মোহাম্মদ নুরুজ্জামান

উত্তরাঞ্চলের অবহেলিত জনপদের বঞ্চিত মানুষের প্রতীক রংপুরে পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী জাফরপাড়া বাবনপুর গ্রামের বহ্নিশিখা শহীদ আবু সাঈদ। সে ছিল সেদিনের এক জীবন্ত ধুমকেতু। শহীদ আবু সাঈদ ছিল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ১২তম ব্যাচের একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বাধিকারের আন্দোলনে তাঁর বিরত্বগাঁথা বিরল উৎসর্গ বিশ্বের আত্মাহুতির ইতিহাসে এক প্রজ্জ্বল নজির হয়ে আছে। শহীদ আবু সাঈদের সেদিনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশে গণঅভ্যুথানের মাধ্যমে জাতির কাঁধে চেপে বসা দীর্ঘদিনের জগদ্বল পাথর স্বৈশাসকের শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্তের মাধ্যমে পতন ঘটেছে। বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতার উত্তাল তরঙ্গের উর্মিমালায় ভেসে গেছে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ এবং নিষ্ঠুর এক দানবীয় স্বৈরাচারী শাষকগোষ্ঠি।

ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই বীর ২০০১ সালে রংপুরে পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের জাফরপাড়া বাবনপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের পিতা মকবুল হোসেন এবং মাতা মনোয়ারা বেগমের কোলজুড়ে পৃথিবীতে আগমন করে। ৯ ভাই-বোনের দরিদ্র পরিবারে কেবল তাঁর পক্ষ্যেই সম্ভব হয়েছিল উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের।

পতিত স্বৈরাচারী শাষকগোষ্ঠির দুঃশাষন গুম, খুন, হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন যখন জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে সর্বস্তরের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ঠিক সেই কালজ্বয়ী মুহূর্তে বুকের তাজা রক্ত অকাতরে ঢেলে দিয়েছেন টগবগে তাজাপ্রাণ শহীদ আবু সাঈদ। জুলুম শাহীর বৈষম্যের বিরুদ্ধে যখন উত্তাল কোটা সংস্কার আন্দোলনে গোটা দেশ উত্তপ্ত অগ্নিগর্ভ। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই সেদিনের উষ্ণ আবহাওয়ার পড়ন্ত বিকেলের ঢলে পড়া রক্তিম সূর্যের সাথে সেই তপ্ত আগ্নেয়গিরীতে নিজের বুকের তাজা লাল রক্তর ফল্গুধারা চিতিয়ে দিয়েছিল সেই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দিকপাল বিপ্লবের নায়ক শহীদ বীর আবু সাঈদ। তাঁর শোকাতুর শিক্ষক এবং সহপাঠিরা এই আত্মদানকে এখন গর্ব আর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। ইতোমধ্যে গত বছর আবু সাঈদের স্নাতকের যে ফল প্রকাশিত হয়েছে সেই ফলাফলে সে জিপিএ-৪ এর মধ্যে ৩ দশমিক ৩ পেয়ে মেধা তালিকায় ১৪তম স্থান অধিকার করে নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর উজ্জল করেছেন। পাশাপাশি চাকরির পরীক্ষায়ও তাঁর কৃতিত্বের ছাপ রয়েছে। শিক্ষাক্রমের জন্য সহপাঠীরা নতুন উদ্যামে ক্লাসে ফিরলেও, ফেরেনি কেবল শহীদ আবু সাঈদ। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডক্টর শওকত আলী শহীদ বীর আবু সাঈদকে বিশ্বের ইতিহাসে একজন ক্ষনজন্মা অকুতভয় বীর আখ্যায়িত করে বলেন, জাতিকে উদ্ধারের জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য নজির হয়ে থাকবে। তাঁর বীরত্বগাঁথা এই জাতি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে।

ইতোমধ্যে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর পরিবার এবং সহপাঠী শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁর আত্মত্যাগকে অম্লান করে রাখতে শহীদ বীর আবু সাঈদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের নামকরণ করে তা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছে। এছাড়া তাঁর নামকরণে একটি আবাসিক হল নির্মাণের উদ্যোগ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কার্যক্রমের মাস্টারপ্লানের মধ্যে এটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে বেরোবি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। তাঁর ছোট বোন সুমি খাতুনকে বেরোবির ইংরেজি বিভাগে চাকরি দিয়ে বেরোবি ক্যাম্পাসেই তাকে আবাসন সুবিধাও দেয়া হয়েছে।

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই উত্তাল গণআন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নং প্রধান গেটের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যখন শিক্ষার্থীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঠিক সে সময় অকুতোভয় আবু সাঈদ বুক চেতিয়ে এগিয়ে যায় জুলুমশাহীর পেটোয়া পুলিশ বাহিনীর সামনে। কিন্তু পাষণ্ড সেই ঘাতক বাহিনীর বুকে কোন দয়া ছিল না। ছিল কেবল বুলেটের ভাষা। জালিমশাহীর নরঘাতকদের তপ্ত বুলেটে মুহূর্তে ঝাঁঝরা করে দেয় তারা শহীদ বীর আবু সাঈদের বুক। এসময়ের উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে তরুণ সংবাদ কর্মী আবু রায়হান জানান, আবু সাঈদের সাথে আন্দোলন নিয়ে কথা বলে কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল তাঁর বুক। হৃদয়বিদারক এ স্মৃতি কখনও ভোলার নয়।

এক সংবাদকর্মী এবং শিক্ষার্থী তাওহিদুল হক সিয়াম জানান, দুঃসাহসী দৃঢ়চেতা আবু সাঈদের পাশেই ছিলাম। ৫-৬ জন পুলিশ তাঁকে ঘেরাও করে নিরস্ত্র আবু সাঈদের বুকে অন্তত ৬০টি বেপরোয়া গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করে। আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি। এ সময় স্বৈরশাসকের দোসর বেরোবির শিক্ষক আসাদ মণ্ডল ও মশিয়ার রহমান, কর্মকর্তা আবুল কালাম, তাপস কুমার ঘোষ, কর্মচারী নুরন্নবী, জনি ও নুরসহ বেশ কয়েকজন দোসর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি ইটপাটকেলের ঢিল ছোঁড়ে এবং দুর্ব্যবহার করে। গুলি এবং ঢিলের আঘাতে এসময় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। আহতদের নিরাপদে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। পরদিন ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নং প্রধান গেটের পাশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শহীদ বীর আবু সাঈদের গায়েবানা জানাজা আদায় করা হয়। আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডের পর ১৮ এবং ১৯ জুলাই র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির বিপুল সংখ্যক সদস্য সে সময় ক্যাম্পাসে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে। ২০ জুলাই কারফিউ জারি হয়। আর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসক নরঘাতক হাসিনার পতন ঘটে। বিজয় হয়, উন্মোচিত হয় বাংলার বুকে নতুন গণতন্ত্রের।

এরও আগে ১১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি পমেল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক মাহফুজার রহমান শামিমসহ বেশকিছু নেতাকর্মী আবু সাঈদকে হত্যা প্রচেষ্টা চালায়। শহীদ বীর আবু সাঈদের হত্যার অভিযোগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি প্রতিবেদনও দাখিল করেছে দায়ীদের চিহ্নিত করে। এছাড়া আবু সাঈদ হত্যা মামলা পিবিআইকে তদন্তের ভার দেয়া হয়েছে। শহীদ আবু সাঈদ হত্যার অভিযোগে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে মামলা এবং চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

এদিকে জুলাই’২৪ বিপ্লবের শহীদ আবু সাঈদ হত্যার দায়ে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি পোমেল বড়ুয়াকে প্রধান আসামি করে ৮ পুলিশসহ রংপুর বেরোবির শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারীসহ ৭১ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বাদী হয়ে বিগত ৭ মে বুধবার রংপুর মেট্রোপলিটন তাজহাট থানায় এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাজহাট থানার ওসি শাহ্ আলম সরদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ শওকত আলী সাংবাদিকদের জানান, ৫ আগস্টের পর বেরোবির আন্দোলন দমন এবং নির্যাতনের ব্যাপারে জড়িতদের শনাক্ত করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্তের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে ৭১ জনের নামে এই হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই ঘটনায় অন্তত শতাধিক ব্যক্তি জড়িত রয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহযোদ্ধা এবং সহপাঠীরা তাঁদের অনুভুতি ব্যক্ত করে জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই আবু সাঈদ নির্ভীক ছিল। সে সাহসের সাথে সফলভাবে সকল দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা জানান, আবু সাঈদ অবসরে টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালাতো। মানুষের বিপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়াতো। আবু সাঈদের শাহাদাতের পর ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও তাদের সন্ত্রাসী দোসররা।