আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলকে স্বৈরতন্ত্র, নির্বাচন করে আসা স্বৈরতন্ত্র, হাইব্রিড রেজিম নানাভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক পরিসরে এই রেজিমকে ফ্যাসিবাদী বলে অভিহিত করাটাই বেশি পরিচিত। আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে, রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগমূলক ক্ষমতার অপব্যবহার করে, রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে এদেশে একটি লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।

আবার এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অপরাধের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে দমন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য লীগ সরকার মাত্র তিন সপ্তাহে দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে এবং ২০ হাজার মানুষকে গুলী করে তাদের অনেককেই চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছে। এমন একটি রাজনৈতিক দলের স্বৈরতান্ত্রিক নেতা-নেত্রীসহ খোদ সেই দলটিকেও ‘সংগঠন হিসেবে’ বিচারের আওতায় আনা ও ন্যায্য পদক্ষেপ হিসেবেই গণ্য করার দাবী উঠেছে।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নেন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি। ওই সময়ের পর থেকে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দলটি ক্ষমতায় ছিল টানা ১৫ বছর ৭ মাস। এ সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে তিনটি। সবগুলোই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পুরো ব্যবস্থাকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন দলীয়করণের মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার খর্ব করা হলো। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সরকারের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হলো। যেটা জনস্বার্থে কাজ করবে সেটাকে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে রূপান্তর করা হলো। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে আইনের শাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যত প্রতিষ্ঠান আছে, সবগুলোয় একই চিত্র। সব ক্ষেত্রে দলীয়করণের মাধ্যমে পেশাগত দেউলিয়াপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন, দুদক, পিএসসি, মানবাধিকার কমিশনÑ যত কমিশন আছে; সবগুলোকে এক ধরনের দুর্নীতিসহায়ক জায়গায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পেশাগত দেউলিয়াপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ভূমিকা পালন করেছেন। এখানে এ প্রতিবেদনে যে তালিকা দেয়া হচ্ছে তা সম্পূর্ণ না, আংশিক মাত্র। তাদের কারণে পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে ক্ষমতার যে স্তম্ভ, এসব স্তম্ভে জনগণের কোনো অস্তিত্ব থাকেনি। রয়েছে শুধু আমলাতন্ত্র ও কলুষিত এবং দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি। ব্যবসা, আমলাতন্ত্র ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি—এ তিন চক্রের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকা যাবে, এটাই নিশ্চিত করে ধরে নেয়া হয়েছিল।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নানা সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তা এক পদেই ছিলেন দীর্ঘদিন। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি বিভাগকেই তৎকালীন সরকারের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন তারা। এ তালিকায় রয়েছেন সাবেক বিচারপতি থেকে শুরু করে রয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান, সচিব, গভর্নর, ব্যবসায়ী, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের নামও।

আওয়ামী লীগের শাসনে দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দলীয়করণ এবং রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচটি ইমাম)। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমাম ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা ও ২০১৪ সালে রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে

নিয়োগ পান।

আওয়ামী লীগকে শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৪ বছর। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরে আসে। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অধীনে সবচেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জয়লাভ করে। কিন্তু এই নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শেখ হাসিনা। তিনি ঘোষণা করেন, ক্ষমতায় খালেদা জিয়াকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। তিনি কথা রেখেছিলেন।

খালেদা জিয়া এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে দেশ চালাতে পারেননি। সে সময় ১৭৩টি দিন হরতাল ও ‘জ্বালাও-পোড়াও’ করেছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। মেয়র মহিউদ্দীনকে দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর অবরোধ এবং ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে বন্দরকে ছারখার করে দেওয়া হয়। খালেদা জিয়া অর্থনীতিকে ইমার্জিং টাইগারে পরিণত করেছিলেন। বিদেশি বিনিয়োগ আসছিল দেশে। কিন্তু শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক আন্দোলনের কারণে তা নস্যাৎ হয়ে যায়।

তখন হাসিনার নির্দেশে গান পাউডার দিয়ে যাত্রী বাস জ্বালিয়ে দিয়ে ১৫ জন মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লগি-বইঠার তান্ডব হয়েছিল। সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। মনি বেগমের মতো নারীকে প্রকাশ্যে রাজপথে বিবস্ত্র করা হয়েছিল। সচিবালয়ের কর্মকর্তাকে রাজপথে দিগম্বর করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেও শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদী কর্মকান্ড চালান। ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসব হয় ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে ছররা গুলীতে রক্তাক্ত করা হয়। আবার সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার মন্ত্রী নাসিম ঘোষণা দেন সাদেক হোসেন খোকা গরুর লাল রক্ত গায়ে মেখেছেন। হাইকোর্টের সামনে বস্তি বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বিচারকদের উদ্দেশে লাঠি মিছিল করা হয়েছিল।

কিন্তু এসব কিছুকেও ছাড়িয়ে যায় ২০০৯-২৪ শেখ হাসিনার কর্তৃত্বপরায়ণ পনেরো বছরের শাসনকাল। ওই সময় গণতন্ত্র নির্বাসনে চলে যায়। বিচারের বাণী কাঁদতে থাকে নীরবে নিভৃতে। সুশাসন বলে কোনো শব্দের অস্তিত্ব ছিল না দেশে। তিনটি ভুয়া নির্বাচন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। মামলা-হামলা, গুমের বিভীষিকা, খুন, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, গণহত্যা, স্বৈরতন্ত্র, দলীয় ব্যবসায়ীদের দিয়ে ব্যাংক ডাকাতি অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার এক নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে দেশে।

আওয়াজ ওঠে, যোগ্য বাবার যোগ্য কন্যা। ফ্যাসিবাদে পিতা শেখ মুজিবকে ছাড়িয়ে যান শেখ হাসিনা। দেশে একটির পর একটি গণহত্যা চলতে থাকে। পিলখানায় ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। শাপলা চত্বর রঞ্জিত হয় আলেম-ওলামাদের রক্তে। গণহত্যার শিকার হন কমপক্ষে ৩০০ আলেম ও মাদরাসাপড়ুয়া ছাত্র। মাওলানা সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে গণহত্যার শিকার হন আড়াইশোর বেশি লোক।

তেমনি নরেন্দ্র মোদির সফর কেন্দ্র করে চালানো হয় গণহত্যা। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন দমন করতে চালানো হয় গণহত্যা। রাষ্ট্রীয় বাহিনী পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবিকে হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করা হয়। গুলীতে নির্বিচারে হত্যার শিকার হয় নিরীহ ছাত্র-জনতা। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর তদন্ত করে যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে আছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের নির্মম-নিষ্ঠুর বিবরণ। রিপোর্টে ১৪০০ ছাত্র-জনতা গুলীতে হত্যার কথা বলা হয়েছে। ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের বিপ্লবে ২০ হাজার মানুষকে গুলী করে আহত করে তাদের অনেককে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আয়নাঘরে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন, গ্যাং র‌্যাপ, বিশ্বজিৎ, আবরার ফাহাদ ও সাগর-রুনি দম্পতির হত্যাকান্ড চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে দেশে। অবশেষে শেখ হাসিনার এই নগ্ন ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে ৫ আগস্ট ২০২৪। তাকে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হতে হয়। পৃথিবীর যেকোনো রাজনৈতিক দল বা সরকার কর্তৃক জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত এমন হত্যাযজ্ঞ ও সন্ত্রাস সমর্থন করা অন্যায়। এমন অন্যায়ের বিচার করতে না পারলে ফ্যাসিবাদ চলতেই থাকবে। সরকার তাই শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের অপরাধের বিচার করছে। সেই লক্ষ্যেই আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অপরাধের বিচারের জন্য আদালতে এখন বিচারের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেই বিচারের দিকেই দেশ তাকিয়ে আছে।

বাংলাদেশে যে ধরনের সহিংসতা জুলাই-আগস্ট মাসে ঘটেছে, যে সামূহিক ট্রমার জন্ম নিয়েছে, তা লাঘব কেবল সাধারণ বিচার দিয়ে হবে না। বিচার যেমন লাগবে, তেমন ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ, স্মৃতি সংরক্ষণ, ট্রমা লাঘবকরণ, ট্রুথ কমিশন তৈরি করা ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েও যেতে হবে। কারণ, এ ধরনের সহিংসতায় সমাজের এক বিরাট অংশ জড়িয়ে পড়ে। আর তা শুধু ‘শাস্তি’ দিয়ে বা ‘নিষিদ্ধ’ করে সমাধা করা যাবে না।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। এ-সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গেজেট প্রকাশের পর নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধনও স্থগিত করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষে অলৌকিক কোনো সিদ্ধান্ত না হলে আসন্ন নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ ছাড়াই হবে, এটা একপ্রকার নিশ্চিত। এই পরিণতির জন্য দলটির ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমই প্রধানত দায়ী। গত পনেরো বছর শেখ হাসিনার নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগকে ছিটকে পড়তে হয়েছে।

এ দীর্ঘ সময়ে ক্ষমতাসীন থাকা দলটির বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, বিরোধী মত দমন, সংবিধানকে সংশোধন, ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতে সুশাসনের অভাব, তিনবারের বিতর্কিত নির্বাচন, ব্যাপক মাত্রায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পদক্ষেপগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার পথও রুদ্ধ করা হয়েছিল নিবর্তনমূলক আইনের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখে এসবের সুযোগ তৈরিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে বিধি অনুযায়ী নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকার কথা থাকলেও অভিযোগ রয়েছে, উচ্চপর্যায়ের প্রশাসনে দলীয় কর্মীর মতোই ভূমিকা রেখেছেন তারা।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে পেয়ে সরকার গঠন করে দলটি। এরপর সংসদে ২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী বিলের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হয়। এর সুযোগ করে দিয়েছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের একটি রায়। হাইকোর্টে বৈধ ঘোষণা হওয়া সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ২০১১ সালের মে মাসে ‘অবৈধ ও অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বেঞ্চ। এরই ভিত্তিতে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিলের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুযোগ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। ফিরে আসে দলীয় সরকারের অধীনে ভোটগ্রহণের প্রথা।

এবিএম খায়রুল হক ১৯তম প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১০ সালে। ৭ মাস ১৮ দিনের দায়িত্ব পালনকালে যেসব রায় দিয়েছিলেন, তার মধ্যে এ রায়টিই পরের ১৪ বছরের শাসনব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে দেখা হতো মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিককে। আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থায় ঊর্ধ্বতন পদে কাজ করেছেন তিনি। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময় তিনি সামরিক বাহিনীতে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটান ও ব্যাপক দলীয়করণ করেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে অনেক মেধাবী অফিসারের ক্যারিয়ারে প্রতিবন্ধকতা তৈরির অভিযোগ রয়েছে। অনেক গুমের নির্দেশদাতা হিসেবে বিভিন্ন সময় তার নাম আলোচিত হয়েছে।

২০১৯ সালে আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া আলোচিত গোপন কারাগার ‘আয়নাঘর’ তৈরিতেও তারিক আহমেদ সিদ্দিক মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে দাবি একাধিক সাবেক সেনা কর্মকর্তার।

আয়নাঘরের নির্যাতনের ভুক্তভোগীদের অন্যতম লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান (বীর প্রতীক)। গত ৬ আগস্ট তিনি নিজের একাধিকবার গুম হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন। আর এর মূল হোতা হিসেবে দায়ী করেন মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিককে।

বলা হয়, আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদও। ২০১৮ সালের ২৫ জুন থেকে ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সময়ে তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করেন তিনি। এছাড়া পুলিশের খাতায় অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত নিজের ভাইকে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের জন্য শাস্তি এড়িয়ে রেহাই পেতেও সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে তারা বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে, নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। অন্যায্যভাবে সামরিক খাতে কন্ট্রাক্ট পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তিনি ও তার ভাইরা একযোগে কাজ করেছেন। সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুসও নিয়েছেন।

প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় ফেরার পথ প্রশস্ত করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে গত তিন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে কাজী রকিব উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করে ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ কমিশনের অধীনেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বিরোধী দলবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশে-বিদেশে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল সে নির্বাচন।

বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, এ কমিশন তার পাঁচ বছরের মেয়াদে তা ধ্বংস করে দিয়েছে। এর অধীনে জাতীয় সংসদ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। কমিশন সচিবালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এত বেশি নির্বাচন করার সুযোগ অতীতের কোনো কমিশন পায়নি।

২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন। এ সময়ও জাতীয় সংসদ থেকে স্থানীয় সরকার পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনই ছিল বিতর্কিত। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় ছিল। এ কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৯ আসন পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একতরফা সুবিধা প্রদান, ভোট কারচুপি, নির্বাচন কমিশনাররা সরকারদলীয় কর্মীর মতো বক্তব্য রাখাসহ বিতর্কিত নানা ঘটনার নজির দেখা যায়। ভোটের আগের দিন-রাতে ব্যালট বক্সে সিল মারা ব্যালট আগে থেকে রাখার অভিযোগ ওঠে সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।

দেশের জ্বালানি খাতের বর্তমান দুরবস্থার প্রধান দুই কারিকর ধরা হয় সাবেক দুই আমলা মো. আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউসকে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হিসেবে ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পান মো. আবুল কালাম আজাদ। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের বিদ্যুৎ খাতের অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক চাপ তৈরির জন্য বিদ্যুৎ সচিব হিসেবে তার ভূমিকাকে অনেকাংশেই দায়ী করা হয়। তার হাত ধরেই দেশের বিদ্যুৎ খাত হয়ে উঠেছে বেসরকারি উদ্যোক্তানির্ভর (আইপিপি)।

অনুগত আমলা হিসেবে পরিচিত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসও।

তিনি ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তিনি প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। প্রশাসনে আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি তৎকালীন সরকারপ্রধানের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের তালিকায় প্রথম সারির দিকে নাম লেখান তিনি। আধিপত্যের মাধ্যমে প্রশাসনে ক্ষমতা বিস্তার করতেন এ সচিব। ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ পদে থেকে অব্যাহতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ পান তিনি।

চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের ব্যাপক প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে সরকারের নির্বাচন পরিকল্পনায় প্রতিবেশী দেশটির আনুকূল্য প্রতিষ্ঠায়ও বড় ভূমিকা ছিল তার। আর কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের খেয়াল-খুশিমতো উপস্থাপনের দায়িত্বটিও তিনিই পালন করেছেন।

২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর সরকারের মুখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ পান তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।

আর্থিক খাতে বর্তমান বিশৃঙ্খলার জন্য যাদের সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, তাদের অন্যতম পলাতক সাবেক গভর্নর ও অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। শেখ হাসিনা সরকারের টানা তিন মেয়াদেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর থেকে অর্থ সচিব হয়ে চলতি বছরের ৯ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থ ব্যবস্থার মৌলিক নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। এ কারণেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে আব্দুর রউফ তালুকদার পালিয়ে যান। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র গভর্নর, যিনি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিরুদ্দেশ হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে বড় আয়োজন ছিল বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার। সংস্থাটির মহাপরিচালক হিসেবে ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত লে. জেনারেল (অব.) শেখ মামুন খালেদ। তার সময় থেকেই দেশে গুমের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গুম করে আওয়ামী লীগের ২০১৪-এর নির্বাচন জয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী এ সময়ে অন্তত শতাধিক ব্যক্তিকে গুম করা হয়েছিল।

২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে বিশেষ ওই সংস্থার মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) আকবর হোসেন। তার বিরুদ্ধেও বিরোধী নেতাকর্মীদের গুমের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একতরফাভাবে জয়লাভ ও বাংলাদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী তার মেয়াদকালে অন্তত আড়াই শতাধিক ব্যক্তি গুম হয়েছেন।

২০১৭ থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদীন। তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায়ই ২০১৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই বছরই সবচেয়ে বেশি গুমের ঘটনা ঘটে। ওই বছর ৯৮ জনকে গুম করা হয়, যা ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল—দেড় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া তার মেয়াদকালে দেড় শতাধিক ব্যক্তি গুম হন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি) যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি। ২০১৭ সালের ৬ মার্চ থেকে মেজর জেনারেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) জিয়াউল আহসান এনটিএমসির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি সরকারের হয়ে নাগরিকদের ফোনকল ও ইন্টারনেটে বিভিন্ন যোগাযোগ অ্যাপে আড়িপাতা এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থা ও ইন্টারনেট অপারেটর নিয়ন্ত্রণের কাজ করেন। এ সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে হেনস্তা, গ্রেফতার, গুম-খুনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হতো বিরোধীদলীয় মতকে।

২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশের আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এ কে এম শহীদুল হক। এ আইজিপির সময়কালে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ছিল সর্বোচ্চ। বিরোধী দলের ওপরেও নিপীড়ন, ধরপাকড় ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

বাংলাদেশ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ তিন পদে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। এ সাবেক আইজিপিকে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী আইজিপি’ হিসেবে বিবেচনা করেন অনেকেই। পুরো বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেন তিনি। গত এক দশকে বিরোধী দল দমনে অতিউৎসাহী পদক্ষেপ বারবার সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। এ সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে বহু বিরোধী রাজনৈতিককে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে ক্রসফায়ারে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী হত্যার ঘটনা বেশি ঘটে। পুলিশের শীর্ষ পদে থাকা অবস্থায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি।