আবদুল লতিফ মাসুম

সমাজ ও রাষ্ট্রের কোনো ঘটনাই হটাৎ করে ঘটে না। এর পূর্বাপর ইতিহাস আছে, পরম্পরা আছে এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবও ছিলো এমন একটি ঘটনা, যার উৎসমূল সমাজের গহীণ-গভীরে প্রথিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতন্ত্রের সংগ্রাম নতুন নয়। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় স্থিত হয়েছি। বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পরও সেই সূত্রে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এদেশে যথার্থ অর্থে রাজনৈতকি উন্নয়ন (Political De-velopment)) ঘটেনি। কিন্তু অতিমাত্রিক রাজনৈতিক সচেতনতা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৫৪ সালে একটি অতি জনপ্রিয় সরকারের কবর রচিত হয়েছে। পাকিস্তানের একমাত্র এবং সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে মনস্তাত্ত্বিক পরাজয় ঘটেছে। তবুও শেষ রক্ষা হতে পারতো যদি জনগণের বিজয়কে অস্বীকার করা না হতো। ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটলো। আশা ছিলো বাংলাদেশের শাসক এলিটরা গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করবে। একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হলো বটে কিন্তু আওয়ামী লীগের চরিত্রে-বৈশিষ্ট্যে গণতন্ত্র না থাকার ফলে অবশেষে বাকশাল কায়েম হলো। সামরিক শাসনের ফলে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক যাত্রা ব্যাহত হলো। আবারও গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষায় ১৯৯০ সালে একটি গণ আন্দোলনে কপট গণতন্ত্রের পতন হয়ে স্বাভাবিক গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন ঘটলো। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রবেশ করলো দেশ। কিন্তু গণতন্ত্রের নির্ভেজাল ও নিরঙ্কুশ চর্চা থেকে বঞ্চিত হলো মানুষ। অবশেষে অনেক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে আবারও যখন ৭১ সালের স্বৈরতন্ত্র ক্ষমতাসীন হলো ২০০৮ সালের শেষে দিকের নির্বাচনে তখন, মূলত স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো গণতন্ত্রের নামে।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিলো দীর্ঘকাল ধরে লালিত জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ। নদীতে বাধ দিলে যেমন এক সময় জলোচ্ছাস ঘটায় ঠিক তেমনি দীর্ঘ আওয়ামী দূঃশাসনের ফলে অনিবার্য গণবিপ্লবটি ঘটলো। জনমনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলছিলেন যে, বারুদের উপর দাড়িয়ে আছে দেশ। একটি দিয়াশলাই এর কাঠিই যথেষ্ট বিস্ফোড়ন ঘটাতে। আসলে তাই ঘটলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা আন্দোলন ছাত্রদের ছিলো বটে, কিন্তু চোখ ছিলো সচেতন নাগরিকদের। রাজনৈতিক দলগুলো নেপথ্যে কাজ করছিলো। যে অসম্ভব রক্তপাতের মধ্য দিয়ে বিপ্লবটি সফলতা পেলো, সেই সাথে গণ আকাক্সক্ষাও হিমালয়সম হয়ে দাড়ালো। মানুষ জানে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূর হাতে আলাদিনের চেরাগ নেই। তিনি ইচ্ছা করলেই এক নিমিষে একটি সতত সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে পারেন না। তবুও মানুষের যাচিত-অযাচিত মিটিংয়ে, মিছিলে আন্দোলন ও সংগ্রামে নিত্যদিন প্রেসক্লাব প্রাঙ্গন হয়েছে প্রকম্পিত। চৌকিদার থেকে দেশের শীর্ষ আমলা পর্যন্ত ধাবিত হয়েছেন আন্দোলন ও দাবি-দাওয়ার সংগ্রামে।

একটি বছর মহাকালের হিসেবে বিন্দু বিসর্গের মতো। সবচেয়ে বড় সংবেদনশীলতা হলো এই সরকারের স্থিতিকাল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো তিন মাসের মান্ডেট নিয়ে আসেনি এই সরকার । সংবিধানের কোনো ধারা মোতাবেক এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তার ফলে এর মেয়াদ, কার্যকাল, কার্যব্যবস্থা এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিলো অনির্ধারিত। ধরে নেয়া যায় এটি ছিলো অবারিত। অবারিত এই অর্থে যে গণ আকাক্সক্ষার একটি সফল পরিণতি কালব্যাপী এর ব্যাপ্তি। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস হয়তো ভেবেছিলেন শেখ হাসিনা আমল পর্যন্ত তিনি সময় পাবেন। এ জাতির একজন পিতৃপূরুষ হিসাবে তার এই ভাবনাটা অমূলক কিন্তু অন্যায় নয়। পৃথিবীর তাবৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মহৎ একনায়কত্ব ((Benevolent Dictatorship) কে উত্তম শাসন ব্যবস্থা বলেছেন। এটি এই কারণে যে একজন উত্তম ব্যক্তি নিঃস্বার্থভাবে, নিরাসক্তভাবে জনগণের কল্যাণ চিন্তায় একান্ত কর্তৃত্বে দ্রুততার সাথে ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শীগ্রই ক্ষমতাবানদের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেন। ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের জন্য অস্থিরতা প্রকাশ করলো। একথা সত্য যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনাদি-অনন্তকাল ধরে ক্ষমতায় থাকার বাসনা প্রকাশ করতে পারে না। তারা ‘ কেয়ামতসে কেয়ামত তাক’ ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখতে পারে না। কিন্তু একটি যৌক্তিক সময় একটি সু-নির্দিষ্ট কর্ম কৌশল নির্ধারণ করে তাদের জন্য নির্ধারিত দ্বায়িত্বটুকু পালনের উদ্যোগের কথা বলতেই পারি। এই সরকারটি যেমন নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেনি, ঠিক তেমনি নির্দিষ্ট এজেন্ডাও তাদের হাতে ছিলো না। গণবিপ্লবের আশা-আকাক্সক্ষা, উদ্ভুত পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং গণ-দাবির প্রেক্ষিতে নির্ণীত হয় তাদের এজেন্ডা। স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পর দূঃশাসনের পরিবর্তে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই ছিলো তাদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। সুশাসনের ক্ষেত্রে এক নম্বর দাবিই ছিলো আইন ও শৃঙ্খলা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই দ্বায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। একদিকে বিপ্লব পরবর্তী উত্তাল পরিস্থিতি, গণধিকৃত পুলিশের পলায়ন, পলায়নপর পুলিশের দৃষ্টতাপূর্ণ তথাকথিত ধর্মঘট এবং দুষ্কৃতকারীদের লুটপাট- সব মিলিয়ে এক বেসামাল অবস্থা সামাল দিতে হিম-শিম খেতে হয় তাদের। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত নিরব সমর্থন, শিক্ষার্থীদের বাস্তব সহযোগীতা এবং অবশিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহৃদয়তা- অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্থিতিশীলতা দান করে। প্রাথমিক অবস্থায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রক্ষা কবচের কাজ করে। সচিবালয়ে আনসার বিদ্রোহ দমনে কিংবা বিচারালয়ের ‘সাংবিধানিক ক্যু’ মোকাবেলায় ছাত্র সমাজ আগুয়ান না হলে অঘটন ঘটার সম্ভাবনা ছিলো। এ সময়ে দেশ জাতি রাষ্ট্র যাদের থেকে সবচেয়ে বেশি নিয়মানুবর্তিতা ও আনুগত্য আশা করে তা হলো আমলাতন্ত্র। অতি উৎসাহী কিছু ব্যক্তি সচিবালয়ে এই সময়ে প্রাধান্য বিস্তার করে। যেমন খুশি তেমন আদেশ নিষেধ করিয়ে নেয়। অবশ্য দেশপ্রেমিক কিছু আমলাদের নিয়োগ ও হস্তক্ষেপে বিরাজমান অরাজকতার অবসান ঘটে। আবার যখন জেলা প্রশাসকদের নিয়োগ ও পদায়ন নিয়ে তালিকা তৈরি হয় তখন ঘুষ, দূর্ণীতি ও দল প্রীতির অভিযোগ ওঠে। বছরখানেক পরেও এটি অপ্রীতিকর সত্য যে পুলিশ ও প্রশাসনে স্বৈরাচারের রেশ আজও কাটেনি। ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে বলে জানা গেছে। কিন্তু ‘ঠকবাজতে তো গা উজার হওয়ার আশঙ্কা’। সবাই তাদের ছিলো, এখন সবাই আমাদের হওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বিশেষ করে নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্ভাব্য বিজয়ী দলের আশীর্বাদপুষ্ট হতে চায় সকলে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাথমিক তিন মাস ভুল ও শুদ্ধির মধ্য দিয়ে স্থুতি লাভ করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা আপামর জনসাধারণের পক্ষ থেকে ক্রমে ক্রমে তিনটি বিষয় অতীব গুরুত্ব অর্জন করে। আর তা হলো- সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। বলতে গেলে গোটা ছাত্র সমাজ কাক্সিক্ষত মৌলিক সংস্কারের পর নির্বাচনের পক্ষপাতী। সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ খানিকটা এগিয়েছে। এখন এটা সেই ছোট গল্পের সংজ্ঞার মতো শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’ ধরণের অবস্থা অতিক্রম করছে। সচেতন নাগরিক সমাজ মনে করে সব বিচার শেষে নির্বাচন হওয়াই কাম্য। বিচার ব্যবস্থার মতো দীর্ঘ সময়ব্যাপী কার্যক্রম এক নিমিষেই শেষ করা যায় না। আগেকার সরকার যেমন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিচারের নামে অবিচার করেছে, ফাসির কাস্টে ঝুলিয়েছে বরেণ্য নেতাদের- এ সরকার ইচ্ছা করলেই তা করতে পারে না। ‘তাহারা অধম হইয়াছে বলিয়া আমরা উত্তম হইবো না কেন?’। একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত হয়েছে। প্রধান আসামী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। সংখ্যা ও কার্যক্রমের বিশাল পরিধি বিধায় বিচার কার্যক্রমটি দীর্ঘায়িত হওয়ারই কথা। সেক্ষেত্রে আশার আলো এই যে প্রতিটি রাজনৈতিক দল স্বৈরাচার এবং তার দোসরদের বিচারের বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আশা করা যায় যে, যে দলই নির্বাচিত হোক- মানুষ ন্যায় বিচার পাবে। আবেগের তাড়ণা বিচারের প্রতিই বেশি। আসল গুরুত্ব সংস্কারে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করে। সরকার বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করে। সব কমিশনগুলো সমায়ান্তরে তাদের সুপারিশ পেশ করে। সব সুপারিশগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে বিবেচণার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এই কমিশনের প্রধান হন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস নিজে। গত ১২ ফেব্রুয়ারী কমিশন গঠনের পর থেকে এরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ধারাবাহিক বৈঠক পরিক্রমায় এখন পর্যন্ত ১২ টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঐকমত্যে পৌছেছে। কমিশন অবশ্য ২০ বিষয় উত্থাপন করে। সকল রাজনৈতিক দলের সাথে পর্যায়ক্রমে আলোচনায় মিলিত হওয়ার পর অনেকগুলো বিষয় একমত হওয়া গেছে। ঐকমত্যে পৌছানোর বিষয়গুলো হচ্ছে বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদের নমনীয়তা, বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যগণ কমপক্ষে ৪ টি সংসদীয় কমিটিতে সভাপতির আসন পাবেন। নির্বাচনী সীমা নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে একটি কমিটি গঠিত হবে। প্রতি বিভাগে হাই কোর্টের বেঞ্চ স্থাপিত হবে। প্রেসিডেন্ট এর ক্ষমা প্রদর্শণের ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণের জন্য আইন প্রণয়ন করা হবে। এটাও স্বীকৃত হয়েছে যে আপিল বিভাগের সর্ব জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের কতিপয় বিষয় সংশোধনে একমত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক কারণে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা যাবে না। জরুরী অবস্থার কারণে মৌলিক অধিকার স্থগিত করা যাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে যেকোনো সংশোধনী সংসদের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থনে হতে হবে। এটি আবার গণভোট দ্বারা সমর্থিত হতে হবে। সংবিধানের ভূমিকা, মৌলিক অধিকার, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা, সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি এবং প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগের ব্যাপারে একই পদ অর্থাৎ দুই তৃতীয়াংশের সমর্থনসহ গণভোটের মাধ্যমে সম্পাদিত হতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলো আরও একমত হয়েছে যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে স্পীকারের নেতৃত্বে। বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত ডেপুটি স্পীকারসহ এতে সদস্য থাকবেন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতাসহ মোট ৫ জন। রাজনৈতিক দলগুলো আরও একমত পোষণ করে যে একজন ব্যক্তি ১০ বছরের বেশী প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না। অবশ্য এতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি পরপর দুবার নাকি সমায়ান্তরে দুবার। তারা একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের ব্যাপারে একমত হন।

যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারেনি অথবা আংশিক একমত হয়েছে তার সংখ্যাও কম নয়। বিশেষ করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি এর মধ্যে রয়েছে। মতানৈক্যের বিষয়াবলীর মধ্যে রয়েছে ক. সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পদ্ধতি। খ. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠন এবং এর নির্বাচন পদ্ধতি। গ. নারী আসন বাড়ানো ও নির্বাচন পদ্ধতি। ঘ. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি। ঙ. রাষ্ট্রের মূলনীতি। চ. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ। ছ. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দ্বায়িত্ব। জ. তত্ত্ববধায়ক সরকারের রূপরেখা। এসব বিরোধীয় বিষয় হলেও রাজনৈতিক দলগুলো এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মধ্যে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আলাপ আলোচনা চলছিলো। আশা করা যায় যে অন্যান্য বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য পোষণ করবে। বেশ কয়েকটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখন পর্যন্ত একমত হওয়া যায়নি। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচন পদ্ধতি। বিএনপি বাদে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব- পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলছে। সংস্কার কমিশন অবশ্য শুধুমাত্র উচ্চ পরিষদে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের প্রস্তাব করেছে। এ ব্যাপারে এখনও বিএনপির সম্মতি পাওয়া যায়নি। পিআর পদ্ধতি মানে হলো সারাদেশে একটি দল যত ভোট পাবে তার অনুপাতে জাতীয় সংসদে আসন পাবে। উচ্চ কক্ষের ক্ষমতা নিয়েও ভিন্নমত আছে। শেষ সময়ে একটি সমাধানের আশা প্রকাশ করছেন ঐকমত্য কমিশন।

জাতীয় ঐকমত্য সংলাপের মাঝে জুলাই জাতীয় সনদের কাজও এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে একটি খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দু বছরের মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে রাজনৈতিক সরকার। জুলাই সনদের আইনগত স্বীকৃতি চায় জামায়াতে ইসলামী। জামায়াত মনে করে যদি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না থাকে তাহলে এসব সিদ্ধান্তের এক পয়সা দাম নেই। জুলাই সনদের আরও আইনি ভিত্তি চায় এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। তবে এটিকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার বিষয়ে একমত নয় বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জনগণের সার্বভৌম এখতিয়ারের ভিত্তিতেই আমরা এই ঘোষণাপত্রকে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করছি। সেটা আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি। এর চেয়ে বড় জাতীয় সম্মতি আর নেই। এটা আইনের ঊর্ধ্বে। এটা জনগণের অভিপ্রায়। এটা সার্বভৌম ব্যাপারের কাছাকাছি হয়ে গেছে।’

আমরা আগেই বলেছি একটি সরকারের সফলতা ব্যর্থতা নিরূপণের জন্য একটি বছর যথেষ্ট নয়। কিন্তু এই সরকার একটি বিশেষ সময়ের, বিশেষ পরিস্থিতির এবং বিশেষ দ্বায়িত্বের। বিচার ও সংস্কারের পর নির্বাচনই হচ্ছে বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। হয়তো আরও একটু সময় পেলে নির্বাচন আরেকটু পরে হলে অনেক বিষয় সুরাহা হতে পারতো। কিন্তু দেশের বিরাজমান অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ইত্যাদি কারণে নির্বাচন এগিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সরকারকে। আশা করা যায় যে আগামী ফেব্রুয়ারী ২০২৬ এ বহুল প্রত্যাশিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রফেসর ইউনুস নির্বাচনটি ‘ঐতিহাসিক’ করতে চান। নির্বাচনকে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, সুশৃঙ্খল এবং গ্রহণযোগ্য করার জন্য নির্বাচন কমিশনও তাদের প্রতিজ্ঞার কথা বলছে। এতো আশাবাদ সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আশা ও আশঙ্কার কথা আছে। সাধারণ মানুষ ভোট দেয়ার জন্য উন্মুখ। তবে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিভাত ফ্যাসিবাদ আশঙ্কার কারণ। এই আশা ও আশঙ্কা অতিক্রম করে বাংলাদেশের জন্য শিগ্রই একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মিত হবে- এই প্রত্যাশা সকল মানুষের।