ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

চব্বিশের জুলাই মানে নতুন এক ইতিহাস। প্রতিবাদ, আত্মত্যাগ আর ছাত্রজনতার বিজয়ের প্রতীক। ৩১ জুলাইয়ের ক্যালেন্ডারে ৩৬ জুলাই পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে নতুন তারিখ। ৩২ থেকে ৩৬ জুলাই শুধুমাত্র একটি নতুন তারিখের বালখিল্যতা ছিলো না, বরং এটি ছিলো আন্দোলনের একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট অব কমিটমেন্ট’। আন্দোলনের শক্ত হাতে হাল ধরে বিজয়ে হাওয়ায় পাল উড়িয়ে দেবার ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত। এই স্রোত অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সাম্য আর অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে। অস্ত্র ছিল না, ছিল সাহস; বিপ্লবী চেতনা আর ন্যায্যতার স্বপ্ন। এই জুলাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে আরেকটি কালো অধ্যায় মুছে ফেলার এক সংগ্রামী ঝড়। ন্যায্য অধিকার আদায়ের এক বজ্্রকঠিন আন্দোলন। বৈষম্যহীন ও সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশিত প্রতিশ্রুতি। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের খরস্রোতা ঢেউয়ে সর্বশ্রেণির গণমানুষের মুক্তির উচ্ছাসে এক কালবৈশাখী তাণ্ডব। জগদ্দল পাথরকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে নতুন স্বপ্নের সুখি বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে যাবার সাহসী পতাকা। বৈরি বাতাসে লাগাম টানতে গিয়ে তাইতো শিক্ষার্থীদের কোমল আত্মার সাথে প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো হাজারো মুক্তিকামী স্বপ্নবাজ মানুষকে। একটি বছর পেরিয়ে আজ পর্যালোচনার বিষয়, ইতিহাসের এই অধ্যায়ে কী পেয়েছে বাংলাদেশ, কতটা সফল হয়েছে বিপ্লবীরা!

সংস্কার, বিচার এবং জননিরাপত্তার বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। না পেরেছে সংগ্রামীরা। না পেরেছে ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট। রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে কতটা সহযোগিতা করছে সেটাও বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে। ক্ষমতার দোলাচালে তারাও পার পেতে চাচ্ছেন যেনতেনভাবে। ফলে নির্বাচন হয়ে উঠেছে মূখ্য বিষয়। আন্দোলনে যারা নেমেছে, তাদের প্রত্যেকেরই তো রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল। সেসব এজেন্ডা যে বের হয়ে আসছে, এটা খুবই স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যারা ক্ষমতায় আসতে চায়, তাদের কথা বাদই দিলাম; যারা গণতন্ত্রকে পছন্দ করে না, তারাও এখন কথা বলতে শুরু করেছে। তারাও এখন গণতন্ত্রের নামে নির্বাচন ইস্যুকেই প্রধান বিষয় হিসেবে দেখছেন।

এই বিপ্লবকে ঘিরে প্রায় দুই হাজারের বেশি মতো মামলা হয়েছে। জীবন দিয়েছে প্রায় দুই হাজার মানুষ। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে। অথচ বিচারিক প্রক্রিয়ার কোনো উন্নতি এখনো খুব বেশি দৃশ্যমান হয়নি। আন্দোলনে অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ ছাড়াও একটি বড় অংশ আছেন রিকশাওয়ালা, পোশাককর্মীসহ নানা শ্রেণিপেশার খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের অনেকেই সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাদের অনেকেই এখনো ট্রমায় ভুগছেন। অথচ তাঁদের সকলের দায়িত্ব নিয়ে তেমন কেউ কাজ করছেন না। অন্যদিকে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার বাহ্যিকভাবে সরে গেলেও তাদের অনুসারী প্রেত্মারা এখনো সজাগ। তারা বিভিন্ন দলে ঢুকে পড়ছে। নতুন দলের মিটিংয়ে বক্তব্য শেষে পুরোনো শ্লোগান এখনো উচ্চারণ করেন অজান্তেই। ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থেকে অন্যায়কারী সকল ব্যক্তির বিচারের ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করা দরকার।

আমাদের নতুন প্রজন্ম একটি বিপ্লব সংগঠিত করেছে। আমরাও সাথে ছিলাম। পরবর্তীতে এখানে অনেক ভুলত্রুটি এবং নৈতিক বিচ্যুতিও ঘটেছে। কেউ কেউ অনৈতিকভাবে ফায়দা লোটার চেষ্টাও করেছেন। এতো কিছুর পরেও, অন্তত সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের যে মানসিক উত্তরণ ঘটেছে সেটাও কম অর্জন নয়। মানসিক বিপ্লবটি ছিল সবচেয়ে বড় অর্জন। মানুষ বুঝতে শিখেছে যে পরিবর্তন সম্ভব। শুধু দরকার সংগঠিত শক্তি, সৎ নেতৃত্ব আর অটল মনোবল। নির্যাতিত জনগণের মুখে ফিরে এসেছে প্রতিবাদের ভাষা। ফ্যাসিবাদের পতন একটি বড় সফলতা। এটি অনেক বড় ব্যাপার। এখন আমরা ক্রমাগত যতগুলো ভালো নির্বাচন করে যেতে পারি, ততোই আমাদের গণতন্ত্র পরিগঠিত হতে থাকবে। এখন প্রয়োজন ঐকমত্য। এখন প্রয়োজন দেশ গড়ার সুদৃঢ় সংকল্প। তরুণ প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়েছে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। এটি ছিল একটি চেতনার জাগরণ। এই ইতিবাচক দৃষ্টিভংগিকে পরিকল্পিত উপায়ে উত্তম খাতে প্রবাহিত করার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এর জন্য রাজনৈতিক দলসহ দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকে সচেতনতা দরকার, দরকার উন্নত পরিকল্পনার ভিত্তিতে কর্মপন্থা নির্ণয় করা।

জুলাই বিপ্লবের পরে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মতো নেতৃত্ব আবশ্যিক ছিল। আন্তর্জাতিক এবং সে সময়ের অভ্যন্তরীণ গ্রহণযোগ্যতা তাঁকে ছাড়া সম্ভব হতো না। তবে গণঅভ্যুত্থানের সরকার হবার কারণে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় আটকে গেছেন তারাও। ফলে ফ্যাসিবাদী স্বার্থ আদায়ে নানামুখি নাটক প্রতিরোধ করা গেেলও সমূলে উৎপাটন করা যায়নি। তবে আশার দিক হচ্ছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এইসব প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে এনসিপিসহ নতুন কয়েকটি রাজনৈতিক দল, যারা রাজনীতির ভাষা ও চরিত্র বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি, গণঅভ্যুত্থান সফল করার পর দু’চারটি পদস্খলন ছাড়া এখন পর্যন্ত প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই হলো ভিন্নমতের সহাবস্থান। কেউ সংস্কারের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে- এটাই স্বাভাবিক। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কখনোই দমনীয় নয়। আর সেই সত্য মেনেই ভবিষ্যতের পথে এগোতে হবে। আমরা আর কখনো চাই না কেউ গুম হোক, রাজপথে গুলিবিদ্ধ হোক, কিংবা ভিন্নমতের অপরাধে ভীতসন্ত্রস্ত জীবন যাপন করুক।

দুর্নীতি বা কিংবা যে কোন ধরনের সহিংসতার পুনরুত্থান দমাতে হলে একটি শক্তিশালী সরকার দরকার। সরকার শক্তিশালী হয়, যখন তার পেছনে জনসমর্থন থাকে। নির্বাচন জনসমর্থনের একটি পথ। তাই আমি অবশ্যই নির্বাচনের পক্ষে। নির্বাচন দিয়েই আমাদের এগোতে হবে; কিন্তু সবকিছু নির্বাচনসর্বস্ব মনে করলে খুব বেশি লাভ হবে না। এ জন্য সংস্কার খুব জরুরি। সংস্কার নিয়ে এখনো কাটেনি ধুম্রজাল। এখন প্রশ্ন হতে পারে, আমরা কি সংস্কার চাই? রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন বসছে। এ আলোচনা মোটের ওপর নিষ্ফল হতে দেখছি। ঐকমত্য কমিশন এখনো ঐকমত্যে নিয়ে আসতে পারেননি সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে। কারণ, সংবিধান সংস্কারসহ ছয়টি কমিশনের রিপোর্টে আমরা খুব বেশি আশাবাদী হতে পারিনি। সরকার যেন স্বৈরাচারী হয়ে না উঠতে পারে সে জন্য জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এ পন্থা শুধু সংসদ নির্বাচনে বা স্থানীয় সরকারে নয়, সর্বত্রই প্রয়োজন। অথচ প্রশাসনিক সংস্কার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সংস্কারেও এখনো ইতিবাচক কোন সফলতা দৃষ্টিগোচর হয়নি।

সবকিছুর পরও সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকা, ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, হাইকোর্টের বেঞ্চ জেলায় যাওয়ার মতো কিছু বিষয়ে কছিুটা ইতিবাচক দৃষ্টিভংগীর প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।

নির্বাচনী সংস্কারের দাবি এখন জনগণের মুখে মুখে। রাষ্ট্রযন্ত্রে গোঁড়ামি, প্রশাসনে দুর্নীতির করাল গ্রাস ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি এখনো আগের মতোই বহাল। এখনও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও দমন-পীড়ন চলছে। মিথ্যা অপবাদের ছড়াছড়ির মাধ্যমে ভিন্নমতের দমনের চেষ্টা অব্যাহত। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমছে না। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি থামছে না। পেশীশক্তির দাপট সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জুলাই গণহত্যার আন্তর্জাতিক মানের বিচার নিশ্চিতকরণ। ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন, যা ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে রূপরেখা দেবে। প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার এবং দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন।

ইতোমধ্যে একটি বছর পার হয়ে গেছে। এখনো অনেক মায়ের কান্না থামেনি, অনেক বাবার চোখে এখনো ঝরছে আগুন। সফলতা ও ব্যর্থতার দোলাচালে তবুও বলতেই হয়, জুলাই বিপ্লব আমাদের মনে করিয়ে দেয় সত্য, সাহস ও চেতনার কণ্ঠ কখনো দমিয়ে রাখা যায় না। এই বিপ্লব শুধু অতীতের নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্যও বার্তা বয়ে আনে। এই চেতনা হোক আগামী দিনের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। তরুণদের বিশ্বাস, বলিষ্ঠ কণ্ঠ ও বিবেকী অবস্থানই বদলে দিতে পারে একটি জাতির ভবিষ্যৎ। জুলাই বিপ্লব আমাদের ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ দিয়েছে। এখন দরকার স্বৈরাচারী আমলের চিন্তাভাবনা, পশ্চাৎপদ মানসিকতা, অন্য দেশের মুখাপেক্ষী মনোভাব, ক্ষমতার তোষণ, পদপদবি ও পুরস্কারের লোভ থেকে দায়িত্বশীলতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। বাংলা একাডেমি থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন দেশপ্রেমিক ও জনবান্ধব চিন্তাধারায় কাজ করতে হবে। জুলাই বিপ্লবের চেতনায় ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে বাংলাদেশী সংস্কৃতি, শিল্প ও জীবনাচারের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও মৌলিক সংস্কার এখন সময়ের দাবি।