ড. এম এ সবুর
পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ। বাংলাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। নববর্ষ উদযাপন একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। তবে কবে থেকে নববর্ষ বা বর্ষ গণনা শুরু হয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ রাত দিন গণনা শুরু করেছিল সূর্য উদয়-অস্তের ভিত্তিতে। কিন্তু তারা মাস গণনা শুরু করেছিল চাঁদের ভিত্তিতে। অর্থাৎ মানুষ চাঁদের বৃদ্ধি-হ্রাস দেখে মাস গণনা করতো। তারা এক শুক্লপক্ষ থেকে অন্য শুক্লপক্ষ কিংবা এক কৃষ্ণপক্ষ থেকে অন্য কৃষ্ণপক্ষ পর্যন্ত সময়কে একমাস ধরে মাস গণনা করতো। এভাবে ১২ চান্দ্র মাসে এক বছর গণনা করা হতো। পরবর্তীতে সৌর বছর দিয়ে বর্ষ গণনা করা হয়। তাই বর্ষ গণনার ভিত্তি এক নয়। কেউ গণনা করে চন্দ্রের ভিত্তিতে কেউ আবার সূর্যের ভিত্তিতে। প্রত্যেক জাতি-দেশের বছর গণনা শুরু হয়েছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে। আর বর্ষ গণনার ভিত্তি অনুযায়ী বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। যেমন ইরানের নববর্ষ ‘নওরোজ’ পালিত হয় বসন্তের পূর্ণিমায়। অন্যদিকে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১লা জানুয়ারিতে ঐধঢ়ঢ়ু ঘবি ণবধৎ উদযাপিত হয়। গ্রীস্মের শুরুতে অর্থাৎ ১লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। আর মুহররমের ১লা তারিখে হিজরি নববর্ষ পালিত হয়। সব জাতির বর্ষ গণনা যেমন এক নয় তেমনি সব জাতির নববর্ষের উৎসবও অভিন্ন নয়। প্রত্যেক জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তিতে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে।
বাংলা নববর্ষ সব বয়সের এবং সব শ্রেণীর মানুষ ধুমধামে উদযাপন করে। নববর্ষ উদযাপনের সুবিধার্থে দিনটি সরকারি ছুটি থাকে। দিনটি উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনের জন্য সরকারি বেসরকারি সামাজিক সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। তবে সাম্প্রতিককালের নববর্ষ বা বর্ষবরণ ও আগের দিনের নববর্ষ বা বর্ষবরণের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। বিশ্বায়নের ফলে আধুনিক যুগের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মনোহরি চাকচিক্য বাড়লেও আন্তরিকতার ঘাটতি আছে। বর্তমানে নববর্ষ উদযাপনে পান্তাভাত ও ইলিশ ভাজাসহ মুখরোচক অনেক খাবারের সমারোহ ঘটালেও এতে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না। এতে ধনী ও বিলাসী মানুুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের অন্তরে সুখ আসে না। আধুনিক যুগের শহুরে মানুষদের প্রাণহীন জমকালো বর্ষবরণের কৃত্রিমতায় নিবিড় পল্লীর প্রীতিপূর্ণ ছোট ছোট উৎসব ঢাকা পড়ে যায়। অধিকন্তু শিল্পপতি, বড় চাকরিজীবী ও টাকাওয়ালাদের উৎসবের তান্ডবতায় বাঙালি কৃষকদের নববর্ষ উৎসব পিষ্ট হয়।
বাংলা সনের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। তাই বাংলা নববর্ষ উৎসবের সংস্কৃতিও খুব পুরনো নয়। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে তো নয়ই এমনকি মধ্যযুগেও (১২০৩-১৭৫৭ খ্রি.) বাংলা নববর্ষভিত্তিক কোন সাহিত্য নাই। আধুনিক যুগের প্রথম শতকের (১৮০১-১৯৪৭ খি.) সাহিত্যেও বাংলা নববর্ষভিত্তিক কোন রচনা পাওয়া যায় না। বিশ শতকের প্রথমার্ধেও নববর্ষ বাংলা সাহিত্যে তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে নাই। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা-গানে ‘বৈশাখ’ ‘পুণ্যাহ’ বিষয় থাকলেও বাংলা ‘বর্ষবরণ’ বা নববর্ষ উৎসবের বিষয় নাই। একইভাবে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে পারস্যের ‘নওরোজ’ অনুষ্ঠানের উল্লেখ থাকলেও বাংলা নববর্ষ বা ‘বর্ষবরণ’ উদযাপনের বিষয় নাই। অর্র্থাৎ গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে সাহিত্যে বাংলা ‘নববর্ষ উৎসব’ প্রভাব বিস্তার করতে পারে নাই। অবশ্য তখন যে নববর্ষ বা বর্ষবরণ ছিল না বিষয়টি তেমন না। তবে তৎকালে বর্ষবরণ বা নববর্ষ উদযাপন ছিল অনাড়ম্ভরপূর্ণ ও জৌলুসহীন। ঘরোয়া পরিবেশে পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই নতুন বছরের প্রথম দিনে ভালো খাবার আয়োজন-আপ্যায়ন এবং নতুন পোশাক পরার বর্ষবরণ বা নববর্ষ উদযাপন সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানের মতো এতো জমকালো অনুষ্ঠান তৎকালে ছিল না। মিষ্টান্ন বা মিঠা জাতীয় দ্রব্য দিয়ে ‘মিঠামুখ’ করানো এবং অপেক্ষাকৃত ভালো খাবারের আয়োজন করা হতো ‘বর্ষবরণ’ বা নববর্ষ দিনে। তৎকালীন বাঙালি সমাজে প্রচলিত ধারণা ছিল বছরের শুরুর দিনে ‘মিঠামুখ’ করলে সারা বছর মুখ মিঠা থাকবে এবং এদিন ভালো খাবার খেলে সারা বছর অনুরূপভাবে ভালো খাবার খাওয়া যাবে। কুসংস্কার হলেও বাঙালিরা এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে ‘নববর্ষ’ দিনে অপেক্ষাকৃত ভালো খাবারের আয়োজন ও ভালো পোশাক পরিধান করতো। কালের পরিক্রমায় বছরের প্রথম দিনে ভালো খাবারের আয়োজন-আপ্যায়ন, নতুন পোশাক পরা, হিন্দুদের পূজা-অর্চনা, মুসলমানদের মিলাদ-মাহফিল-দোয়া অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ ‘বর্ষবরণ’ উদযাপনের উৎপত্তি ঘটে।
বাংলা সনের সূচনা মুসলমানদের হাতে। মুসলিম ঐতিহ্যের হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে। মুঘল সম্রাট আকবর বাংলার কৃষকদের সুুুবিধার্থে হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। বাংলা নববর্ষের যাত্রা খুব বেশি দিন আগের নয়। চলতি নববর্ষে বাংলা সন ১৪৩২তম বছরে পদার্পণ করলেও মূলত এর যাত্রা শুরু হয়েছে মাত্র ৪৬৯ বছর আগে মুঘল শাসনামলে। মুঘল সম্রাট আকবর তার সিংহাসনে আরোহণের বছরকে স্মরণীয় করতে সভাজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর (দৈবে দশমরত্ন) পরামর্শে হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরে বাংলা সন গণনার নির্দেশ দেন। অধিকন্তু পারস্যের (ইরানের) নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান ‘নওরোজ’ এর আদলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূচনাও করেন। তার আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হতো। ‘নওরোজ’ অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ‘মিনা বাজার’। আর এ মিনা বাজারের আদলে বাংলা নববর্ষ উৎসবে যোগ হয়েছে ‘বৈশাখী মেলার’। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামে গঞ্জে বৈশাখী মেলা বসে। কৃষিজ পণ্য, কুঠির শিল্পদ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্প দ্রব্য প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খেলনা ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ে যায় মেলায়। আগের দিনে মেলায় প্রদর্শনী হতো ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, লাঠি খেলা, বলী খেলা ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠান। বৈশাখী মেলায় আগের দিনে লাঙ্গল, জোয়াল, মইসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামাদি, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় মাটির হাঁড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঘুড়ি, মাটির তৈরি হাতি-ঘোড়া ইত্যাদি বেচা-কেনা হতো। মেয়েদের হাতের চুড়ি, কানের দুল, গলার হার ইত্যাদি দ্রব্যও বেচা-কেনা হতো বৈশাখী মেলায়। এছাড়া জুড়ি-বুন্দি, জিলাপি, রসগোল্লা ইত্যাদি মুখরোচক খাবারের সমারোহতো ছিলই।
প্রকৃতপক্ষে বাংলা নববর্ষ উৎসবের মূলে আছে মুসলিম ঐতিহ্য। উৎপত্তিগত দিক দিয়ে বাংলা সনের সাথে যেমন মুসলিম ঐতিহ্য জড়িত তেমনি নববর্ষ উৎসবের সাথেও পারসিয়ান মুসলিম সংস্কৃতি জড়িত। মুসলিম ঐতিহ্যের ভিত্তিতে বাংলা নববর্ষ চালু হলেও মুসলমানদের উদারতার কারণে তা সার্বজনীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। কিন্তু বাঙালি মুসলিম সমাজের অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা, সংস্কৃতিবিমুখতার কারণে মুসলিম ঐতিহ্যমণ্ডিত বাংলা নববর্ষ উৎসব বিজাতীয় সংস্কৃতিতে ঢাকা পড়েছে। ইসলাম বিদ্বেষীরা অশালীন-অপসংস্কৃতিকে বাংলা নববর্ষ উৎসবে যোগ করেছে। দেশজ সংস্কৃতির বাতাবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা, কপালে তিলক-সিঁদুর পরা, উলুধ্বনি দেয়া ইত্যাদি ভিনজাতীয় সংস্কৃতি যোগ হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। অধিকন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের ফলে আমাদের দেশের এলিট শ্রেণী খ্যাত কিছু অর্ধবাঙালি হোটেল-পার্কে জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেন Happy New Year এর আদলে। যা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে দুর্বল ও অপদস্ত করছে। তাই নববর্ষ উদযাপনকে বিশ্বায়নের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করতে নতুন প্রজন্মকে শেকড়সন্ধানী হতে হবে। আর আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। তাহলেই বাংলা নববর্ষ উদযাপন সার্থক হবে।
লেখক: আহ্বায়ক, ডক্টরস এসোসিয়েশন
অব নন-গবর্ণমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গট)