ড. আবদুল আলীম তালুকদার

পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটিকে আমরা নববর্ষ হিসেবে পালন করে থাকি। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হল নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় প্রতি বছর উদ্যাপিত হয় নববর্ষ।

ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীনকাল থেকেই বর্ষ গণনায় প্রধানত দুটি পদ্ধতি চালু আছে। সূর্যের হিসেবে যে সাল গণনা করা হয় তাকে সৌর সাল বলে। সৌর সালের মাসগুলোর ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে। হিজরী সন চান্দ্র সাল হওয়ায় এর মাসগুলো ঋতুর সাথে সম্পর্কিত নয়। তাই ভিন্ন ভিন্ন বছরে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর সংস্পর্শে আসে হিজরী নববর্ষ। মানব সভ্যতার উন্মেষকাল থেকেই সময়, দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, বছর প্রভৃতি হিসাব নির্ণয় করার মননও সঞ্চারিত হয় এবং সেই মনন থেকে সূর্য পরিক্রমের হিসাবেরও যেমন উদ্ভব ঘটে, তেমনি চন্দ্র পরিক্রমেরও উদ্ভব ঘটে। সূর্য পরিক্রমের হিসাবে যে বছর গণনার পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে তা সৌর সন নামে পরিচিত হয় আর চন্দ্রের পরিক্রমের হিসাবে উদ্ভাবিত সাল চান্দ্র সন নামে পরিচিত হয়।

এ উপমহাদেশে মুসলিম শাসকগণ সর্বপ্রথম হিজরি সনের সাথে মিল রেখে প্রচলিত বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বঙ্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ৬০০ হিজরি মোতাবেক ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে। তখন থেকে শুরু করে উপমহাদেশে মুঘল সম্রাট জালালুদ্দীন মুহাম্মদ আকবরের রাজত্বকালেও চান্দ্রবর্ষ ভিত্তিক হিজরি সন প্রচলিত ছিল; সরকারি কাজেও হিজরি সন ব্যবহার করা হতো। চান্দ্র মাসের গণনায় হিজরি সনের প্রচলনের ফলে এ সনের বছরের দিনসংখ্যা কম অর্থাৎ চান্দ্র সনের বছর ধরা হয় ৩৫৪ দিনে। অন্যদিকে, সৌর সনের বছর ৩৬৫ দিনে হওয়ায় প্রতি বছর চান্দ্র সনের সাথে ১০/১১ দিন কম। এর ফলে বছরে দিনক্ষণ ও তিথি নক্ষত্র, লগ্নভিত্তিক উৎসব, আচার-আচরণ, উৎসব-অনুষ্ঠানে দারুণ অসুবিধা দেখা দেয়। এছাড়াও চান্দ্রবর্ষের হিসেবে একই মৌসুমে একই মাস বিদ্যমান থাকে না বিধায় উপমহাদেশে রাজকোষের খাজনা আদায়ের ব্যাপারে অসুবিধায় পড়তে হয়। সাধারণত কৃষকেরা প্রধান ফসল যখন ঘরে তোলেন তখন খাজনা আদায় সুবিধাজনক। কেননা, ফসল মৌসুম ঋতুভিত্তিক আর হিজরি সন চান্দ্রভিত্তিক। কিন্তু চান্দ্রবর্ষে মাস এগিয়ে যায় বলে খাজনা আদায়কারীরা এবং প্রজারা উভয়ই অসুবিধার সম্মুখীন হন। এ সকল অসুবিধার কথা মুঘল সম্রাট আকবরের দরবারে নবরত্ন ও অন্যান্য সভাসদদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। সভাসদদের আলোচনার ভিত্তিতে মুঘল সম্রাট আকবর সৌর মাসভিত্তিক বর্ষ গণনার কথা চিন্তা করেন। তার রাজত্বের ২৯ বছর পূর্তিতে তিনি তার দরবারের অন্যতম পণ্ডিত জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদ আমীর ফতেহ্ উল্লাহ্ সিরাজীকে হিজরী সনের সাথে সমন্বয় করে সৌর বর্ষভিত্তিক ‘ফসলি সন’ প্রবর্তনের নির্দেশ দেন। তিনি সম্রাটের নির্দেশ মোতাবেক সৌর মাসভিত্তিক একটি নতুন সনের উদ্ভাবন করেন; এটি মৌসুমভিত্তিক সৌর সন। এর নাম দেয়া হয় ‘ফসলি সন’। সম্রাট আকবর ৯৯৩ হিজরি সন মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ মতান্তরে ১১ মার্চ ‘ফসলি সন’ এর ফরমান জারি করেন। পরবর্তীকালে এ ফসলি সনই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিতি লাভ করে।

বাঙালির ঐতিহ্যের শেকড়ে প্রোথিত বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলা নববর্ষই আমাদের বাংলার প্রকৃতি যেমন বৈশাখী বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে তেমনি এদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নববর্ষের আগমনের জন্য অপেক্ষা করে। জানা যায় আগেকার দিনে যখন জমিদারি প্রথা চালু ছিল তখন পূণ্যাহ্ নামের একটি অনুষ্ঠান হতো নববর্ষের দিনে। জমিদার বাড়িকে কেন্দ্র করে ‘পূণ্যাহ্’ অনুষ্ঠান করতো, প্রজারা এসে সে অনুষ্ঠান দেখার জন্য জড়ো হতো। পুরাতন বছরের খাজনা পরিশোধের দিন ছিল এটা। জমিদারের পক্ষ থেকে এদিন প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানো হতো। রাতে বসতো যাত্রাপালা, জারি-সারি বা কবিগানের আসর। ঠিক একই ধরণের অনুষ্ঠান হয় ব্যবসায়ী মহলে হালখাতা অনুষ্ঠান নামে। হালখাতা উৎসব নববর্ষের একটি বিশেষ দিক। এটি গ্রামের পাশাপাশি শহরেও পালিত হয়। ব্যবসায়ীরা এই দিনে পুরাতন বছরের হিসাব চুকিয়ে ব্যবসায়ের জন্য নতুন হিসাবের খাতা খোলেন। এ উপলক্ষে নববর্ষের দিন প্রচুর মিষ্টি খাওয়ার উৎসব চলে। ঘরে ঘরে দোকানে দোকানে ক্রেতা-বিক্রেতা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হয়। ক্রেতা বা খদ্দেরকে মিষ্টিমুখ করিয়ে গত বছরের বকেয়া আদায় করা হয় এই দিনে।

বাংলা নববর্ষ বহুমাত্রিকতায় পরিপূর্ণ। আমাদের প্রকৃতি ও সমাজ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, আমাদের জীবনাচার সবকিছুর সঙ্গেই নববর্ষের এক অন্তরঙ্গ যোগ। আগে নববর্ষের উৎসব-অনুষ্ঠান পল্লীকেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু এখন তা শহরে ব্যাপ্ত হয়ে জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। নববর্ষকে উপলক্ষ করে চৈত্রের শেষে ও বৈশাখের প্রথম কয়েকদিন গ্রাম বাংলার বিভিন্ন স্থানে বসে বৈশাখী মেলা। পহেলা বৈশাখের পরিপূর্ণ রূপ প্রকাশিত হয় এই মেলায়। বর্তমানে বৈশাখী মেলাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সর্বজনীন মিলনোৎসব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের এক মহামিলন ক্ষেত্র এই লোকজ মেলা।

একথা সর্বজনবিদিত যে, আমাদের জীবনেতিহাসের সার্বিক পটভূমিতে অর্থাৎ আমাদের জাতীয় চেতনা তথা বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির অস্থিমজ্জার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বাংলা নববর্ষের মাহাত্ম। নতুনের ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে উঠে বাঙালির ক্লান্ত-শ্রান্ত জীবন। প্রতি বছর এ দিনটি আমাদের সামনে হাজির হয় নতুনের বার্তা-আশার আলো নিয়ে।

বাংলা নববর্ষ শুধু আমাদের বর্ষসূচনার দিন নয়; নববর্ষ আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে জাগ্রত করে, বর্তমানের মূল্যায়ন ঘটায়, জাতির আগামী দিনের রূপরেখাটির দিক নির্দেশনা দেয়। তাই বাংলা নববর্ষ আমাদের গৌরব, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ। নববর্ষ উপলক্ষে সর্বজনীন উৎসবের মধ্য দিয়ে সারাদেশের এক অবিভাজ্য সাংস্কৃতিকরূপ ফুটে ওঠে। বিভিন্ন আনন্দ-আয়োজনের মধ্য দিয়ে গোটা দেশটা যেন হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। এই দিনে মানুষ অতীতের সমস্ত দুঃখ-বেদনা ভুলে নতুনের আহ্বানে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বাঙালি এই দিনে নিজেকে আবিষ্কার করে এক নতুন আঙ্গিকে। পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে সে জীবনের নতুন হালখাতার প্রবর্তন করে, অনাগত দিনের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও একটি ঐতিহ্যবাহী শালীন উৎসবকে সুকৌশলে বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রাস করে ফেলে এদেশীয় কিছু ধর্মবিদ্বেষী তথাকথিত প্রগতিশীল ভিন দেশীয় এজেন্টদের পৃষ্ঠপোষকতায়। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ১৯৮৯ সালে এই উৎসবকে কলঙ্কিত করে বিজাতীয় কালচার ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নামে বেহায়াপনার অপসংস্কৃতি সহজ-সরল ধর্মপরায়ণ বাংলাদেশী জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। সেখানে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিষয় গত ২৫-৩০ বছরে একটু একটু করে প্রবেশ করানো হয়েছে। সকল ভালো-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গলের মালিক মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে বাদ দিয়ে বাঘ, হাতি, ঘোড়া, কুমির, ময়ূর, পেঁচাসহ বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তিকে তারা মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল- যা এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের জন্য একটি কালিমাময় অধ্যায় এবং আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ বা চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয় ভিন দেশের এদেশীয় রাজনৈতিক দালালদের আদর্শ ও নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর কাজটিও এই তথাকথিত ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নামে পালন করে আসছে ঐ গোষ্ঠী।

‘মঙ্গল’ শব্দটি বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে ভারতীয় আধিপত্যবাদ। দেবীর সন্তুষ্টির জন্য মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্য লেখা হতো। মঙ্গলের জড়িয়ে রয়েছে মন্দির কালচার। যদিও বহুকাল আগে থেকেই বাংলা নববর্ষ শালীনতা ও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ করে পালিত হয়ে আসছে। এটি নতুন উদ্ভাবিত কোনো ঘটনা নয়। অথচ আমাদের দেশের কিছু আত্মবিনাশী, আত্মধ্বংসী বা দেশবিরোধী তথাকথিত বুদ্ধিজীবি আমাদের তরুণদের মোহগ্রস্ত করার জন্য এই উৎসবকে ব্যবহার করে।

পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। এদিন আমরা আমাদের মধ্যকার সকল হিংসা-হানাহানি, বিভেদ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, পরশ্রীকাতরতা, পরস্পরের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ দূর করে সবাই মিলে একটি বৈষম্যহীন ও ইনসাফভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। মহান আল্লাহ আমাদের এ কাজে সহায় হোন। শুভ নববর্ষ- ১৪৩২ বঙ্গাব্দ।

লেখক: কবি, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক