প্রত্যয়

আবদুল হাই শিকদার

হয়তো তোমার বাগানে ফুটেনি প্রত্যাশা মতো ফুল

হয়তো ফ্যাসিস্ট শাসকের ভয়ে নড়নিকো একচুল

হয়তো তোমার জীবন খাতার প্রতি পাতা ভরা ভুল

হয়তো পুঁজির দেখানো পথেই ছিলে তুমি মশগুল।

হয়তো হয়েছো ব্যাকরণবিদ পড়েনিকো বই মূল

হয়তো বৃথাই কেটেছো সাঁতার পাও নাই খুঁজে কূল

হয়তো ধ্যানের ধান্য তালাশে বাঁধানো হুলুস্থূল

হয়তো কর্ণে ঝুলিয়ে ভেবেছো এটাই সোনার দুল।

হয়তো তোমার চারপাশ ছিল ভয়াবহ প্রতিকূল

হয়তো তোমার মৃত্তিকা থেকে হয়ে গেছো উন্মুল

হয়তো তোমার আশাহীনতার পথে পথে পোঁতা শূল

হয়তো তোমার অবয়বে মাখা দিশাহীন কালিঝুল।

হয়তো আগুনে ঝলসে গিয়েছে তোমার চৈত্র-ফাগুন

তবুও প্রকৃতি আপন নিয়মে জাগাবেই নবারুণ

দৃঢ় পদক্ষেপ দ্বিধাহীন মন খুব দরকার আজ

পত্রবিহীন বৃক্ষের ব্যথা আনবেই ঋতুরাজ।

তিরিশ বছর পর

রহমাতুল্লাহ খন্দকার

তিরিশ বছর আগে হয়ে ছিল দেখা তার

গোপাল বাবুর মতো সে চিরকুমার থেকে গেল হৃদয় বাহার।

হাঁটুজল খাল বেয়ে ওপারে তাদের ঘর

ধুলোয় পথের বুকে এঁকে দিয়ে পদচিহ্ন যায়

দূর গ্রাম গঞ্জ পুর

লাঙল ফলার দাগে হয়ে ওঠে জমিন উশর।

আজ সেই খাল নেই, মেঠোপথ ঢেকে গেছে কালো পিচ গলে

তবু কলকল জল, লাল হয় শিমুলের ঢাল, রঙধনু

রঙিন সকাল।

কত নদী মরে গেছে, জেগেছে নতুন চর

হুইসেল দিয়ে যায় রেলগাড়ি গড়গড়

যমুনায় এপার ওপার।

তিরিশ বছর পর

আবার সে মেঠোপথে দেখা হবে কি তাহার?

ইটচাপা হলুদ ঘাসেরা

আকিব শিকদার

বাঁশবনে গুই সাপের হাঁ-করা মুখ দেখে অকস্মাৎ

  • যারা দেয় আপ্রাণ দৌড়

আমি তাদের শঙ্কাচ্ছন্নতায় মুচকি হাসি। সন্ধ্যার অশ্বত্থ শাখে

নাকী সুর শুনে জুতো খুলে ছুঁড়েছিলাম ঢিল

  • শাঁখচুন্নিদের- সেই সুবাদে খোয়া গেছে

বাঁ পায়ের একপাটি নাগড়া চটি। যাক, দুঃখ নেই তাতে।

একটা সময় ছিলÑ-

গোরস্তানের মাঠে ঝুঁকে থাকা তালগাছটায়

  • পারিনি চড়তে কিছুতেই
  • অথচ এখন তরতর উঠে যাই

দেবদারুর চূড়ায় তোয়াক্কা না করে বিষপিঁপড়ের কামড়। সময়

মানুষকে করতে শেখায় সব।

  • আকাশে উড়ছে শকুন

বাতাস দ্বিখণ্ডকর চিৎকারে। ওরা মৃত্যু ভালবাসে

এবং চায় ভেজাতে চঞ্চু জীবন্তের রক্তে। আমাদের চৌদিকে

গাঢ় আগুনের আঁচ, বরফে মশাল

  • জ্বলছে ভীষণ দাউ দাউ।

আমার কণ্ঠে তাই বজ্রপাতের মতো

তুমুল হুংকার, হাতের পতাকা যেন জ্বলে ওঠা বাতিস্তম্ভ।

আমাদের মুমূর্ষু মানুষগুলো

জলে ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ আঁকড়ে ধরে তৃণ উঠে বসবেই

একদিন, আর আমি বলে রাখিÑইট চাপা হলুদ ঘাসেরা

  • ইট ঠেলে নিশ্চিত মাথা তুলবেই আকাশে।

একটি নতুন বাংলাদেশ

জাকির আবু জাফর

কবে থামবে আমাদের বুকের ঝড়, কবে!

একেকটি বুক একেকটি জ্বলন্ত বৈশাখ

মেঘের বুক থেকে স্বাধীন বৃষ্টি নামলেই কেবল শীতল হবে হৃদয়গুল!

কেমন নিরাপদ আমাদের আগামীকাল

যেখানে খুবলে খেতে চায় আমাদের মানচিত্র

ফ্যাসিবাদের শেষ অধ্যায় শেষ না হলে

স্বাধীনতা কী করে স্বাধীন হবে!

রক্তের পর রক্ত, শহীদের পর শহীদ,

জীবন বাজি রেখে হাত পা চোখ উপহার দিতে কুণ্ঠিত নয় যারা,

তাদের মন কি বৈশাখ নয়!

তাদের আবেগ হতে পারে ঝড়ের কম্পন

তাদের স্লোগান হতে পারে বজ্রনিনাদ

তাদের শব্দ হতে পারে বৈশাখী বৃষ্টির বয়ন

একটি বিপ্লবের ফুঁ থেকে জন্মায় যদি নতুন স্বপ্নের দিন,

তবে কেনো বিপ্লবী বৈশাখ লিখবে না নব ইতিহাস!

মানুষের মুখ দেখে মানচিত্রের সুখদুখ অনুমান করা যায়!

বোঝা যায় স্বাধীনতার স্বাস্থ্য কেমন!

বোঝা যায় অধিকারের শেষ পাণ্ডুলিপির সেলাইটি কতটা মজবুত

দিব্যি অনুমিত হয় সমাজের সুদিন দুর্দিন

বৈশাখের বুকে স্বপ্নের নদীগুলো ঢেউ তুললেই

ফিরে আসে নাগরিক যৌবন

একটি নতুন স্বপ্নের দিকে খুলতেই হবে হৃদয়

যা ভাঙতে ভাঙতে জোড়া দেবে বারবার

পড়তে পড়তে দাঁড়িয়ে যাবে ফের

ভুলতে ভুলতেই কণ্ঠস্ত হবে রোজকার নীতি

শেকড় থেকেই রচিত হবে শেখরের গল্প!

তারপর পৃথিবীর চোখে বিস্ময়ে ফুটে উঠবে

একটি নতুন বাংলাদেশ!

আলো ভাঙার গান

সাজু কবীর

সময় এখন চৈতালি দুপুরে

উষ্ণতার ঘামে ভেজা জবজবে কম্বল

স্বপ্নগুলো রাত কাটাবার হিরণ্ময় শীত খোঁজে।

কণ্ঠনালীতে নিদারুণ যন্ত্রণা--তীব্র পিপাসা

আহা! মন আমার মিঠেপানিতে সংসার পাতে;

অথচ, আকণ্ঠ আমি নোনাসাগরে ডুবে আছি।

সৌভাগ্যগুলো বাঁশথোপের মতো দাঁড়িয়ে আছে

জোছনা যেন অসিত নিশুতির জুনিপোকা

পরপর জ্বলা-নেভা আলো ধরবো বলে

আমিও অবোধ বালকের মতো ছুটি;

বেসুরো সময়ের কণ্ঠে বেজে ওঠে তখন

আলো ভাঙার গান ।

সভ্যতা

হৃদয় পান্ডে

এই মাটিতেই পুতে রাখা হয়েছিল মৃত্যু,

শস্যের বদলে ফলেছিল লোহা,

ফসলের বদলে জন্মেছিল আগুন,

আর বাতাস বয়ে এনেছিল বারুদের ঘ্রাণ।

সন্ধ্যাবেলা লাল আকাশের নিচে,

কেউ একজন খুঁজে ফেরে হারানো পা,

কেউ ছুঁয়ে দেখে পোড়া দেয়াল,

যেখানে একদিন ছিল ঘর, ছিল স্বপ্ন।

মাটির গায়ে আঁচড় কেটে গেছে বিস্ফোরণ,

প্রতিটি ধূলিকণায় গুমরে মরে অতীত,

যে শিশুদের খেলার কথা ছিল,

তারা আজ খবরের পাতায় কেবল সংখ্যা।

মৃত্যুর কবরের উপর এভাবেই গড়ে ওঠে সভ্যতা।

নিয়তি

হাফিজুর রহমান

যা না বললেই নয়

বলা হয় না তবুও -

ইচ্ছে হলেও চেপে রাখা,

সবাইকে সবকথা

বলা কি যায় সবসময়?

জমতে থাকা কিছু কষ্ট

নষ্টের সাধ্য নেই,

লালন করে বুকে -

ভুগতে হয় কঠিন যন্ত্রণায়।

সত্যের - সত্যিটা-ও

কখনও কখনও বলার নয়!

জীবনের প্রয়েজনে -

মেনে নিতে হয়, পরাজয়।

চাষবাসের গল্প

মেজু আহমেদ খান

জীবনকে কভূ রঙিন দেখিনি

চেষ্টা করিনি দেখার,

সাদা কালো নয়, রঙিন জীবনেই

পেয়েছি বেশিটা শেখার।

জীবন তো ভাই খণ্ডকালীন

চাষবাসের এক গল্প,

জীবিতেরা শ্রেফ নায়ক-নায়িকা

যাপনটা রুপকল্প।

অনেকে এখানে শস্য ফলান

বেশিরা ফলান ঘাস,

কারো জমিটা উর্বর বেশি

কারোটা সর্বনাশ।

জীবন যেখানে যেমনি যাপুন

মেয়াদ হইলে পার,

নিতে হবে গলে আপনি বুঝিয়া

প্রাপ্তির অলংকার।

মানুষ আর শকুন

মোহাম্মদ ইসমাইল

পৃথিবীর গায়ের উপর এখন শাদা কফিন

মোড়ানো একটি লাশের চাদর!

এ-ই ব্যাপারটা ভাবতে গেলে আসলে কতনা ভয়ঙ্কর;

তবু এ পৃথিবীর মানুষের কাছে যেন তার

এতটুকু কোনো ভাবলেশ নেই;

এতটুকুন কোন আফসোস নেই;

যুদ্ধমুখর মানুষ আর শকুন এখন...

মৃত মানুষের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে

হেঁটে চলছে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যের সেই কুরুক্ষেত্রে!

নির্বাসিত দুটি চক্ষু

আবির হাসান

নির্বাসিত দুটি চক্ষু রাত্রি যাপন করেছে

দুশ্চিন্তার ঘরে—

জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছটা আছড়ে পড়ছে মুখে

তাই শীতার্ত ব্যক্তির মতো হতাশার চাদর

মুড়িয়ে বসে আছে জীবন!

এই বৃত্তময় আঁধার ছেড়ে পালানোর দরজা নেই—

তপ্ত দুপুরের ক্ষুধা শুষে নিচ্ছে দেহের যৈবিকতা

আর অস্যৈ ছলনায় ভেতরের অস্থিগুলোর

মরমর ধ্বনিতে ছটফট করছি আমি!

অসহায় দুটি চক্ষু ছাড়া আমার আর কোনো

অস্তিত্ব নেই—

বেদনার রক্তাশ্রু খেয়ে কোনোরকম বেঁচে আছি!