ড. বি এম শহীদুল ইসলাম
মুসলিম উম্মাহর জন্য দুটি উৎসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে-ঈদুল ফিতর এবং অন্যটি ঈদুল আযহা। ঈদুল ফিতর রোজার সাথে সম্পৃক্ত এবং ঈদুল আযহা কুরবানির সাথে সম্পৃক্ত। আযহা শব্দের অর্থ ত্যাগ বা উৎসর্গ। আর ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ বা উৎসব। সেই দিক বিবেচনায় ঈদুল আযহা শব্দের অর্থ ত্যাগের বা উৎসর্গের উৎসব। আযহা শব্দটি ‘উজহিয়াহ’ থেকে এসেছে। ‘উজহিয়াহ’ শব্দটি ব্যবহার করে সেই পশুকে বোঝানো হয়- যা ঈদুল আযহা বা কুরবানির দিন মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে জবাই করা হয়। অন্যদিকে ‘কুরবুন’ শব্দ থেকে ‘কুরবান’ শব্দের উৎপত্তি। কুরবান অর্থ হচ্ছে- উৎসর্গ করা, নৈকট্য লাভ করা, সান্নিধ্য অর্জন করা ইত্যাদি। এটি আরবি শব্দ। এ শব্দটির ব্যবহার পবিত্র কুরআনে রয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আদমের (আ) দুই সন্তান হাবিল ও কাবিল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কুরবানি করেন। তাদের একজনের কুরবানি কবুল হয়েছিল এবং অপর জনের কুরবানি আল্লাহর নিকট কবুল হয়নি। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন;- ‘আপনি তাদের- আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শুনিয়ে দিন। যখন তারা উভয়েই কুরবানি করেছিলেন। তখন তাদের একজনের কুরবানি গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের কুরবানি গৃহীত হয়নি।’-[সুরা মায়েদা, আয়াত:২৭]। আল্লাহ এখানে ‘কুরবান’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু উর্দু ও ফার্সি ভাষায় ‘কুরবানি’ শব্দের ব্যবহার হয়।
কুরবানির আরেকটি আরবি শব্দ হচ্ছে ‘নুসুক’। নুসুক অর্থ ত্যাগ করা, উৎসর্গ করা, বিসর্জন দেয়া ইত্যাদি। যাকে স্যাক্রিফাইস বলা হয়। মূলত এসব শব্দের আসল থিম হচ্ছে- ভোগের বিপরীত ত্যাগ করা বা উৎসর্গ করা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন;- “ক্বুল ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়াইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বি আলামিন”। অর্থাৎ ‘আপনি বলুন; নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু একমাত্র আল্লাহরই জন্য।’ [সুরা আনআম, আয়াত: ১৬২] কুরবানির আরেকটি আরবি পরিভাষা হচ্ছে- নাহার। ‘নাহার’ অর্থও উৎসর্গ করা, ত্যাগ করা বিসর্জন দেয়া-যা নুসুক শব্দের অনুরূপ অর্থ বহন করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন; ফা-সল্লিলি রাব্বিকা ওয়ানহার। অর্থ হচ্ছে-’অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কুরবানি করুন।’ [সুরা কাওসার, আয়াত:২]। এখানে নাহার বলতে উৎসর্গ করাকে বুঝানো হয়েছে। এ কারণেই কুরবানির বা ঈদুল আযহার দিনকে ‘ইয়াওমুন নাহার’ বলা হয়। তবে উজহিয়াহ কুরবানি, নুসুক, নাহার- যে নামেই ডাকা হোক না কেন সবগুলোর অর্থ ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। সেটা হলো- ত্যাগ, বিসর্জন ও উৎসর্গের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি, সান্নিধ্য অর্জন ও নৈকট্য লাভ। কুরবানির ত্যাগ ও উৎসর্গ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
কুরবানির তাৎপর্য ও ঘটনা: সারা জাহানর প্রতিপালক মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের সবচেয়ে প্রিয়। সাধারণত সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য আমরা আমাদের প্রিয় জিনিসটি উৎসর্গ করে আনন্দ অনুভব করি। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের সবচেয়ে প্রিয়-বিধায় বান্দা হিসেবে আমাদের তাঁর জন্য সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি উৎসর্গ করতে হয়। সেটা করতে আমরা কতটুকু প্রস্তুত, সেই পরীক্ষাই মহান রব তার প্রিয় বান্দা ও নবী ইবরাহিম (আ.) মাধ্যমে নিতে চেয়েছেন। আল্লাহ তাকে স্বপ্নে আদেশ করেছেন বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া এবং তরুণ বয়সে উপনীত হওয়া সন্তান ইসমাইলকে (আ.) জবাই করার জন্য। একই স্বপ্ন ইবরাহিম (আ.) তিন দিন দেখার পর প্রিয় সন্তান ইসমাইলকে বলেন; হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার মত কি? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ [সুরা সফফাত, আয়াত: ১০২]।
এখানে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- দুই নবী যারা পিতা-পুত্রও বটে, তারা একজন আরেকজনকে জবাই করার কথোপকথন করছেন। পিতা বলছেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে জবাই করছি। জবাবে জবাইয়ের শিকার হতে যাওয়া পুত্র বলছেন, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। নবী-রাসুলদের স্বপ্নও ওহি এবং আল্লাহর আদেশ পালন করা জীবনের চেয়েও বেশি দামি। পিতা-পুত্র দুই নবী সেটিই প্রমাণ করেছেন।
যুগে যুগে প্রত্যেক জাতির জন্যই কুরবানির বিধান ছিল। আল্লাহ বলেন;- ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির বিধান করে দিয়েছি। তিনি জীবনোপকরণের জন্য যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ [সুরা হজ, আয়াত:৩৪]। কিন্তু বর্তমানে যে কুরবানি প্রচলিত, সেটা শুরু হয়েছে ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইলের (আ.) মাধ্যমে। আমাদের সৌভাগ্য যে, আল্লাহ ঘোষণা দিয়ে পরীক্ষা নিয়েছেন এবং দুজন মহান পয়গম্বর সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে আমাদের জন্য ত্যাগ ও উৎসর্গের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যা মুসলিম জাতির জন্য গৌরবেরও বটে।
কুরবানির উদ্দেশ্য: কুরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাকওয়া অর্জন। কারণ উপহার, ত্যাগ স্বীকার ও উৎসর্গ যার জন্য করা হয়, তিনিই সেটা ভোগ করার অধিকার রাখেন। কিন্তু কুরবানি এবং আল্লাহর নামে অন্যান্য উৎসর্গের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন ধরনের। এখানে যার জন্য উৎসর্গ করা হয়, তিনি স্পর্শও করে দেখেন না, বরং কুরবানিদাতা নিজেই তা ভক্ষণ করেন এবং আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করেন। সেটাও আল্লাহর নির্দেশেই হয়ে থাকে। তিনি বলেন; ‘এবং কাবার নামে উৎসর্গ করা উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় তাদের জবাই করার সময় তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। অতঃপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায়, তখন তা থেকে তোমরা আহার কর। এমনিভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি- যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তার কাছে পৌঁছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন। যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এ কারণে যে, তিনি তোমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎ কর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন। [ সুরা হজ, আয়াত: ৩৬-৩৭]।
কুরবানি কবুলের শর্ত: কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য তাকওয়া বা অন্তরের সুপ্ত বাসনাই হচ্ছে আসল। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন; “তার কাছে রক্ত-মাংস পৌঁছায় না। কিন্তু তার কাছে পৌঁছায় মনের তাকওয়া”। মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন ‘তাকওয়া এখানে’ তিনবার বলার পর কলবের দিকে ইশারা করেছেন। তাকওয়া অর্জনের জন্য পরিপূর্ণভাবে খাঁটি মনে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য হতে হবে কুরবানি। কুরবানী না করলে ‘মানুষ কি বলবে’, ‘আমার সন্তানরা কার দরজায় যাবে’-এমন চিন্তা যদি কুরবানির উদ্দেশ্য হয়, তাহলে গোশত খাওয়াই হবে কুরবানির মূল উদ্দেশ্য। এতে তাকওয়া অর্জন হবে না। আর যদি আল্লার সন্তুষ্টিই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তাহলে আপনার-আমার কুরবানির গোশত অন্য কোথাও যাবে না। বর্তমানে অনুষ্ঠানিকতা ও লৌকিকতা আমাদের ওপর প্রকান্ডভাবে চেপে বসেছে। অথচ ইসলাম আনুষ্ঠানিকতা ও অনুষ্ঠানসর্বস্ব কোনো জীবনবিধান নয়। ইসলামের প্রতিটি ইবাদত-বন্দেগি হতে হবে অহংকারমুক্ত ও রিয়ামুক্ত। লৌকিকতা ও লোক দেখানো ইবাদত-বন্দেগিকে এতো বেশি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, রিয়া তথা লোক দেখানো কর্মকে শিরকে খফি বা ছোট শিরক বিবেচনা করা হয়েছে ইসলামে। ইতিহাসের প্রথম আদম সন্তান হাবিল-কাবিলের কুরবানির মতো কবুল হয়েছে কি হয়নি-সেটি ভাবার বিষয় নয়। আমাদের কুরবানী কবুল হচ্ছে কিনা সেটিই দেখার বিষয়। আল্লাহর মহিমা ও দৃষ্টান্ত: আল্লাহর সৃষ্টি অনেক ক্ষুদ্র প্রাণী রয়েছে। কত জীবের ভয়ে আমরা প্রতিনিয়ত ভীত সন্ত্রস্ত থাকি। সামান্য মশার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নমরুদকে পাকড়াও করার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। অথচ বিশাল বিশাল জন্তুকে তিনি মানুষের অনুগত করে দিয়েছেন। সেগুলোকে তার নামে উৎসর্গ করাই হচ্ছে কুরবানি। এ জন্যই আল্লাহ কুদরতিভাবে কুরবানির যোগ্য পশুর প্রাচুর্যও দান করেছেন। গরু-মহিষ, উট, ছাগল, দুম্বা ইত্যাদি। একদিনেই কোটি কোটি জবাই হওয়ার পরও ঘাটতি দেখা যায় না। এমনকি পরবর্তী বছরের কুরবানির জন্য পশু পাওয়া যাবে কি না, সে চিন্তাও করতে হয় না। আমাদের দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়। আমদানির সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে কিভাবে আমরা কোরবানির পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছি। সবকিছুই মহান আল্লাহ তায়ালার মহিমা। কোরবানি আল্লাহর নিদর্শন: কুরবানি ইসলামের অন্যতম নিদর্শন। কুরবানির জন্য প্রস্তুত করা পশুকে কুরআনে আল্লাহর নিদর্শন বলা হয়েছে এবং এই নিদর্শনকে সম্মান করাকে অন্তরের তাকওয়া বলে অভিহিত করা হয়েছে। সর্বোপরি, তাকওয়ার সাথে কুরবানিতে রয়েছে সমাজের প্রতিটি সদস্যের কল্যাণ। হাত পাততে না পারা এবং হাত পাততে পারা মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবার জোগান হয় কুরবানির মধ্য দিয়ে। কুরবানি না করে এ দুই শ্রেণির মানুষকে যদি কেউ অর্থ দান করে, তবে কতটুকু করবে? এক বা দুই কেজি খাসি বা গরুর গোশত কিনে দেওয়া বা কিনে খাওয়ার পয়সা দেওয়ার মতো মানসিকতা কতজনের আছে তা একটু ভেবে দেখুন। ভিক্ষুকের প্রতি মানুষের আচার-আচরণ সম্পর্কে সবারই কমবেশি জানা আছে। পবিত্র কুরবানি উপলক্ষে তারা সম্মানিত মেহমান হিসেবে মর্যাদা পায়।
মেহমানদারি করা সুন্নাহ: ইসলামের উত্তম কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম সুন্নাহ হচ্ছে- অন্যকে খাওয়ানো বা মেহমানদারি করা। অন্যকে সাথে নিয়ে খাওয়া। কুরবানির ঈদ মানুষকে মেহমানদারি করার অপূর্ব সুযোগ করে দেয়। এটি একটি উত্তম কাজ। একদা এক সাহাবি নবী করিম (স) -কে উত্তম কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে জবাবে রাসুল (সা.) বলেন;- তুমি অপরকে খাবার খাওয়াবে এবং চেনা-অচেনা সকলকে সালাম দেবে।’[ সহীহ বুখারি]। তাকওয়া অর্জন, পুষ্টিকর খাবার ও নগদ অর্থ, পশুর চামড়ার দান-বহুবিদ কল্যাণ রয়েছে।
ঈদুল আযহা উপলক্ষে মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য হাসিল ও সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগের মানসিকতা ও সামর্থ থাকার শর্তে কুরবানি করা এবং তদনুযায়ী জীবনযাপন করার জন্য শিক্ষা দেয়। তাই কুরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষা মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।