ড. মুহাম্মদ নুরউদ্দিন কাওছার
ঈদুল আযহা মুসলিম উম্মাহর অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। ইয়াওমুন নাহর নামেও মুসলিম বিশ্বে সমাদৃত। তবে আমাদের সমাজে ইহা ‘কুরবানির ঈদ’ নামেই বেশি পরিচিত। ঈদ শব্দটির সাথে যেন মিশে আছে এক অনাবিল আনন্দ, ভালোলাগা ও ভালোবাসার অনেক অনেক ছোট গল্পের কথামালা। ঈদুল আযহা মূলত ‘ত্যাগের উৎসব’। এ উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ‘ত্যাগ ও উৎসর্গ’ করা। তাইতো ঈদুল আযহার মধ্যে নিহিত রয়েছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণমুখী কাজ ও ত্যাগের উজ্জ্বল উপমা। আর কুরবানি শাআইরে ইসলাম তথা ইসলামী নিদর্শনাবলীর অন্যতম। এ দিনটিতে মুসলিম উম্মাহ ফজরের নামাজের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাকাআত ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করে ও অব্যবহিত পরে স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, দুম্বা ও উট আল্লাহর নামে কুরবানি করে থাকে।
আদম (আ.)-এর দুই পুত্র কাবিল ও হাবিলের দেওয়া কুরবানি থেকেই মূলত প্রায় ছয়হাজার বছর পূর্বে কুরবানির ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের ওপর কুরবানির বিধান জারি ছিল। আমাদের ওপর যে কুরবানির নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক শিশু পুত্র ইসমাঈল (আ.)- কে আল্লাহর রাহে কুরবানি দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমিয়্যাহ’ হিসাবে চালু হয়েছে। পবিত্র মক্কা নগরীর জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহীম (আ.) ও তদীয় পুত্র ইসমাঈল (আ.) আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন আত্মত্যাগের যে নজির স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে ‘ঈদুল আযহা’ বা ‘কুরবানির ঈদ’। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের এক উজ্জ্বল ও প্রকৃষ্ট নমুনা এই কুরবানির মাধ্যমে ফুটে ওঠে।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় আসলেন তখন মদিনাবাসীর দুটি উৎসবের দিবস ছিল। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ দুটি দিবস কী? (কী হিসেবে তোমরা এ দু’দিন উৎসব পালন কর?) তারা বলল, জাহেলি তথা ইসলামপূর্ব যুগে আমরা এ দিন দুটিতে উৎসব পালন করতাম। তখন রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে এ দুটি দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন- ‘‘ঈদুল আযহা’’ ও ‘‘ঈদুল ফিতর’’ (আবু দাউদ: ১১৩৪; নাসায়ী: ১৫৫৬)।বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের উৎসবসমূহ প্রকৃতপক্ষে তাদের আকিদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের মুখপত্র এবং তাদের জাতীয় চরিত্রের দর্পণ হয়ে থাকে। তাই হাদিসের শব্দমালা অনুযায়ী স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এ প্রাচীন উৎসবগুলোকে বাতিল করে দিয়ে এগুলোর স্থলে ‘‘ঈদুল ফিতর’’ ও ‘‘ঈদুল আযহা’’র দুটি উৎসব এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা এ উম্মতের তাওহীদী চরিত্র ও জীবনধারার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বিশ্বাস ও চিন্তা-চতনার দর্পনস্বরূপ। ঈদুল আযহায় পশু কুরবানির মধ্য দিয়ে সামর্থ্যবান মুসল্লি নিজের ভেতরের পাশবিকতা ও মনের পশুকে জবাই দেওয়ার মাধ্যমে ত্যাগের শিক্ষা গ্রহণ করে। তাইতো ‘শহীদী ঈদ’ কবিতায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেমনটি লিখেছেন, ‘মনের পশুরে কর জবাই/পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।’ পশু জবাই করে অন্যের পাশে দাঁড়ানো আর নিজেকে শুধরানোর আহ্বান নিয়ে আমাদের মাঝে আবারও ফিরে এল ঈদুল আযহা।
শৈশব, কৈশর, যুব কিংবা বৃদ্ধ কোনো বয়সেই ঈদের খুশির আলাদা পার্থক্য থাকে না। সবার মাঝে ঈদ বহুমাত্রিক আনন্দ আনয়ন করে। আমার ক্ষুদ্র জীবনে শৈশবের ঈদ হৃদয়ে অনেকটা স্থান দখল করে আছে। ঈদের দিন ঈদের নামাজ শেষ করে মুসলিম উম্মাহ পশু কুরবানির মধ্য দিয়ে মনের পশুকে কুরবানি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নব্বইয়ের দশকে আমার শৈশব জুড়ে রয়েছে ঈদুল আযহার বহু স্মৃতি। ছোটবেলায় ঈদ আনন্দ ছিল উপভোগ্য ও স্মরণীয়। আর বড় হবার পরে সেই আনন্দটা যেন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। শৈশবের মতো এখন আর সেভাবে ঈদ উদযাপন করা হয়ে ওঠে না। শহরের চেয়ে গ্রামের ঈদে শৈশব কাটানো আমার হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। সেকালে প্রায় ত্রিশ এর অধিক সদস্য নিয়ে আমরা চাচাতো-জেঠাতো ভাই-বোন-এর বিশাল এক পরিবার ছিল। আমরা সবাই বেশি আনন্দ করতাম চাঁদরাতে। অভূতপূর্ব জমজমাট মিলনমেলায় চারদিকে জমে উঠত। তখন অনেক আনন্দ অনুভূতি ও আবেগ আমরা পরস্পরে ভাগাভাগি করে নিতাম। বর্তমানে জেন-জি ও জেন-আলফা এর সদস্যরা যারা ইট-পাথরের শহরে বাস করে তারা কখনো আমাদের সময়ের ঈদ আনন্দের স্বাদ পাবে না। প্রযুক্তির উৎকর্ষে কালের আবর্তে অনেক কিছুই বদলে গেছে। চিন্তাধারায় পরিবর্তন এসেছে। যে যার মতো করে নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে কুরবানির ঈদ উদযাপন করছে। তাই বর্তমানে গ্রামে-গঞ্জেও আমার দেখা শৈশব-কৈশোরের ঈদ ও ঈদের আনন্দ, আবেগ, অনুভূতি ও জৌলুস আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। হারানো দিনের ঈদ আনন্দ ফিরিয়ে আনতে আমরা আমাদের স্ত্রী-পরিজন ও সন্তানদের নিয়ে প্রতি বছর না হোক, অন্ততপক্ষে মাঝে-মধ্যে একবার হলেও কুরবানির ঈদ গ্রামের বাড়িতে উদযাপন করা দরকার। এতে করে আমরা এই প্রজন্মকেও উপহার দিতে পারব আমাদের সেই হারানো দিনের সুখ স্মৃতিগুলো, যেখানে আছে মুখরিত ছোটবেলা, শিশু-কিশোরদের কোলাহলে জমজমাট গ্রামীণ মাঠ-প্রান্তর এবং মেঠোপথে ছুটে চলা বাংলার দামাল ছেলেদের দুরন্তপনাময় শৈশব। গ্রামীণ জনপদের এ আবহে তারা হয়ে ওঠবে উদ্যোগী ও উদ্যমী। ফিরে পাবে প্রাণহীন শহুরে জীবনের পরিবর্তে প্রাণবন্ত শৈশবের চঞ্চলতা। সুতরাং আমাদের ঈদ হোক নির্মল আনন্দের নিবিড় ভালোবাসায় শহুরে জীবন থেকে দূরে গ্রামীণ শ্যামলিমায়, নদীর কলতানে, পাখ-পাখালির কলকাকলিতে মুখরিত আর বিশুদ্ধ নির্মল ঝিরঝিরে বাতাসের কোমল স্পর্শে, শেকড়ের সন্ধানে।
আমাদের সমাজে কুরবানির ঈদ যতটা না আত্মত্যাগ ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হয়, তার চেয়ে যেন বাহ্যিকভাবে এতে কুরবানির পশু ক্রয় ও কুরবানি করার প্রস্তুতির একটি মহা আয়োজন ও আমেজই বেশি পরিলক্ষিত হয়। এখানে ঈদুল আযহা মানে কুরবানির পশু ক্রয় ও তার লালন-পালন-এ আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা সবাই ব্যস্ত সময় পার করা। শৈশবে কুরবানির সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই পশু ক্রয় করার জন্য প্রহরগোনা, বাড়ির মুরব্বীদের কাছে বারবার ধরনা দেওয়া, কুরবানির পশুটা কবে কেনা হবে? আব্বার সাথে হাটে কখন যাব? পশুটা দেখতে কেমন হবে? কত বড় হবে? কত দিয়ে কেনা হবে? কোথায় রাখা হবে? কি কি খাওয়াবো? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন মনে উঁকি দিত।
একসময় আপেক্ষার প্রহর শেষ হয়ে আসে সে কাক্সিক্ষত ঈদের প্রস্তুতির লগ্ন। সদলবলে আমরা সবাই বাপ-চাচাদের সাথে গ্রামের বিভিন্ন গরুর হাটে যেতাম। আমি শুধু দর্শকের ন্যায় তন্ময় হয়ে দেখতাম আমার বাবা-চাচারা কিভাবে পশুর দর কষাকষি করছেন এবং পশু নির্বাচনের পদ্ধতি অনুসরণ করছেন ইত্যাদি। আমার কাছে কুরবানির হাটে পশুর দর কষাকষিকে একটা শিল্প মনে হতো। আব্বা জিজ্ঞেস করতেন এই গরুটা কত? ব্যাপারী দাম বলার পর আব্বা দরদাম করতেন। তখন প্রত্যুত্তরে ব্যাপারীরা মজার উত্তর দিয়ে বলতেন ‘‘আল্লাহ ভরসা’’’। মানে, তিনি এ দামে বিক্রি করতে রাজি না। সে সময় কখনো ব্যাপারীর কানে, কখনো হাতে আঙ্গুল দেখিয়ে, চা-ঝাল মুড়ি খাইয়ে, মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে কিংবা ফাঁকা কোনো স্থানে নিয়ে দরদাম করার রেওয়াজটা খুবই উপভোগ্য ছিল। একসময় ঈদের চার-পাঁচদিন আগে সাধারণত প্রতিবেশীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে আমাদের কুরবানির পশু ক্রয় করা হতো। তখন আমরা বন্ধুরা দলবেঁধে এ বাড়ি-ও বাড়ি গরু-ছাগল দেখতে যেতাম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমরা পুরো সময়টাই গরু দেখাশোনা করে কাটাতাম। এভাবে কখন যে গরুর প্রতি এত মায়া জমে যেত যে, ঈদের দিন গরু জবাইয়ের সময় আমাদের মন খারাপ হয়ে যেত এবং আমরা বোবাকান্না ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। আরো আকর্ষণীয় বিষয় ছিল, দুষ্টু ছেলেরা ঈদের দিন রাতে গরুকে জবাই করার ছুরি দেখাতো এই বলে যে, তাকে (গরুকে) জানান দেয়া হতো তুমি প্রস্তুত হও ‘আগামীকাল তোমাকে এটি দিয়ে জবাই করা হবে’’। তখন আমরা বলতাম, ছুরি দেখে গরু কাঁদছে। আসলে বিষয়টি ছিল পুরাটাই কাল্পনিক।
দীর্ঘ দুইযুগেরও বেশি সময় ধরে আমার মরহুম পিতা আমাদের গ্রামের মসজিদের খতিব ও ইমাম ছিলেন। তারও আগে আমার মরহুম দাদা একইভাবে প্রায় তিনযুগেরও বেশি সময় ধরে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। স্বাভাবিক নিয়মেই তিনি ছিলেন আমাদের ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহের খতিব। চাঁদরাত থেকে আব্বা ঈদের প্রস্তুতি পর্ব শুরু করতেন। তিনি আমাদেরকে একইভাবে তাড়া দিতেন। ঈদের দিন ফজরের পর খুব ভোরে তিনি তার চিরাচরিত নিয়মে আবাকাবা গায়ে জড়িয়ে তার ওপর খান্দানী কোটি পরিধান করতেন। সাথে মাথায় সবুজ/সাদা পাগড়ি পরতেন। এ বেশভূষায় তার সফেদ-শুভ্র চেহারায় তাকে অনন্য লাগতো। আজো আব্বার সে চলন-বলনকে খুব মিস করি। তার সাথে ঈদগাহে যাওয়ার তাড়া খেয়ে আমরাও খুব দ্রুত রেডি হতাম। এরপর জায়নামাজ নিয়ে তাকে অনুসরণ করতাম ঈদগাহের পথ ধরে। এর পূর্বে তিনি নিজে মিষ্টিমুখ করতেন এবং সবাইকে করাতেন। এ সময় তার মাঝে জান্নাতী এক আবহ বিরাজ করত। আমরাও তখন প্রাণবন্ত হয়ে তার পথ ধরে ঈদগাহে পৌঁছে যেতাম। আব্বাকে প্রস্তুতির কাজে আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে একটি দারুণ প্রতিযোগিতা চলতো সবসময়। আম্মাও সে কাকডাকা ভোরে ওঠে শুরু করতেন ঈদের রান্নাবান্না। আব্বা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মুসল্লিদের উদ্যেশ্যে পবিত্র কুরআন ও হাদিস থেকে সারগর্ভ আলোচনা পেশ করতেন। সবাই তন্ময় হয়ে তার ভাষণ উপলদ্ধি করতেন। সেই বুঝ হওয়ার পর থেকে দেখছি, আব্বা আমাদের অত্র অঞ্চলের মানুষজনকে ইসলামের পথে নিরন্তর দাওয়াত দিয়ে গেছেন। আমাদের এ জনপদে ইসলাম প্রচারে তিনি অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করছেন। ঈদের নামাজ আদায়ের পর তিনি খুতবা দিতেন আর দরাজ কণ্ঠে তাকবির ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত করে রাখতেন। নামাজ শেষে আমরা সবাই ঈদের সালামীর জন্য আব্বার আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। তিনি সানন্দে আমাদেরকে সালামী দিতেন এবং উপভোগ করতেন।
সেকালে ঈদে গ্রামে যে আমেজ বিরাজ করতো, স্কুল ও পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো, তা ছিল জীবন্ত ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। একালের ন্যায় ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না ঠিকই, কিন্তু আনন্দ ও খুশির জোয়ার ছিল ঢের বেশি। এখন যেমন কুরবানির সাথে সাথে সবাই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া ও আপলোড নিয়ে অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন এমনটা না থাকলেও সে সময়ের আনন্দ, অনুভূতি ও আবেগ-এর সাথে তুলনা চলে না।
সর্বদাই কুরবানির ঈদকে ঘিরে আমার মনে একটা বাড়তি উত্তেজনা কাজ করত। ঈদের নামাজ আদায়ের পরই শুরু হতো কুরবানির পশু জবাইয়ের আয়োজন। আমাদের গরু জবাই হতো অনেকটা সবার পরে। এর কারণ ছিল, যেহেতু আমাদের পরিবারের সবাই আলেম ছিলেন, তাই আমরা সবাই গ্রামের বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশির পশু জবাইয়ের পর আমাদের গরু জবাইয়ের সুযোগ পেতাম। সবাই সিরিয়াল ধরে আব্বার জন্য অপেক্ষা করতেন, কখন তিনি তাদের পশু জবাই করবেন। আমি এবং আমার ভাইয়েরা তখন আব্বাকে সঙ্গ দিতাম। আমিও মাঝে-মধ্যে গরু জবাইয়ের কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করতাম। তখন অন্যরকম এক অনুভূতি মনের মধ্যে নাড়া দিত। সবার গরু-ছাগল জবাইয়ের পর আসত আমাদের গরু জবাইয়ের পালা। আমি প্রায়ই গরুর গলা অথবা মাথা ধরতাম। আমি দড়িতে গরুর চারটি পা বেঁধে এগুলো হাড় থেকে গোস্ত নামানোর কাজ করে আসছি সে আবহমান কাল ধরে। আর আমি এভাবেই আমার আব্বার ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। তারপর শুরু হতো গরু কাটাকাটি। আমার ছোটচাচা ভুড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজটি করতেন। আর তাকে এ কাজে সাপোর্ট দিত আমার এক সহোদর। আর বাকি ভাইয়েরা কাটাকাটির কাজ করত। এরপর চলতো গোস্ত ভাগাভাগি। এই কাজটি করতেন আমার বড়ভাই ও বড়চাচা। বিকালবেলা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে গরুর গোস্ত বণ্টনের জন্য ছুটে চলতাম এ বড়ি-ও বাড়ি। কিইনা আনন্দ পেতাম এ কাজে!
আম্মা বড় বড় হাঁড়ি-পাতিলে করে মেজবানি রান্নার কাজ করতেন। তিনি সবাইকে খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। টেবিল-চেয়ার নয়, পাটি-চাটাই বিছানো হতো বিশাল উঠোনে। বড় গামলা করে গরুর গোস্ত পরিবেশন করতেন তিনি। এমন মেজবানির আয়োজন আর কয়টি পরিবার করেছে, তা আমাদের চোখে তেমন পড়েনি। সেকালে ঘরে ফ্রিজ না থাকায় আম্মা গোস্ত রান্না করে বিভিন্ন রন্ধন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে করতে দিন কাটাতেন। তখন বাড়ির সবচেয়ে ব্যস্ত ব্যক্তিটিই ছিলেন আমাদের ‘‘প্রিয় আম্মা’’। বাড়ির এমন কাউকে পাওয়া যেত না যিনি আম্মার হাতের সুস্বাদু রান্না খাননি। আর আম্মা সবাইকে আপ্যায়ন করাতে খুব আনন্দ পেতেন। এখনো আম্মা তার এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
জানি, আমাদের সেই দুরন্ত শৈশব আর কখনোই ফিরে আসবে না। তবে, এখনো শৈশবের মধুর ও সুখময় ঈদ উদযাপনের স্মৃতিকে অবলম্বন করে নস্টালোজিয়ায় ভুগি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের শৈশবে এসেছে নান বৈচিত্র। কিন্তু আমাদের শৈশব হলো বহুমাত্রিক ও নানা বৈচিত্রে ভরপুর। এখনকার অপসংস্কৃতি থেকে এই প্রজন্মকে উত্তরণের জন্য দরকার আমাদের শৈশবে তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া। কালের বিবর্তনে ও চরম বাস্তবতায় আমার শৈশব হারিয়ে গেলেও তার স্মৃতিগুলো ধারণ করে ছুটে চলছি নিরন্তর আগামীর পথে। আমার অনুভূতিতে আজো অক্ষত ও সেরা হয়ে আছে আমার সেই দুরন্তপনাময় ছোটবেলা! তাইতো বড্ড বেশি মিস করি ছেলেবেলার ঈদ আনন্দকে।