ড. মুহাম্মাদ খলিলুর রহমান মাদানী
যুগে যুগে সব ধরনের বিভেদ-বৈষম্য, জুলুম, শোষণ ও অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে, দেশ ও জাতির কল্যাণে আলেম সমাজের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস অবিস্মরণীয়। যখনই কোনো জালিমের উত্থান হয়েছে আলেম সমাজ সবধরনের ভয়কে জয় করেই তার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে শাহাদতের নজরানা পেশ করেছেন। ভারত বর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আযাদী আন্দোলন, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলন, জমিদার প্রথার বিরুদ্ধে শহীদ হাফেজ নিসার আলী তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আন্দোলন, ষাটের দশকে স্বৈরাচার আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ২০০০ সালে ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের রায় বাতিলের আন্দোলন, ২০০৭ সালে কুরআন সুন্নাহ বিরোধী নারী নীতির সংশোধনের আন্দোলন, ২০০৯ সালে ইসলামবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ২০১০-১১ সাল থেকে ইসলাম বিরোধী শিক্ষানীতি ও কোরআন বিরোধী রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলনে ওলামা কেরাম সবসময় সক্রিয় ছিলেন। ২০১৩ সালে নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী শাপলা চত্বরের রক্তিম ট্র্যাজেডি, ২০২১ সালে ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনসহ আলেম-ওলামা ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের রক্তদান, কারাবরণ ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা কারো অজানা নয়। বিগত ১৭ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক পিরিয়ডেও দেশের বহু ওলামায়েকেরাম শাহাদতবরণ করেছেন। নির্মমভাবে কারাভোগ করেছেন। শিকার হয়েছেন হামলা-মামলার। তবুও দমে যাননি জাতির পথপ্রদর্শক ওলামায়ে কেরাম। আল্লামা খতীব উবায়দুল হক রহ আল্লামা মুহিউদ্দিন খান রহ মুফতি আমিনী রহ সহ শীর্ষ উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে তখন আমরা ময়দানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি।
জুলাই বিপ্লবে আলেম সমাজের অবদান : ২০২৪ সালে চাকরিতে কোটা সংশোধন ও বৈষম্যের প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার আন্দোলন থেকে সূচিত ফ্যাসিবাদী জালিম সরকারের পতনের রক্তিম জুলাই অভ্যুত্থানেও ঝাঁপিয়ে পড়েন বাংলার আলেম সমাজ প্রায় সকল অংশ। মাদরাসা শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা। সমস্ত বাধা-বিপত্তি, হুমকি-ধমকি, ভয়-ভীতি, এমনকি বন্ধুকের গুলি ও জেল-জুলুম উপেক্ষা করেই রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন তাঁরা, অংশগ্রহণ করেন সক্রিয় ভাবে। জুলাই বিপ্লবে শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, তারুণ্যদীপ্ত নবীন আলেম-ওলামাদের বীরত্ব ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ঈমানদীপ্ত ভূমিকায় আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত এমনকি বহু আলেম-হাফেজ, মাদরাসা পড়ুয়াদের শাহাদাতের নজরানা পুরো দেশবাসীকে উজ্জীবিত করেছে, বিপ্লবকে করেছে তরান্বিত।
ফলে ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ফ্যাসিস্ট, জালিম শাহীর পতনে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীসহ আলেম-ওলামাদের নজিরবিহীন এমন আত্মত্যাগ ও একনিষ্ঠ অবদান ইতিহাসের সংগ্রামী অধ্যায়ে নতুন মাইলফলক রচনা করে।এজন্য দেখা যায় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নায়করা ঘোষণা দিচ্ছেন ‘যুগে যুগে সব জুলুমের বিরুদ্ধে আলেমসমাজের বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে মাদ্রাসা ছাত্র শিক্ষকদের।” ২০২৪ সালেও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থান সম্ভব হতো না। জুলাই বিপ্লবে আলেম সমাজ ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের আত্মদান ও বিপ্লবী অবদান যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জুলাই বিপ্লবোত্তর স্বাধীনতার নতুন আবহকে স্বচ্ছ রাখার ব্যাপারেও সবাইকে যত্নবান থাকতে হবে। দখলবাজি, চাঁদাবাজি, ক্ষমতালিপ্সা, কমিশন বাণিজ্য, খুন, অপহরণ ও নৈতিক অবক্ষয় রোধ করে বিপ্লবের এ চেতনা ও তাৎপর্যকে সমুন্ননত রাখতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ, নাস্তিক্যবাদ কঠোরভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তির ঐক্য ধরে রাখতে সব পক্ষেরই সংযম, সহানুভূতি, উদারতা ও শিষ্টাচারিতার পরিচয় দিতে হবে।
কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার পাশে এদেশের আলেম সমাজ ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় ছিল। জুলাই বিপ্লবে ৭০ জনের বেশি হাফেজ, আলেম শাহাদাত বরণ করেছেন। তাছাড়া দেশের আলেম সমাজ গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনে সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে আলেমদের অবস্থান: জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয় সরকারি চাকরিতে বৈষম্য দূর করে কোটা সংস্কারের দাবিতে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। ইসলামও সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং যৌক্তিক সংস্কারের পক্ষে। একই সঙ্গে সব ধরনের জুলুম ও বিশৃঙ্খলার বিপক্ষে। আন্দোলনের পক্ষে বক্তব্য দেওয়ায় সারা দেশে অসংখ্য আলেম শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। তবু তারা জুমার বয়ানে তুলে ধরেছেন ফেরাউনের জালেমের দাস্তান এবং সেনাবাহিনীসহ সাগরে ডুবে মৃত্যুবরণের করুণ পরিণতির শিক্ষা। ২৪-এর আন্দোলন ছিল যুগপৎ রাজপথে এবং অনলাইনে। আলেম সমাজ যেভাবে রাজপথ রক্তে রঙিন করেছেন, তেমনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারও লাল করে সংহতি প্রকাশ করেন।
যাত্রাবাড়ী সাইনবোর্ড এলাকায় আলেমদের সংহতি সমাবেশ: তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার ছাত্র- শিক্ষক ছাত্র শিক্ষকসহ যাত্রাবাড়ী বড় মাদ্রাসা আহলে হাদিস মাদ্রাসা আশেপাশের সকল কওমি আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক ঐক্যবদ্ধ ভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এবং ছাত্র জনতার আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করেন।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা ছিল পুরোদস্তুর রণক্ষেত্র। সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার সঙ্গে রাজপথে নেমে এসেছিল আলেম সমাজও। বিশেষ করে এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে রাজপথে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে শামিল হয়। যাত্রাবাড়ীর আলেম সমাজ মিশে যান জুলাই বিপ্লবের অংশ হয়ে।
সাইনবোর্ড থেকে যাত্রাবাড়ী: জরুরি অবস্থা কারফিউ, বৃষ্টি সবকিছুকে উপেক্ষা করে সাইনবোর্ড থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত পুরা এলাকায় সন্ত্রাসী ও যৌথ বাহিনী যেভাবে রণক্ষেত্র সৃষ্টি করেছিল তার মোকাবেলায় আশেপাশের সকল আলেম-ওলামা পীর-মাশায়ে খ কওমি আলিয়ার ছাত্র শিক্ষক সকলে প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন ছাত্র-জনতার যৌক্তিক দাবীর সাথে। মুষলধারে বৃষ্টি অভীক্ষা করে ভোর রাত থেকে মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় ওলামা মাশায়েখ পরিষদের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়ে ফজরের পর থেকে প্রতিদিন সকলকে আন্দোলনের শামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
সর্বদলীয় আলেম-ওলামা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত: পহেলা আগ স্ট যখন বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী সহ সাচ্চা ইসলামী আন্দোলনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা হল তখন থেকেই সব শ্রেণীর আলেম-ওলামা মারকাজ দরবারের মাঝে উদ্যোগ উৎকণ্ঠাস ব্যাপক আকার ধারণ করে। ২ আগস্ট মুহতারাম ডা.শফিকুর রহমানের পরামর্শে কেন্দ্রীয় উলামা কমিটির সভাপতি মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের আহবানে মাওলানা আব্দুল হালিম, নুরুল ইসলাম বুলবুল, মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ এবং ওলামা কমিটির সেক্রেটারি ড. খলিলুর রহমান মাদানী জরুরী বৈঠক করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হয়। ওইদিনই বিকাল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত হেফাজত নেতৃবৃন্দ এবং দেশের শীর্ষ ইসলামী নেতৃবৃন্দের সাথে দফায় দফায় বৈঠক হয়। এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় ৩ জুলাই বাইতুল মোকাররম থেকে ছাত্র জনতার মিছিলে সর্বদলীয় আলেম ওলামা একাকার হয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ৩ জুলাই যোহরের নামাজের পরপর ই বায়তুল মোকাররম থেকে প্রেসক্লাব- শাহবাগ অভিমুখে কারফিউ, জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতার সাথে আলেম-ওলামা ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনেক আলেম হাফেজ সেদিন শাহাদাত বরণ করেন ও আহত হন অসংখ্য।
এক কথায় সাইনবোর্ড থেকে গাবতলী, টঙ্গীর আব্দুল্লাহপুর থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ, বাবুবাজার ব্রিজসহ পুরা ঢাকা শহরের সকল স্পটে ছাত্র জনতার সাথে মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক একাকার হয়ে যান। একদিকে নেট বন্ধ তথাপিও পরের দিন ৪ আগস্ট পূর্ব পরিকল্পনা মতে রাজধানীর কাওরান বাজার পাইকারি মার্কেট থেকে বিস্কুট এবং পানির বোতল নিয়ে ওলামায়ে কেরাম বিভিন্ন স্পটে স্পটে পিকআপ ভ্যান নিয়ে ময়দানে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন। মুহাদ্দিস মাহমুদুল হাসান,মুফাসসির লুৎফুর রহমান, খালেদ সাইফুল্লাহ বখশি, ফখরুদ্দিন আহমদ, আবুল কালাম আজাদ বাশার, অধ্যক্ষ মোশারফ, অধ্যক্ষ শহীদুল্লাহ, ডঃ মাওলানা হাবিবুর রহমান সহ একঝাঁক জানবাজ উলামায়ে কেরাম দিনভর ছাত্র জনতাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।(সকলের নাম নেয়া সম্ভব হলোনা) আর্মি পুলিশ সকলের বাধার মুখে কেউ থেমে থাকেননি। আবার প্রশাসনের অনেকেই সহযোগিতাও করেছেন কল্পনাতীত। পরের দিন ৫ই আগস্ট ভোর ৪.১৩ মিনিট ফজরের পূর্বেই মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ভাই বললেন : আজ চুড়ান্ত জিহাদে নামতে হবে,পূর্বের ন্যায় ভোরেই সকল মারকাযে উলামা টীম হাজির হতে হবে। এখন থেকে পরিকল্পনা করে সকল আলিয়া কওমি মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক প্রস্তুতি নিতে থাকেন, ফজরের পর পরই এক এক করে আস্তে আস্তে মাঠে নামানো শুরু করাতে হবে। তামীরুল মিল্লাত মাদ্রাসা , ফরিদাবাদ মাদ্রাসা, যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার নেতৃত্বে পোস্তগোলা ব্রিজের গোড়ায় প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে ওঠে, যাত্রাবাড়ীতে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে, সাইনবোর্ড প্রতিরোধে আন্দোলন গড়ে ওঠে, পরিকল্পনা ছিল সকাল ১১০০ টার মধ্যে বাইতুল মোকাররম- প্রেসক্লাব হয়ে শাহবাগ, টিএসসি এবং শহীদ মিনারে পৌঁছানো। সকাল ১১ টা /বারোটার মধ্যেই গোটা রাজধানী লোকে লোকারণ্য হতে থাকে এবং শাহবাগ, শহীদ মিনার, টিএসসি হয়ে জনতার ঢল নামে গণভবন অভিমূখে। আমাদের উলামায়ে কেরামের অনেক গুলো টীমের নেতৃতে পিকাপ-ট্রাক ভর্তি করে বিস্কুট এবং পানির বোতল আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার মাঝে দিনভর সরবরাহ করা হয়। মজার ব্যাপার হলো সরকারের সীমাহীন নির্যাতন ও বর্বরতা সত্বেও ৪ আগস্টের অগনিত পানি, বিস্কুট ভর্তি পিক আপে উলামাদের কে আর্মি ও যৌথবাহিনী নামেমাত্র বাঁধা -লাইফেল তাক করে মাত্র, মূলত ঐদিন থেকেই তাঁরা আমাদের আন্দোলনে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছেন, যা বিশ্ব মিডিয়ার ফুটেজে দৃশ্যমান।
মন্দির পাহারায় মাদরাসাছাত্র শিক্ষক: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে পতিত সরকারের কতিপয় দুষ্কৃতকারীরা সংখ্যালঘুদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে দেয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে মাদরাসার ছাত্ররা দেশের বিভিন্ন মন্দির প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে পাহারা দেন। বিশেষ করে রমনা কালীমন্দিরে পাহারা দেওয়ার জন্য এবং তাদের নির্বিঘ্নে পূজার করতে সুযোগ দেয়ার জন্য উপস্থিত হয়ে যান দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম। আমরা একঝাঁক উলামায়ে কেরাম মুফাসসিদের বিশাল একটি স্কলারস টিম নিয়ে সেদিন রমনা কালীমন্দিরে হাজির হয়ে যাই।রমনা কালী মন্দিরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সহ মন্দির কর্তৃপক্ষ সেদিন ওলামায়ে কেরামের এই আগমনকে অত্যন্ত সাধুবাদ জানান এবং সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দেন যে “ আমরা বিগত ১৫ বছর এত নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে পূজা-পার্বণ করার সাহস পেতাম না!” সকল গুরুত্বপূর্ণ টেলিভিশন চ্যানেল দাও প্রকাশ ও প্রচার হয়। এবাভে বিশ্ববাসীর সামনে সাম্য ও সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন আলেম-উলামা এবং মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। নিখিল চন্দ্র নামে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন বলেন, ‘মুসলিম ভাইয়েরা আমাদের মন্দির পাহারা দিচ্ছে সারা রাত। আমরা সবাই মিলেমিশে থাকতে চাই। কোনো ধর্মীয় সংঘাত চাই না।’ মাদরাসা ছাত্রদের মন্দির পাহারার আন্তরিকতায় আপ্লুত হয়ে পড়েন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত মুগ্ধ হয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মন্দির ও হিন্দু সংখ্যালঘুদের ঘর পাহারা দিয়েছেন। বিষয়টাকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। আমাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরোধ করেছিলাম, নতুন সরকার আসা পর্যন্ত সংখ্যালঘু এলাকা, প্রতিষ্ঠান ও মানুষকে তারা নিরাপত্তা দিক। আমরাও দেশে মন্দির বা উপাসনালয়ে হামলার তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি।’ এ ছাড়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বিভিন্ন মন্দিরে উপস্থিত হয়ে নিরাপত্তার ঘোষণা, দেন। বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ঢাকাসহ দেশের একাধিক স্থানের মন্দির ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রহরির ভূমিকা পালন করেছে মাদরাসা শিক্ষক-ছাত্ররা।
২০২৪ সালের জুলাই ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা লাভ করে। যা বিশ্ব ইতিহাসের একটি গৌরবময় আখ্যান। হাজার হাজার শহীদ, প্রায় অর্ধ লক্ষ আহত-পংগু ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশে সৃজিত হয়েছে নতুন গৌরবময় ইতিহাস। দূর্নীতি মুক্ত আদর্শিক মানবিক সমাজ বিনির্মাণের অংগীকার নিয়ে যুগান্তকারী এই ইতিহাস বিনির্মাণে অংশ নিয়েছে জাতি-ধর্ম-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে দেশপ্রেমিক আলেম সমাজ।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে আলেম সমাজের অংশগ্রহণ এবং বিপ্লবী ভূমিকা বিশ্বের দরবারে সময়ের জীবন্ত ইতিহাস হয়ে থাকবে। বিশেষ করে ১ আগস্ট থেকে ৫ আগস্ট উলামায়ে কেরামের নির্ঘুম রাত,কারফিউ-জরুরী অবস্থা,শার্টডাউন,মূষলধারে বৃষ্টি সব কিছুই উপেক্ষা করে আমরা রাতভর ঘুরেছি মাদ্রাসা,মার্কাজ-দরবারে, সমন্বয় করেছি সকল মত- পথের উলামায়ে কেরামের সাথে।আর পরিকল্পনা মাফিক প্রতিদিন ভোররাত থেকেই আল্লাহর সাহায্য চেয়ে ছাত্র জনতার মিছিলে একাকার হয়ে ময়দানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ। ঐক্যবদ্ধ গণ অভ্যুত্থানের বিনিময়ে মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য যে স্বাধীনতা দিয়েছেন তা যেন টেকশই হয় সে তাওফিক কামনা করছি। সকল স্বৈরাচারী গোষ্ঠীর দৃশ্যমান বিচার,কাংখিত সংস্কার ও অপরাধ মুক্ত আদর্শ -মানবিক সমাজ বিনির্মাণে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই সকলের প্রতি।