মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী রক্তঝরা আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টের অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়। ছাত্র-জনতার সেই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের এক বছর পার হচ্ছে আজ। গণ-অভ্যুত্থানের আকাংখা অনুযায়ী বৈষম্যহীন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন পূরণের জন্য দেশের জনগণ অপেক্ষমান। এরই মধ্যে দেশের রাজনীতিতে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। ভবিষ্যতের রাষ্ট্র বিনির্মানেও অন্তর্বতী সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। এমন প্রেক্ষাপটে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরে গেলেই কেবল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের স্বপ্ন পূরণ হবে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ভোটারবিহীন একটি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী দানব সরকার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। আমরা জনগণকে সাথে নিয়ে গত দেড় দশকেরও বেশি সশয় ধরে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করছি। সেই সংগ্রামের বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের অভূত্থানের মাধ্যমে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট পালিয়েছে। এখন আমরা সবাই মিলে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। জুলাই বিপ্লবের ১ বছর পূর্তি উপলক্ষে দৈনিক সংগ্রামের সাথে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।

৫ আগষ্ট বিপ্লবের ১ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এই এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে মূল্যায়ন কি জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের অন্তবর্তীকালীন সরকারকে.. অনেকে অনেক কথা বলেন, অনেক ভুল আছে, ত্রুটি আছে, অভিজ্ঞতা নাই বেশি। আমি আশা করেছিলাম যে, এক বছরের মধ্যে আমাদের যারা শহীদ হয়েছে প্রকৃত তালিকা করে তাদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। দুর্ভাগ্য তারা পুরোটা করতে পারেনি। কিন্তু তারা চেষ্টা করছে। এই যে সংস্কারের যে বিষয়টি সেটি বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। শুল্কের হার কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ওপর সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণের সংবাদকে দেশের জন্য ভালো খবর। এজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাদুবাদ পেতে পারে।

তিনি বলেন, কিছু ঘটনায় মনে হচ্ছে একটি ফ্যাসিস্ট শক্তির পরিকল্পিত প্রচেষ্টা হচ্ছে দেশে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করা। মূলত সরকারের অনভিজ্ঞতা ও দুর্বলতার ফলে সংকটগুলো আরও ঘনীভূত হচ্ছে। গোপালগঞ্জের ঘটনাটা পরিকল্পিত। এই ক্ষেত্রে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা স্পষ্ট। সম্প্রতি উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা পরবর্তীকালে সরকারের দিক থেকে পরিস্থিতির হ্যান্ডেলিংটা আরও ভিজিবল হতে পারত। উপদেষ্টাদের আরও খোঁজখবর নিয়ে সেখানে গেলে ভালো হতো। সচিবালয়ের ঘটনাটিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা।

এ সময়ের মধ্যে জুলাই বিপ্লবের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, প্রত্যাশা পূরণের কথা বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। ৫ আগস্টের পরে পল্টনে এক সভায় তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছিলাম। তখন আপনারা বলেছিলেন, বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এত অস্থির হয়েছে কেন! এখন আপনারাই বলছেন, ব্যাপারটা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, যার শক্তি, যার ক্ষমতা, যার মালিকানা, তাকেই ফিরিয়ে দিতে হবে। যে সরকারে জনগণের প্রতিনিধি থাকবে না, সে রাষ্ট্রে সমস্যা তো হবেই। একটা কথা বলার দরকার হলে কাকে বলবেন, কার কাছে বলবেন? কথা বলারই লোক নেই। আগে সংসদ সদস্য, মেয়রদের বলতেন, এখন তো কিছুই নেই। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানসিক দিক দিয়ে কষ্ট পাচ্ছি। আমি বাংলাদেশকে সব সময় একটা সত্যিকার অর্থে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চাই এবং এখানে গণতন্ত্র হবে সবচেয়ে বড় বিষয়।

এছাড়া যারা (আওয়ামী লীগ) দেশকে শেষ করে দিয়েছে, দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে, সেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ হচ্ছে, যারা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেশের সম্পদকে পাচার করে দেয় বাইরে, যারা ব্যাংকগুলোকে লুট করে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করেছে, এদের তো কোনোমতেই ক্ষমা করা যাবে না। এই টাকাগুলো ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু এখনো সেভাবে বিচার কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। আমরা চাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার হোক। একই সঙ্গে দেশের যে জরুরি সংস্কারগুলো প্রয়োজন, সেগুলো বিলম্ব না করে দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক। তিনি আশা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, অর্থাৎ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তা তিনি বাস্তবায়ন করবেন।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা মূল্যায়ণ করতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, একটা ফ্যাসিস্ট রেজিমের পরে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়েছে এবং একটা নন-পলিটিক্যাল একটা সরকার যারা মধ্যবর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের অধীনে আমি মনে করি যে এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছে। বিশেষ করে, সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে গিয়েছিল, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে তারা ভেঙে দিয়েছিল, সেগুলোকে আবার একটু পুনর্গঠনের চেষ্টা করা, সে কাজগুলো হচ্ছে। ল’ অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশন নিয়ে অনেকেই খুব নেগেটিভ কথা বলছেন। কিন্তু আমি মনে করি যে সেখানেও কিছুটা উন্নতি হয়েছে। প্রবলেম আছে অনেকগুলো। সেই সঙ্গে জুডিশিয়ারিতে উন্নতি হয়েছে। সংস্কার কর্মসূচিগুলো এগিয়ে চলেছে বেশ সময় মতো, টার্গেট ঠিক রেখেই। পলিটিক্যাল ইস্যুতে তর্ক-বিতর্ক হবে। গণতান্ত্রিক একটা দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হবে, কথাবার্তা হবে। এটা স্বাভাবিক। সবাই যদি আমরা একটু উদ্যোগী হই, আমরা সহযোগিতা করি, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চয়ই আগের চেয়ে ইমপ্রুভ করবে। সবচেয়ে বড় জিনিস যেটা যে নির্বাচনের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি। লন্ডনে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার যে সভা হয়েছে, বৈঠক হয়েছে- সেই বৈঠকে যে সিদ্ধান্তগুলো হয়েছে, সেই সিদ্ধান্তের আলোকে আমরা ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যবর্তী সময়ে আশা করছি যে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। আমরা বিশ্বাস করি যে এই নির্বাচনটা হলে এবং নির্বাচন ট্র্যাকেই যখন আমরা দেশ উঠবে, তখন দেশ অনেকটা গতি ফিরে পাবে এবং একটা সঠিক পথে এগিয়ে চলবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। একটা বিশেষ মুহূর্তে এসে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কথা বললে অস্বীকার করা হবে না যে, আমরাই দায়িত্ব দিয়েছি। কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে তাদের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট নয়...তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সবাই অত্যন্ত অভিজ্ঞ মানুষ, পণ্ডিত লোক, উইজডম সব আছে, কিন্তু পলিটিক্যাল উইজডম যে পুরোপুরি আছে, সেটা বলা যাবে না। কিন্তু তাদের আন্তরিকতার অভাব আছে বলে আমার কাছে মনে হয় না।

আগামীর বাংলাদেশ কেমন হওয়া উচিত ? এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রী মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো সহনশীলতার অভাব।

আমাদের এ সংকট অতিক্রম করতে হবে। আরও ধৈর্য ধরতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নির্মাণের অভূতপূর্ব সময় এসেছে। জনগণের সমর্থন অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে সরকারে যাব, আবারও জনগণ যদি চায়, তাহলে আসব, না হলে না। আমরা বিশ্বাস করি, মত প্রকাশের ও কথা বলার স্বাধীনতা। মানুষের ন্যায্যবিচার পাওয়ার অধিকার এবং সামাজিক মর্যাদা ভোগ করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু এটা তো হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন ছাড়া রাষ্ট্র ধরে রাখা কঠিন হবে। ঐকমত্য কমিশনে অনেক বিষয়ে সবাই ঐকমত্যে এসেছে। মৌলিক ধারণাগুলো একসঙ্গে আসার পরে জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।

একটা কথা পরিষ্কার, আমরা সবার আগে যেটা গুরুত্ব দেব সেটা হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা। আর রাজনৈতিক কাঠামোটাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হবে। আর (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেগুলো আসবে, সেগুলো এবং যেগুলো বাকি থাকবে, সেগুলোকে আমরা জনগণের সামনে নিয়ে আসব। অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে একটা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই।

বর্তমান সরকারের নেয়া নানা সংষ্কার প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন চাই, আমরা সংস্কার চাই। রাষ্ট্রে সংস্কার ও কাঠামোগত পরিবর্তনের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনজীবনের প্রকৃত উন্নয়ন। কিন্তু মানুষের প্রয়োজনে না এলে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। আপনারা তো খুব ভালো করে জানেন, সংস্কার প্রস্তাবটা কাদের। আমরা ২০১৬ সালে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেছি। সংষ্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি একেবারেই সম্পন্ন করার জিনিস নয়। মানুষের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে সংষ্কার করতে হবে।

ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরেছে কি-না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য অটুট আছে। অনেক সময় রাজনীতিকদের মধ্যে কথার লড়াই দেখা যায়। এগুলো রাজনীতিরই অংশ। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কথার ব্যবহার থাকবে। এটাই রাজনীতির সৌন্দর্য। গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে শত ফুল ফুটতে দিতে হবে, সবার কথা বলার সুযোগ থাকতে হবে। বিদ্যমান ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য এই দেশ এবং দেশের মানুষের মূল চালিকাশক্তি। এই ঐক্য বজায় রেখে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।

অন্তবর্তী সরকারের কাছে আপনাদের ম্যাসেজ কি? এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল, বারবার বলছি যে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য চাই। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ করবো এমন কিছু করবেন না যেটা বাংলাদেশের মানুষের জন্যে উপযোগী হবে না। প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকেছিলেন, আমরা আলোচনা করেছি। আমরা পূর্বে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব, সেটাই আমরা করছি। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন এ বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া উচিত, যেন আর কোনো অস্পষ্টতা না থাকে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা চাই, দ্রুত নির্বাচন হোক এবং একটি রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা পাক। সরকার সে ব্যবস্থাই নেবে বলে আমরা মনে করি।

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল