাই কুমারখালীতে বিক্ষোভে এসে আহত হয়ে কয়েকদিন পরে হাসপাতালে মারা যান খোকসা উপজেলার ওসমানপুরের মাহিম উদ্দিন।
এছাড়াও জেলা শহর কুষ্টিয়া ও কুমারখালীতে মিছিলে যেয়ে বিভিন্ন সময় পুলিশের গুলি ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের আঘাতে আহত হয়েছেন বহু ছাত্র জনতা। দৈনিক সংগ্রাম অন্তত ৩৫ জনের নাম পরিচয় পেয়েছে। আহতরা প্রায় সবাই জামায়াত-শিবির ও ছাত্রদলের নেতা কর্মী।
কুমারখালী বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, হলবাজার এবং কুষ্টিয়া জেলা শহরের সদর থানার সামনে, মজমপুর গেট, চৌড়হাস মোড় ও পাঁচ রাস্তার মোড় ও ঢাকার মাওনা এলাকায় তারা আহত হয়েছিলেন। আহতরা অনেকেই শারীরিক সমস্যা নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। শরীরে অসংখ্য র্ছরা গুলি লেগেছে তাদের।
কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে একমাত্র কুমারখালীতেই উপজেলা পর্যায়ে জুলাই আন্দোলন হয়েছে, যা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। মাত্র দুইজন তরুণ বিবেকের তাড়নায় আন্দোলনের ডাক দেন। আসাদুজ্জামান খান আলী ও কামরুজ্জামান সোয়াদ নামের এই দুই তরুণ ১৬ জুলাই রংপুরের আবু সাইদের মৃত্যু ও ঢাকায় পুলিশ-আ’লীগের তান্ডব দেখে কোটা আন্দোলনের ব্যানারে ব্যক্তিপর্যায়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
স্থানীয় ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও তারা আহ্বান করে। তৎকালীন কুমারখালী উপজেলা ইসলামী ছাত্র শিবির সভাপতি ইসরাইল হোসেন উর্ধ্বতন নেতাদের পরামর্শে কর্মীদের আন্দোলনে যোগ দিতে নির্দেশনা দেন। খোলা হয় একটি হোয়াটসআপ গ্রুপ। ছাত্র নেতারা মাত্র কয়েকজন এই গ্রুপে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গ্রুপে যারা সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম তিহা, তানভীর, কাজল আফ্রিদী, সোহাগ, রফিকুল ইসলাম লিয়ন প্রমূখ।
কুমারখালীর আন্দোলনে ইসলামী ছাত্র শিবির ও ছাত্রদলের স্থানীয় নেতারা সামনে আসেননি কৌশলগত কারনে। পিছন থেকে সব ধরনের বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছে সারাক্ষণ। পাশ্ববর্তী খোকসা উপজেলার ছাত্রসংগঠনও কুমারখালীর সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়, যা ভিন্নমাত্র যুক্ত হয় বলে অনেকেই মন্তব্য করেন।
১৭ জুলাই পৌর বাস টার্মিনালে প্রথম সমাবেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আন্দোলনের সুত্রপাত হয়। এদিন ঘন্টাব্যাপী সড়ক অবরোধ করেছিল ছাত্ররা। কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হলে হাজার হাজার ছাত্র মিছিল নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। বিক্ষোভ মিছিলটি পুলিশ বাধা দিতে ব্যর্থ হয়। হলবাজার পৌছালে মিলন সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলা থেকে মিছিলে ছাত্রলীগের ৫/৭জন কর্মী ইট পাটকেল নিক্ষেপ করলে এতে উপজেলা ছাত্রদলের আবু কাউসার অপু আহত হয়। মিছিলকারীরা ছাত্রলীগকে ধাওয়া করলে তারা পালায়। পুলিশও এসময় চরম বাধা দিতে উদ্যত হলে মিছিলটি শহর ঘুরে বাসস্ট্যান্ডে সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। এরই মাঝে যুবলীগের কর্মীরা মিছিল আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান খান আলীর দোকানে হামলা চালিয়ে লুটপাট শেষে ঝালাই করে তালা লাগিয়ে দেয়।
দেশের কোথাও উপজেলা পর্যায়ে আন্দোলন না হলেও কুমারখালীর এই বিক্ষোভ মিছিল আলোড়ন উঠে। জেলার মধ্যে আলাদা গুরুত্ব পায় কুমারখালী। তরুন ছাত্রনেতা আলী ও সোয়াদ আলোচনা উঠে আসে। পুলিশ ও আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীরা আন্দোলনকারীদের খুঁজতে থাকে। পরিচিতদের বাড়ী বাড়ী তল্লাশী শুরু হয়। অবিভাবকদের প্রতি হুমকী চলে সারাক্ষণ। পরের দিন গভীর রাতে পুলিশ দুই আহ্বায়ক আলী ও সোয়াদকে থানায় তুলে নেয়। আন্দোলন না করানোর মুসলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয়। মুসলেকার কারণে আর কুমারখালীতে কোটা আন্দোলনের কর্মসূচী না বাস্তবায়ন হলেও সোস্যাল মিডিয়ায় সরব থাকেন তারা। জেলা শহরে আন্দোলন জোরদার করতে সকল নেতাকর্মীরা ২রা আগষ্ট পর্যন্ত নিয়মিত যেতে থাকে কুষ্টিয়া শহরে।
৩রা আগষ্ট দেশব্যাপী এক দফার সিদ্ধান্ত হলে কুমারখালীতে আবার কর্মসূচী দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় ৪ঠা আগষ্ট কঠোর কর্মসূচি বাস্তবায়নের। পুলিশ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে চরম হুমকী আসতে থাকে। সব হুমকীকে উপেক্ষা করে কুমারখালী ও খোকসা উপজেলার ছাত্ররা মহিলা কলেজ মাঠে জড়ো হতে থাকে। এদিকে রেল স্টেশন এলাকায় আওয়ামীলীগ শান্তি সমাবেশের নামে একত্রিত হয়। বাসষ্ট্যান্ডে অবস্থান নেয় পুলিশ। আওয়ামীলীগের উপজেলা পর্যায়ের নেতারা মেয়র শামসুজ্জামানের নেতৃত্বে প্রধান প্রধান সড়কে মহড়া দেয়।
একদফার দাবীতে ছাত্রদের বিশাল মিছিলটি উপজেলার সামনে দিয়ে এগিয়ে আসে। শহরে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ ব্যারিকেট দেয়। ছাত্রদের শ্রোত ব্যারিকেট ভাংতে গেলে পুলিশ শুরু করে এ্যাকশন। প্রথমে লাঠিচার্জ করা হলেও পরিস্থিতি দমনে ছোঁড়া হয় কয়েক রাইন্ড কাঁদুনে গ্যাস। ফলে আর টিকতে পারেনা ছাত্ররা। গ্যাসের আঘাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে সবাই। আহত হতে থাকে একের পর এক। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় ছাত্ররা। এরই মাঝে এমপি মার্কেটের সামনে আন্দোলনরত কয়েকজন ছাত্রীকে ছাত্রলীগের আকাশ রেজা ও ওয়াসিম চরম অপদস্ত করে। তিনভাগে বিভক্ত ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফ্যাসিস্টরা। শহরের প্রধান সড়কে পুলিশের আক্রোমণ, বাসষ্টান্ডের পশ্চিমে পৌর ছাত্রলীগ ও পূর্বদিকে উপজেলা ছাত্রলীগ হামলা চালাতে থাকে। অন্যদিকে রেল ষ্টেশন এলাকা থেকে আওয়ামীলীগের কর্মীরা মিছিলকারী দেখলেই হামলা চালায়। দুই ঘন্টা ব্যাপী তান্ডবে আতংক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। রেল ষ্টেশনের উপর আহত হয় খোকসা উপজেলার ওসমানপুরের যুবক মাহিম উদ্দিন, কয়েকদিন কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি শহীদ হন। বিক্ষিপ্ত হামলায় চারিদিকে কাঁন্নার রোল পড়ে। এসময় টিয়ার সেলের জন্য কয়েকজন সংবাদকর্মীও আহত হন। ছাত্রদের মধ্যে আহতদের কয়েকজন কুমারখালী প্রেসক্লাবে আশ্রয় নিলে এসময় ছাত্রলীগের ক্যাডার শান্ত সাংবাদিকদের হুমকী দেয়। তখন সাংবাদিক নেতা লিপু খন্দকার, সোহাগ মাহমুদ, মাসুদ রানা প্রমূখ তীব্র প্রতিবাদ করেন। এরই মাঝে ভাংচুর করা হয় আসাদুজ্জামান খান আলীর দামী মটরসাইকেল।
এদিকে শহর ছাড়াও উপজেলার পান্টি বাজারেও মিছিলের আয়োজন করা হয়। পান্টিতে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছিল রমজান আলী, নাজমুল হক, শাহের, সুজন, হাবিবুল বাশার বলে জানা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, এই হামলায় দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ সবচেয়ে বেশি আক্রমন করেছিল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডার তাজু, সম্রাট, পাপ্পু, সাদ্দাম, শান্ত, পলক, আকাশ রেজা, ওয়াসিম, বিপ্লব, মুগ্ধ, অন্তর, মিশন, জাহাঙ্গীর, ইব্রাহিম, সুরুজ, মাসুদ, নয়ন প্রমূখ।
আহ্বায়ক ছাত্র নেতা আসাদুজ্জামান খান আলীর দোকানে লুটপাট, হামলা আর দামী মোটর সাইকেল ভাংচুরের ঘটনায় মামলা হলেও আজও পুলিশ আসামীদের গ্রেফতার করতে পারেনি।
এদিকে দুপুরে উপর্যুপুরি হামলার পর রাতে প্রতিটি আন্দোলনকারীদের বাড়ী বাড়ী তল্লাশী শুরু করে পুলিশ ও যুবলীগ-ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। পরিবারকে চরম হুমকী দেয় তারা। আন্দোলনকারীরা পালিয়ে থাকে সবাই।
৫ই আগষ্ট পরের দিন ছাত্ররা জেলায় আন্দোলনে যোগদান করেন। দুপুরে হাসিনা পালিয়ে গেলে অনেকেই ফিরে আসে কুমারখালী, করে আনন্দ উৎসব। এসময় কিছু সুযোগ সন্ধানী কয়েকটি বাড়ী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাট করে। উপজেলা জামায়াতের নায়েবে আমির আফজাল হোসাইন ও উপজেলা বিএনপির সদস্য সচীব লুৎফর রহমান কুমারখালী থানায় দুই গেটে অবস্থান করে পুলিশ এবং থানা হামলার হাত থেকে রক্ষা করেন।
রাতেও তারা লুটপাটের আশংকায় বাজার পাহারা দেয়। পরের দিন উপজেলা পরিষদে বিশেষ আইনশৃংলা সভায় বিষয়টি ধন্যবাদের সাথে স্বীকৃতি পায়।
কুষ্টিয়া জেলার মধ্যে একমাত্র জুলাই আন্দোলন কুমারখালী উপজেলায় বাস্তবায়ন হওয়ায় এটি একটি ইতিহাসের অংশ। আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা জানান, এই লড়াইয়ে অনেকেই আহত হলেও ইচ্ছে করেই গেজেটভুক্ত হননি। আবার অনেক লোভী কৌশলে গেজেটে আহত তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। নিচ্ছেন সরকারী ভাতা-সম্মানি। তারা সুষ্ঠু তদন্ত পূর্বক ভুয়া আহতদের নাম বাদ দিয়ে প্রকৃত আহত জুলাই যোদ্ধাদের নাম যুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন।