২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন ও তার ভারতে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ এক বিশাল ঘটনা। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক পালাবদলের এতো বড়ো ঘটনা এর আগে ঘটেনি। চব্বিশ এর জুলাইয়ে ছাত্রসমাজকে কেন্দ্রে রেখে ঘটে যাওয়া এই সফল জাতীয় জাগরণে সর্বস্তরের যত বিপুল সংখ্যক মানুষ সরাসরি শরিক হয়েছে এর আগে তার কোনো নজির নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এক বছর পূর্ণ হবে আগামী ৮ আগস্ট। এই এক বছর মেয়াদে সরকারের নেওয়া নীতিগত সিদ্ধান্ত, রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ, কূটনৈতিক অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা হয়েছে এবং বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছে। গত এক বছরে এই সরকার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখিয়েছে। ইউনূস সরকারের অন্যতম বড় সাফল্য আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এবং জুলাই গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে এবং মানবাধিকার ইস্যুতে সরকার তার নীতি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বিগত সাড়ে ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, আর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। দায়িত্ব নিয়েই ভঙ্গর অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিচারব্যবস্থা ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত চীন, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ানের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা চলমান, যা ভবিষ্যতে কূটনীতি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার নতুন ধারা শুরু হয়েছে, যদিও এখনও কার্যকর সমাধান আসেনি। বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে সরকার কৌশলী ভূমিকা রাখছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করছে। সবমিলিয়ে গত এক বছর আন্তর্জাতিক মহলের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। এদিকে বাংলাদেশে গত বছর ছাত্রদের নেতৃত্বে হওয়া বিক্ষোভে যেভাবে প্রাণঘাতী দমন অভিযান চালানো হয়, তা সরাসরি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনে হয়েছিল। এমনটাই জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানী ইউনিট ‘বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশন’, আল জাজিরা এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনে।
এছাড়াও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠকে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার আশাবাদ প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও নেপালের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠককে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে ধরা যায়।
আন্তর্জাতিক সমর্থন: নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ গ্রহণ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। এই সরকারে ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে ১৬ জন উপদেষ্টা রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট ২০২৪) রাত ৯টায় বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শপথ বাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পরে অন্য উপদেষ্টাদের শপথ পাঠ করান তিনি। এরই মধ্যে সরকারকে সমর্থন দিতে শুরু করেছেন বিশ্বনেতারা। একে একে সমর্থন জানিয়েছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ, সৌদিআরব, কাতার, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, ইটালি।
যুক্তরাষ্ট্র : অন্তর্বর্তীকালীন নতুন এই সরকারের শপথগ্রহণের পরই নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বলেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ইতিমধ্যেই তাদের যোগাযোগ হয়েছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে বলে নিজেদের চাওয়ার কথাও সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে ওয়াশিংটন। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক সহিংসতা বন্ধের জন্য ড. ইউনূসের আহ্বানকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানিয়েছে। জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সভাকক্ষে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বৈঠক বিরল। প্রথা ভেঙে এ বৈঠকে বাইডেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বৈঠকেও সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য ও প্রবাসী আয়ের মূল উৎস যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে যে ইতিবাচক উত্তরণ ঘটেছে, বাইডেন ও ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ফলপ্রসূ বৈঠক তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে।
চীন : বাংলাদেশে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনকে স্বাগত জানিয়েছে চীন। একই সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে তারা। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তাদের মুখপাত্র এ কথা জানান। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচনার আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার আগ্রহের কথা জানায় চীন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাফল্য নিয়ে আসে। বিশেষ করে চলতি বছরই যখন বাংলাদেশ ও চীন তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করছে। এই সফর এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন উভয় দেশ জটিল ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উচ্চাশা থাকলেও এই সফরের মূল্যায়ন করতে হবে একটি বাস্তবসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে, যেখানে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বর্তমান ধারা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা উভয়কেই বিবেচনায় নিতে হবে। ২০২৫ সাল বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। যদিও নতুন কিছু প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এই সফরের মূল লক্ষ্য হবে বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। চীন এরই মধ্যে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে। চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ প্রচারের ওপর জোর দিচ্ছে, যা একটি বিকল্প উন্নয়ন মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ড. ইউনূসের চীন সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ-চীন সহযোগিতা। চীন প্রস্তাব দিয়েছে যে কুনমিং শহরের চারটি হাসপাতাল শুধু বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হবে এবং ঢাকায় একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণে সহায়তা করা হবে। বাংলাদেশের জন্য আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চীনের সমর্থনে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে ভারত আপত্তি তুলেছে, অন্যদিকে চীনের ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশেও উদ্বেগ রয়েছে। বাংলাদেশ ও চীন উভয়ই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হিসেবে প্রত্যাবাসনকে সমর্থন করে, তবে কার্যকর অগ্রগতি এখনো আশানুরূপ হয়নি।
মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে কপাল খুলছে লাখো বাংলাদেশির: বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি প্রবাসী আয়। আর এই আয়ের একটি বড় উৎস দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। অবশেষে কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে সেই বন্ধ দরজা খুলতে চলেছে প্রায় ১২ লাখ বাংলাদেশি কর্মীর জন্য। বহুল প্রতীক্ষিত বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চলতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ায়। এই বৈঠকে বাংলাদেশিদের জন্য দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার পুনরায় চালুর ঘোষণা আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতার ফলেই এ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এটা বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার বড় সাফল্য।
জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন: দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তলানিতে গিয়ে পৌঁছে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ভিন্নমত দমন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সহায়তার প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উত্তরণ ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি করিম এ এ খানের বৈঠকটি জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচারের ক্ষেত্রে একটি নতুন পথ খোলার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।
দেশের অর্থনীতি কূটনীতিতে নতুন দিগন্ত: অর্থনৈতিক সহায়তার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা বাংলাদেশকে ৩৫০ কোটি ঋণসহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, যার ২০০ কোটি ডলার নতুন ঋণ। আইএমএফের সঙ্গেও ৩০০ কোটি ডলারের নতুন ঋণের ব্যাপারে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্নীতি, অনিয়ম কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা রীতিমত নাজুক হয়ে পড়েছিল। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার কয়েক মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ড. ইউনূসের কাতার সফর: বাংলাদেশ ও কাতারের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে উষ্ণ ও অংশীদারত্বপূর্ণ। ১৯৭৮ সালে কাতারে বাংলাদেশের দূতাবাস খোলার পর থেকে দুদেশের মধ্যে শ্রমবাজার, জ্বালানি, শিক্ষা এবং বিনিয়োগ খাতে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কূটনৈতিক অগ্রগতির অন্যন্য উদাহরণ হলো, ড. ইউনূসের সফরের অন্যতম সাফল্য ছিল কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানির সঙ্গে সরাসরি বৈঠক। এই বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা এবং তরুণসমাজের ভূমিকার বিষয়ে আলোচনা করেন। সফরে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করতে কাতার একজন বিশেষ উপদেষ্টা নিয়োগ করবে। এ উদ্যোগ ভবিষ্যতে দুদেশের মধ্যকার যোগাযোগ, বিনিয়োগ, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা আরও সুসংহত করবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাতার সফর বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এ সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ পেল না, বরং বৈশ্বিক অঙ্গনেও নিজেদের উন্নয়ন, সংস্কার ও তরুণ নেতৃত্বের ভাবনা নতুন করে উপস্থাপন করতে সক্ষম হলো। কাতারের রাজধানী দোহা ও ভ্যাটিকান সিটিতে সপ্তাহব্যাপী সরকারি সফর শেষে গতকাল সোমবার দেশে ফিরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চলতি বছরের ২১ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত এ দুটি দেশে সফরকালে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্ট ও উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন। বর্তমানে ৪ লক্ষাধিক বাংলাদেশি শ্রমিক কাতারে কর্মরত, যারা বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়ের একটি বড় অংশ সরবরাহ করেন।
জাপান সফর কূটনীতির নতুনমাত্রা: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাপান সফরে প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবারের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সফরটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনর্জাগরণ এবং অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। বৈঠকে বাণিজ্য, অর্থনীতি, উন্নয়ন সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা, কারিগরি সহায়তা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলোচনা হবে। সফরে ছয় থেকে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি চলছে এবং জাপান কর্তৃক এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজেট সহায়তা ঘোষণার সম্ভাবনাও রয়েছে। এর মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন বাজেটারি সহায়তা, ২৫০ মিলিয়ন রেল খাতের উন্নয়নে এবং ২৫০ মিলিয়ন অন্যান্য খাতের জন্য। ড. ইউনূস ২৯ ও ৩০ মে টোকিওতে আয়োজিত ‘নিক্কেই ফোরাম: ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে অংশ নেবেন। সেখানে তিনি এশিয়ার ভবিষ্যৎ উন্নয়ন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ে বক্তব্য রাখবেন। সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, লাওসের প্রেসিডেন্ট থংলাউন সিসুলিথ, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেট, পালাউয়ের প্রেসিডেন্ট সুরাঞ্জেল হুইপস জুনিয়র এবং সিঙ্গাপুরের উপপ্রধানমন্ত্রী জেন কিম ইয়ংসহ অন্যান্য আঞ্চলিক নেতা। জাইকার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ পর্যন্ত জাপান বাংলাদেশে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থ সহায়তা প্রতিশ্রুত করেছে। এই সহায়তার মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল।
জাতিসংঘের জুলাই গণহত্যা বিষয়ক প্রতিবেদন: জাতিসংঘের জুলাই গণহত্যা বিষয়ক প্রতিবেদনকে সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে না। বরং, এটি সরকারের জন্য একটি সমালোচনামূলক প্রতিবেদন, যা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তৎকালীন সরকারকে দায়ী করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় ((OHCHR) কর্তৃক প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনার তদন্ত করা হয়েছে এবং তাতে দেখা গেছে যে, সে সময় সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত ছিল। এই প্রতিবেদনকে সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে না কারণ: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশে বিক্ষোভ দমনে নৃশংসতা, পদ্ধতিগত নিপীড়নের তথ্য এবং গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সাবেক সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংস উপাদানগুলোর পাশাপাশি, গত বছরের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহের সাথে জড়িত ছিল। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য এবং অন্যান্য প্রমাণের ভিত্তিতে, প্রতিবেদনে একটি সরকারি নীতি উঠে এসেছে যা সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের এবং সমর্থকদের আক্রমণ ও সহিংসভাবে দমন করার নির্দেশ দেয়, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের মত উদ্বেগ উত্থাপনকারী এবং জরুরীভাবে আরও ফৌজদারি তদন্তের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
বিবিসি আই’র অনুসন্ধান: বাংলাদেশে গত বছর ছাত্রদের নেতৃত্বে হওয়া বিক্ষোভে যেভাবে প্রাণঘাতী দমন অভিযান চালানো হয়, তা সরাসরি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনে হয়েছিল। এমনটাই জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানী ইউনিট ‘বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশন’। বিবিসি আই একটি ফোনালাপের অডিও বিশ্লেষণ করেছে, যাতে হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, “যেখানেই ওদের (বিক্ষোভকারী) পাওয়া যাবে, গুলী করা হবে”। বুধবার (৯ জুলাই ২০২৫) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বিবিসি। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ওই ফোনালাপ এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলায় গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি বর্তমানে ভারতে পালিয়ে আছেন এবং অনুপস্থিত অবস্থায়ই তার বিচার চলছে। জাতিসংঘের তদন্তকারীদের মতে, গত বছরের জুলাই-আগস্টে সহিংস ওই বিক্ষোভে প্রায় ১৪০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন।
আল জাজিরার ইনভেস্টিগেশন: গত বছর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে হওয়া আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দিয়েছিলেন— সম্প্রতি বিবিসির যাচাই করা একটি কথোপকথনের অডিও রেকর্ডিং ফাঁস হওয়ার পর একই ধরণের বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল জাজিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর তার সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত শিক্ষার্থীদের ওপর ‘মারাত্মক অস্ত্র ব্যবহার’ এবং ‘যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই গুলী করার’ ‘একটি খোলা আদেশ’ জারি করেছিলেন।