ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ভয়ঙ্কর হাতিয়ার ছিল গুম-খুন। ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে ভিন্ন মতের মানুষকে দমনে ‘গুম’ করা হয়। গুমের শিকার মানুষকে অজ্ঞাত স্থানে রেখে চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন। তার শাসনের সাড়ে ১৫ বছরে বহু মানুষকে গুম করা হয়েছে। কিছু দিন পরপরই মানুষ নিখোঁজ হয়ে যেতো। বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসতো না। ভিন্ন মতের মানুষ, রাজনীতিক দলের নেতা, ছাত্রনেতা, সচেতন প্রতিবাাদী মানুষকে টার্গেট করে সরকারি বাহিনী। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে বা সরকারের বিপক্ষে যায় এমন কোনো বিষয়ে মত প্রকাশ করা হলেই তাকে টার্গেট করা হতো।

মায়ের সামনে থেকে সন্তানকে, সন্তানের সামনে থেকে বাবাকে, স্ত্রীর সামনে থেকে স্বামীকে, ভাইয়ের সামনে থেকে ভাইকে- বাবার সামনে থেকে ছেলেকে তুলে নেয়া হতো। আর বেশিরভাগ ঘটনা ঘটেছে সাদা পোশকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে। একসময়ে সাদা পোশাক-সাদা গাড়ি মানুষের কাছে একধরনের আতঙ্ক হয়ে ওঠছিল। গুম হওয়া ব্যক্তির অপেক্ষায় বছরের বছর পথ চেয়ে থাকেন স্বজনরা। প্রিয়জনের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থেকে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে কত মায়ের। আর শেষ পর্যন্ত প্রিয় সন্তান বা স্বামীর খোঁজ না পেয়ে নিজেই চলে গেছেন মত্যুর কাছে এমন ঘটনাও ঘটেছে অনেক। গুম-অপহরণ বা নিখোঁজের ঘটনাগুলো শুধু দেশেই নয়-আলোচিত হয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। জাতীয়-আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বাংলাদেশে গুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো চাপ প্রয়োগের পরও তখনকার ফ্যাসিস্ট সরকার গুম করা থেকে ফিরেনি। এরপর যুক্তরাষ্ট কয়েকজন শীর্ষ র‌্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিলে দায়সারাভাবে একটি তদন্ত কমিটি করে। কিন্তু এতকিছুর পরও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার গুম করা থেকে একেবারেই ফিরে আসেনি। ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিরোধী মত দমনে ভয়ঙ্কর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে গুমের ঘটনা ঘটিয়েই চলছিল। সর্বশেষ ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর বেরিয়ে আসে আয়নাঘরের ভয়ঙ্কর অজানা তথ্য। গুম ফেরত ব্যক্তিরা যেসব তথ্য দিয়েছে যা শিহরে ওঠার মতো। অনেকটা আইয়্যামে জাহেলিয়াতের ঘটনাকেও হার মানায়। তবে এখনো ফিরেনি অনেকে।

গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনে গুম ফেরত ব্যক্তিরা যেসব তথ্য দিয়েছে তা অনেকটাই অবিশ্বাস্য। তারা বলেছেন, শুধুমাত্র ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এভাবে গুমের ঘটনা যেন আর কোনো দিন না ঘটে। বাংলাদেশে যেন আর গুম ফিরে না আসে। তবে এখনো যাদের সন্ধান মেলেনি সেই পরিবারগুলোর দীর্ঘশ্বাস এখনো থামেনি। তাদের প্রশ্ন- আমাদের প্রিয়জনরা যদি এখনো ফিরে না আসে তবে কোনদিন আসেব? তারা কি আর কোনোদিন ফিরবে না? তাদের শেষ পরিণতি কি আমরা জানতে চাই। গুমের শিকার পরিবার নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর ব্যানারে রাজধানীতে বছরের পর বিক্ষোভ-মানবন্ধন করে আসছেন পরিবারের সদস্যরা।

৫ আগস্ট অভ্যুত্থান ঘটলে দীর্ঘ আট বছর পর গোয়েন্দা সংস্থার ‘গোপন বন্দীশালা’ থেকে মুক্ত হন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। রাষ্ট্রীয়ভাবে গুমের শিকার রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠক ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সদর দপ্তরের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর সেই আয়নাঘরের সামনে বিক্ষোভ করেছেন গুম হওয়াদের স্বজনরা। এছাড়াও ‘আয়নাঘর’ থেকে যারা ফিরে এসেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন: লে. কর্নেল হাসিনুর রহমান, মোবাশ্বার হাসান, মারুফ জামান এবং অনিরুদ্ধ কুমার রায়। এদের মধ্যে লে. কর্নেল হাসিনুর রহমান সর্বপ্রথম আয়নাঘরের বিষয়টি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। মোবাশ্বার হাসান, যিনি পূর্বে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, তিনিও এই ঘর থেকে ফিরে এসেছেন। এছাড়া, মারুফ জামান (সাবেক রাষ্ট্রদূত) এবং অনিরুদ্ধ কুমার রায় (একজন ব্যবসায়ী) এই ঘর থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন। এদিকে দীর্ঘ আট বছর পর গোয়েন্দা সংস্থার ‘গোপন বন্দীশালা’ থেকে মুক্ত হন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। রাষ্ট্রীয়ভাবে গুমের শিকার রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠক ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সদরদপ্তরের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত সেই কুঠুরিতে বছরের পর বছর মানুষকে আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর সেই আয়নাঘরের সামনে বিক্ষোভ করেন গুম হওয়াদের স্বজনরা।

শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের শিকার ৭৩০ ব্যক্তি: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুমের শিকার হয়েছেন ৭৩০ ব্যক্তি। তাদের মধ্যে ৮৩ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ফেরত না আসা ব্যক্তির সংখ্যা ১৬২। ‘গুমের সঙ্গে জড়িতদের অবিলম্বে বিচার কর’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব তথ্য জানানো হয়। সভায় গুম থেকে ফেরত আসা সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান বলেন, ‘গুমের সব আলামত নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আয়নাঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’ তাঁর অভিযোগ, ‘গত ১০ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্য কিছুই করেনি।’ গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের দাবি জানান গুম থেকে ফিরে আসা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে আহমাদ বিন কাসেম আরমান। তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে পুনর্বাসনের জন্য আলাদা কমিশন বা কমিটি গঠন করা হোক।’ অধিকারের সভাপতি তাসনিম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সভায় বক্তৃতা করেন সাংবাদিক ফাইজুল হাকিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শরিফুল ইসলাম, সাংবাদিক সভায় শেখ হাসিনাকে আয়নাঘরের নিউক্লিয়াস উল্লেখ করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রোববার ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হবে। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘বিচারের কাজ পুরোদমে এগোচ্ছে। তবে তদন্ত শেষ করতে যুক্তিসংগত সময় লাগবে। এর মধ্যে ১০ থেকে ১৫টি উল্লেখযোগ্য গুম ঘটনার তদন্ত শেষ হয়েছে। জুন মাসের মধ্যে প্রতিবেদনগুলো পাওয়া যাবে। গুমের ঘটনার বিচারের ক্ষেত্রে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাবে।’ বিচার প্রক্রিয়ায় বাধা অনেকটা দূর হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অপরাধের কাঠামো এবং অপরাধী সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মোটাদাগে তথ্য চিহ্নিত করতে পেরেছে। তবে গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে কিছুটা বাধা থেকেই গেছে। তাজুল ইসলাম জানান, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে তারা খুবই সাবধানতা অবলম্বন করছেন। বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও মানবাধিকার রক্ষা করার দিকে নজর রাখছেন। বিচারের নামে অতীতে যে অবিচার হয়েছে, সেগুলো যেন না হয়, সে বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছেন।

সভায় দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম-সংক্রান্ত একটি ছবি প্রকাশ করার কারণে তাঁকেসহ দৃকের কর্মরতদের র‌্যাব কীভাবে হেনস্তা করেছিল, তা তুলে ধরেন। অধিকারের জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা তাসনীম ফাহমিনা অধিকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেন তিনি। গুম প্রতিরোধে কার্যকর আইন প্রণয়নে যে খসড়া করা হয়েছে, তাতে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

৩৩০ গুম ব্যক্তির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ‘ক্ষীণ’: দেশে গুম হয়ে ফিরে না আসা ৩৩০ জন ব্যক্তির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান চলছে বলে জানিয়েছেন গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মইনুল ইসলাম চৌধুরী। তবে এদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ‘ক্ষীণ’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘কিন্তু কয়েকজন বেঁচে থাকতে পারে।’ সম্প্রতি গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির কার্যক্রম নিয়ে ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন কারাগারে গত দুই-আড়াই বছরে আটক এক হাজার ৬৭ জনের নাম-ঠিকানাসহ একটি তালিকা পাওয়া গেছে বলেও জানান কমিশন সভাপতি। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলার পুলিশ সুপার ও বিজিবি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ভারত থেকে পুশইন করা ব্যক্তিদের তথ্য চাওয়া হলে ১৪০ জনের তালিকা পাওয়া গেছে। তবে এ তালিকায় গুম হওয়া কোনো ব্যক্তির নাম এখনো পাওয়া যায়নি।

গুমের শিকার ব্যক্তিদের ৪ ধরনের পরিণতি হয়েছে: গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য ৪ ধরনের পরিণতি হয়েছে। গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মইনুল ইসলাম চৌধুরী একথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সম্ভাব্য ৪ ধরনের পরিণতি হয়েছে। এগুলো হলো- এক. গুমের শিকার ব্যক্তিকে হত্যা করা। দুই. বিচারের আগেই মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করে জঙ্গি তকমা দিয়ে বাংলাদেশেই বিচারাধীন বা নতুন ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার দেখানো। তিন. তাকে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে সে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে গ্রেফতারের ব্যবস্থা করা। চার. ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া। গুম কমিশনের ২য় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন গত ৪ জুন প্রধান উপদেষ্টা বরাবর জমা দেওয়ার পর আজ দুপুরে রাজধানীর গুলশানে গুম সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মইনুল ইসলাম চৌধুরী এ সব কথা বলেন। গুম কমিশনের সভাপতি বলেন, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত দমননীতির অংশ হিসেবে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরেও বহু অপরাধী ও তাদের শুভাকাক্সক্ষীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকায় অনেক জোরালো প্রমাণ ও নিদর্শন ধ্বংস, অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানারকম ভীতিকর ও আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তবুও বহু ভুক্তভোগী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের অভিযোগ ও অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিস্তারিতভাবে সে কাহিনি তুলে ধরেছেন। গুম সংক্রান্ত কমিশন অফ ইনকোয়ারির সভাপতি আরো বলেন, বিগত সরকারের শাসনামলে গুম একটি সুশৃঙ্খল ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে ‘জঙ্গিবাদবিরোধী’ অভিযানের ছায়াতলে ইসলামি উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ও শাসন দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ছিলেন- মেধাবী শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক কর্মী ও সাংবাদিক থেকে সাধারণ জনগণ। মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এ প্রক্রিয়ায় তারা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে অস্ত্র বানিয়েছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন করে এবং নির্যাতন ও গোপন আটকের সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চালু করেছিল। এমনকি সাধারণ নাগরিকদের বেআইনি পন্থায় বারবার ভারতীয় বাহিনীর হাতেও তুলে দেওয়া হয়েছিল।

না ফেরা স্বজনদের আকুতি: হাসিনা সরকারের পতন, আয়না ঘরের সন্ধান এবং কিছু মানুষ গুম থেকে ফেরে আসার পর অনেকের মনে আশা জেগেছিল প্রিয় জন হয়তো ফিরে আসবে। হয়তো গুম হওয়া মানুষটিকে দীর্ঘ দিন পর ফিরে পাবে স্বজনরা। কিন্তু তা হলো না। রাষ্টীয় বাহিনীর বন্দিশালা আয়না ঘরে কয়েকজনকে পাওয়া গেলেও অনেকেরই খোঁজ মেলনি। তারা বেঁচে আছেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। যার ফলে সেবব নানুষেল স্বজনরা আবারও হতাশ হয়েছেন। আবার তারা রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। একটি মানবন্ধনে এভাবেই আকুতি জানা শোনা যায়- ‘আমরা বিচার পাচ্ছি না। আমাদের জন্য কোনো দেশ স্বাধীন হয়নি। আমরা তো আমাদের বাবাদের ফেরত পাইনি। আমাদের এখনো কেন এভাবে দাঁড়াতে হয়? আয়নাঘরে কোনো লোক নেই, তাহলে ওই লোকগুলো কই? আমাদের বাবারা, আমাদের চাচ্চুরা কোথায়? তাদের এভাবে মেরে ফেলতে পারে না। ’রাজধানীর হাইকোর্টের মাজার গেইটের সামনে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচিতে কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলছিল গুমের শিকার বংশাল থানা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পারভেজ হোসেনের মেয়ে আদিবা ইসলাম হৃদি। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগ থেকে যখন পারভেজ হোসেন নিখোঁজ হন, তখন তার মেয়ে হৃদির বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। ছোট্ট সেই শিশুর বয়স এখন প্রায় ১৪ বছর। কিন্তু এখনো বাবাকে খুঁজে পায়নি সে। পায়নি বিচারও। তাইতো গুম সংক্রান্ত কোনো অনুষ্ঠান হলেই বাবার ছবি হাতে সেখানে ছুটে যায় হৃদি। অবস্থান কর্মসূচিতে হৃদি বলছিল, ‘আমরা বিচার চাই। আমার ভাইটা তো বাবাকে দেখেইনি। আমি শুধু আমার বাবাকে ফেরত চাই।’ ‘বলপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর অভিযুক্ত কর্মকর্তা এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী খুনিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের’ দাবিতে এই অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করে ‘মায়ের ডাক’। অবস্থান কর্মসূচিতে গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার ও গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এমনই একজন লক্ষ্মীপুরে গুমের শিকার ওমর ফারুকের ছেলে ইমন। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে আমার বাবাকে র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার আট মাস অতিবাহিত করলেও আমাদের স্বজনদের সন্ধান দিতে পারেনি। আমাদের একটাই দাবি, যেসব কর্মকর্তারা গুম-খুনের অপরাধে অভিযুক্ত, তাদের দ্রুত অপসারণ করতে হবে। যদি তাদের চাকরিচ্যুত করা না হয়, তাহলে আমরা নিরাপদ নই, আমাদের পরিবার নিরাপদ নয়। আমরা চাই যেসব কর্মকর্তারা গুম-খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। তাদের বিচার করা হোক। বিচারের সময় এখনই। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনকে। এরপর থেকে আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, গত ১৩ বছর ধরে আমরা রাস্তায় আছি। কিন্তু খুবই বিস্ময় ও আশ্চর্যের ব্যাপার আজকেও আমাদের দাবি আদায়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হচ্ছে। এর থেকে লজ্জার কথা আর কিছু হতে পারে না।