অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান
ইসলামে বছরে দু’দিন ঈদ বা উৎসবের দিন হিসাবে গণ্য। একটি ঈদ উল ফিতর, অন্যটি ঈদ উল আযহা। রমযানের এক মাস রোযা বা সিয়াম সাধনার পর শওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদ ঊল ফিতর উদ্যাপিত হয়। জিলহজ্জ মাসের নয় তারিখে হজব্রত পালনের পরের দিন জিলহজ¦ মাসের ১০ তারিখে মুসলিম সমাজে বিশ্বব্যাপী ঈদ্-উল আয্হা ও কুরবানি করা হয়। কুরবানি আত্মত্যাগ ও মহান স্রষ্টার নিকট নিঃসংশয় আত্মসমর্পণের এক মহত্তম নিদর্শন। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.) এ নিদর্শন স্থাপন করে গেছেন অনাগত সকল মানুষের জন্য। এর চেয়ে বড় আত্মত্যাগ আর যেমন হতে পারে না, আত্মসমর্পণের এর চেয়ে বড় নজীরও পৃথিবীতে আর নেই। তাই আত্মত্যাগ ও আত্মসমর্পণের এ মহত্তম দৃষ্টান্ত সমগ্র বিশ্ববাসীর নিকট চির অনুপ্রেরণার এক চিরন্তন উৎস হয়ে আছে।
কুরবানির ঐতিহাসিক পটভূমি
মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহকে (আ.) স্বপ্নযোগে কুরবানি করার নির্দেশ দেন। ঘুম থেকে জেগে সকাল বেলা আল্লাহর হুকুম পালনার্থে তিনি বহু সংখ্যক বকরী কুরবানি করেন। কিন্তু পরের দিন রাতে তিনি আবার স্বপ্ন দেখেন, ‘তুমি কুরবানি কর তোমার প্রভুর নামে।’ ফলে সকালে তিনি ঘুম থেকে উঠে আরো বহু সংখ্যক উট, দুম্বা ও মেষ কুরবানি করেন। কিন্তু পর দিন রাতে আবার নির্দেশ এলো : ‘কুরবানি কর তোমার প্রিয়তম বস্তুকে।’
তখন হযরত ইবরাহিম (আ.) গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলেন, বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া পুত্র ইসমাঈলের (আ.) চেয়ে প্রিয়তম কোন বস্তু বা ব্যক্তি পৃথিবীতে তাঁর নেই। তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, মহান প্রভু নিশ্চয়ই তাঁকেই চাচ্ছেন তাঁর রাস্তায় কুরবানি করতে। এ ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। কিন্তু ইবরাহিম (আ.)-এর মনে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বেরই সৃষ্টি হলো না। মহান প্রভু যখন চেয়েছেন, তখন তাতে কোনরূপ ইতস্তত করা উচিত নয়। কারণ তিনিই সব কিছুর মালিক। তিনি দেয়ারও মালিক, নেওয়ারও মালিক। তাঁর হুকুম পালন করাই ইবাদত। তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনই বান্দার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাঁর হুকুম পালনের মাধ্যমেই তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। তাই হযরত ইবরাহিম (আ.) বিন্দুমাত্র দ্বিধা-সংকোচ না করে তৎক্ষণাৎ তাঁর প্রাণাধিক পুত্র ইসমাঈলকে (আ.) আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কুরবানি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে ডেকে আল্লাহর নির্দেশের কথা বললেন।
পিতার কথা শুনে পুত্র ইসমাঈল (আ.) বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে পিতা ইবরাহিমকে (আ.) বললেন : ‘হে পিতা! আপনি নির্দ্বিধায় আল্লাহর হুকুম পালন করুন, আপনি নিশ্চয় আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্যতম হিসাবে দেখতে পাবেন।’
এদিকে শয়তান এসে ইসমাঈলের মা হাজেরাকে প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে পিতা-পুত্রের কথপোকথনের বিষয় তাঁকে জানিয়ে গেল। বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া মায়ের কলিজা ঠান্ডা করা একমাত্র পুত্র-ধন হযরত ইসমাঈল (আ.)। জšে§র ছয় মাস পর পর্বত-সংকুল জন-প্রাণীহীন কা’বার বিজন মরু-প্রান্তরে একমাত্র শিশু পুত্র ইসমাঈলকে (আ.) বুকে ধারণ করে যে সহায়-সম্বলহীনা মা একমাত্র আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভর করে, আল্লাহর রহমতে প্রাপ্ত জমজমের পানি পান করে দীর্ঘ ছয়টি বছর নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন, সে প্রাণাধিক পুত্রকে কুরবানি দেয়ার কথা শুনে মা এতটুকু বিচলিত হলেন না। মহান আল্লাহর হুকুমই সবচেয়ে বড়, যে মহান স্রষ্টা আমাদের জান-মাল, হায়াত-মউত সবকিছুর মালিক, সে মহান রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনই মু’মিন-জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য। তাই ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে মা হাজেরা তাঁর প্রাণাধিক পুত্রকে পানাহার করিয়ে উত্তম পোশাকাদিতে সজ্জিত করে স্বামীর হাতে তুলে দিলেন আল্লাহর রাহে কুরবানি করার জন্য।
পিতার হাত ধরে পুত্র চলেছেন মক্কার অদূরে মীনার পথে কুরবান হওয়ার জন্য। ছয় মাইল দীর্ঘ গিরি-সংকুল পথ। দূরে নীলাকাশ পাহাড়ের বুকে হেলান দিয়ে আছে। চরাচরে পাখিরা গুঞ্জন তুলেছে, ভোরের সোনালী রোদ্দুরে শিশির-সিক্ত মরু-গুল্মেরা কোরক মেলেছে। বোবা প্রকৃতির বুকে চাপা বিস্ময়! মানব-ইতিহাসে এই প্রথম কোন পিতা তাঁর প্রাণাধিক পুত্রকে আল্লাহর হুকুমে কুরবানি করতে নিয়ে যাচ্ছেন। এত বড় ত্যাগ, পিতা-মাতা-পুত্রের এ মহৎ আত্মোৎসর্গ ও নিঃসংশয় আত্মসমর্পণ পৃথিবীতে আর কোথাও কখনো দেখা যায় নি। মহান স্রষ্টার প্রতি বান্দার এ ঐকান্তিক আনুগত্যের অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন মানব জাতির জন্য এক চির অবিস্মরণীয় আদর্শ।
পথিমধ্যে মানুষের চির শত্রু শয়তান এসে প্ররোচনা দিল হযরত ইসমাঈলকে (আ.)Ñ ‘কোথায় যাচ্ছ ইসমাইল! আর একটু পরই তোমার বৃদ্ধ পিতা তোমার গলা কেটে ফেলবে, তুমি ভাগ, পালিয়ে যাও মরু-পাহাড়ের কন্দরে।’
কিশোর ইসমাঈল (আ.) এতে এতটুকু বিচলিত না হয়ে পাথর ছুড়ে মারেন শয়তানকে। তাড়া খেয়ে শয়তান অদূরে চলে যায়। আবার আসে প্ররোচনা দিতে। আবার পাথর ছুড়ে তাড়িয়ে দেন ইসমাঈল (আ.)। তাড়া খেয়ে কিছুক্ষণ পর শয়তান আবার ফিরে আসে। এবার ইসমাঈল (আ.) বড় বড় পাথর ছুড়ে তাড়িয়ে দেন শয়তানকে। এভাবে পরপর তিনবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর শয়তান আর ফিরে আসেনি।
এ ঘটনার স্মরণে মীনার ঐ স্থানে তিনটি জামারাহ্ স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। প্রতি বছর হজ্বের সময় হাজীরা সেখানে তিনবার (প্রতিবার সাতটি করে) পাথর ছুড়ে মারেন। এভাবে মানুষের চির শত্রু শয়তানের ওয়াস্ওয়াসা থেকে আত্মরক্ষা করার যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন কিশোর ইসমাঈল (আ.)Ñ তারই নিদর্শন হলো মীনার জামারাহ্। শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিক্ষণ সে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় নিয়োজিত। হযরত ইসমাঈলকে (আ.) শয়তান যেভাবে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল এবং ইসমাঈল (আ.) সে বিভ্রান্তি থেকে ঈমানী শক্তির বলে নিজেকে যেভাবে রক্ষা করেছিলেন, হাজীগণ প্রতি বছর সে চিরস্মরণীয় দৃষ্টান্তের অনুসরণে পাথর নিক্ষেপ করে থাকেন।
সুপ্রশস্ত মীনা প্রান্তরে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে হযরত ইবরাহিম (আ.) পুত্রের দু’হাত বাঁধলেন, যাতে ছুরি চালানোর সময় অজান্তে বাধার সৃষ্টি না হয়। পিতা নিজেও তাঁর চোখ দুটি বেঁধে নিলেন, যাতে পুত্রের গলায় ছুরি চালাবার সময় মহব্বতে তাঁর হাত দু’টি অবশ হয়ে না পড়ে। এরপর পুত্রকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে তাঁর গলায় ছুরি চালালেন। কিন্তু আশ্চর্য! তীক্ষ্মধার ছুরি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। একবার, দু’বার, না, ছুরি ইসমাঈলের (আ.) গলায় বিদ্ধ হচ্ছে না। পিতা ইবরাহিম (আ.) ঘর্মাক্ত হয়ে উঠলেন। তিনি তাঁর ছুরির ধার পরীক্ষা করলেন। না, সবই ঠিক আছে। সোৎসাহে আবার জোরে ছুরি চালালেন তাঁর প্রাণাধিক পুত্রের গলায়। কিন্তু ব্যর্থ হলেন এবারও।
হন্ত-দন্ত, ক্লান্ত ও হতাশ ইবরাহিমকে (আ.) উদ্দেশ্য করে তখন গায়েবী আওয়াজ হলো : থাম ইবরাহিম! তোমার ত্যাগে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি শুধু তোমার ইচ্ছার একাগ্রতা ও সংকল্পের দৃঢ়তা পরীক্ষা করলাম। তুমি সে অগ্নি-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ। তোমার প্রাণাধিক পুত্র এবং স্ত্রী হাজেরাও তাতে সমভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে।
এরপর ফিরিশতারা একটি মোটা-তাজা দুম্বা হাজির করলেন হযরত ইবরাহিমের (আ.) সামনে। তখন তিনি সেটা কুরবানি করলেন।
এভাবে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দা ইবরাহিম খলিলুল্লাহর (আ.) কাছ থেকে ঈমানের পরীক্ষা নিলেন। সে পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়ে মানবজাতির সামনে এ শিক্ষাই রেখে গেছেন যে, আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য কোন ত্যাগ বা কুরবানিই বড় নয়। তাঁর ইচ্ছা ও নির্দেশের কাছে নিঃসংশয় আত্মসমর্পণই মু’মিন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কুরবানির এ ঘটনার উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন :
“অতঃপর সে যখন তার (ইসমাঈল) পিতার সঙ্গে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহিম বললো, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি যবাহ্ করছি, এখন তোমার অভিমত কী বল? সে বললো, ‘হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইবরাহিম তাঁর পুত্রকে কাত করে শোয়ালেন, তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে।’ এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানির বিনিময়ে। আমি এটা পরবর্তীদের জন্য অনুসরণীয় করে রেখেছি।” (সূরা সাফ্ফাত : আয়াত-১০২-১০৮)।
মানব জাতির ইতিহাসে পিতা-মাতা-পুত্রের এরূপ চরম আত্মোৎসর্গের দৃষ্টান্ত আর কখনো দেখা যায় না। তাই আল্লাহ মানবজাতিকে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে এ চরম ও অত্যুজ্জ্বল ত্যাগের আদর্শকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন ঈদ্-উল আয্হা ও কুরবানির মাধ্যমে। তাই কুরবানির প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য নিছক পশু যবাহ্ করা নয়, খালেছ নিয়তে মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে ত্যাগ ও আত্মসমর্পণের নমুনা প্রদর্শন করা। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা :
“আমি প্রত্যেক কওমের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি যাতে আমি তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ যে সব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের ইলাহ্Ñ এক ইলাহ্, সুতরাং তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণ কর এবং সুসংবাদ দাও বিনীতগণকেÑ যাদের হৃদয় ভয়ে কম্পিত হয় আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে।” (সূরা হজ¦ : আয়াত-৩৪ ও ৩৫, আংশিক)।
এখানে স্পষ্টত বলা হয়েছে, সব যুগেই কুরবানির নিয়ম প্রচলিত ছিল এবং একমাত্র আল্লাহর নামে, একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কুরবানি করে তারাÑ যারা আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পিত, আল্লাহর একান্ত অনুগত ও আল্লাহর নামে যাদের হৃদয় প্রকম্পিত হয়। কুরবানির এ আধ্যাত্মিক দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। কেননা আল্লাহ বলেন :
“আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশ্ত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাক্ওয়া।” (সূরা হজ¦ : আয়াত-৩৭, আংশিক)।
“বল, ‘আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। ‘তাঁর কোন শরীক নেই, এবং আমি এটাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম।” (সূরা আনআম : আয়াত-১৬২-১৬৩)।
জাহিলিয়াতের যুগের মানুষেরা কুরবানি করার পর কুরবানির পশুর গোশ্ত আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত করার জন্য কা’বা ঘরের সামনে এনে রেখে দিত, পশুর রক্ত কা’বার দেয়ালে লেপ্টে দিত, যাতে আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন। তারা বুঝতো না যে আল্লাহ সবকিছু দেখেন ও শুনেন। এমনকি, মানুষের মনের মধ্যে যা কিছু রয়েছে, মাটির গভীরে বা সমুদ্রের নিবিড় তলদেশে যা রয়েছে, বিশ্ব-চরাচরে যা কিছু আছে তিনি সে সবকিছুর স্রষ্টা, নিয়ন্তা ও পালনকর্তা এবং তিনি সবকিছুই দেখেন ও শোনেন। কোন কিছুই তাঁর অগোচরে নয়। তাই কুরবানি করে তা প্রদর্শন করার প্রয়োজন নেই। নিয়তটাই এখানে আসল এবং নিয়তের উপরই তা কবুল হওয়া-না হওয়া নির্ভর করে। হযরত আদমের (আ.) দু’পুত্র হাবিল ও কাবিলকে কুরবানি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আল্লাহ হাবিলের কুরবানি কবুল করেছিলেন, কিন্তু কাবিলের কুরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয় নি। এর একমাত্র কারণ ছিল নিয়ত। কুরবানির ব্যাপারে হাবিলের ছিল খালেছ নিয়ত, একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই তাঁর কুরবানি নিবেদিত হয়েছিল। তাই তা কবুল হয়। অন্যদিকে, কাবিলের নিয়ত সহীহ না হওয়ায়, আল্লাহ তা কবুল করেন নি। এতে কাবিল ক্ষিপ্ত হয়ে হাবিলকে আক্রমণ করে বসে এবং তাঁকে হত্যা করে।
সূরা হজ্বের পূর্বোদ্ধৃত ৩৭ নং আয়াতে জাহিলী যুগের আরবদের এ কুপ্রথার মূলোৎপাটন করে সুস্পষ্টভাবে যা বলা হয়েছে, তার অর্থ হলো :
কুরবানির পশুর রক্ত-মাংসের কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই; তিনি যা চান তাহলো কুরবানিকারীর তাক্ওয়া, আল্লাহর প্রতি একান্ত আনুগত্য ও আল্লাহর প্রতি মু’মিন-চিত্তের একাগ্রতা। হযরত ইবরাহিম, হযরত ইসমাঈল ও হযরত হাজেরার (আ.) মাধ্যমে আল্লাহ এরই পরীক্ষা নিয়েছিলেন। পশু কুরবানির মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে মুমিনের এ পরীক্ষার ঐতিহাসিক ধারার অনুবর্তন চলে আসছে। কুরবানিকারী পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে তার তাক্ওয়ার পরীক্ষা দেন। আর একথা সুবিদিত যে, লোভ, মোহ, স্বার্থপরতা ও কুপ্রবৃত্তির মধ্যে কখনো তাক্ওয়া বা আল্লাহভীতির সৃষ্টি হয় না। অতএব, কুরবানি আমাদেরকে এসব মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে ওঠার প্রশিক্ষণ দেয়। আত্মশুদ্ধির জন্য যেমন এ ধরনের প্রশিক্ষণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ, কল্যাণময়, সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যও তেমনি তা অপরিহার্য। এদিক দিয়ে কুরবানির ব্যক্তিগত ও সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। এ জন্যই মহানবী (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।”
কুরবানি সম্পর্কে আরো কতিপয় হাদীস :
“হযরত যায়দ ইবনে আকরাম (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ কুরবানি কী?’ নবী করীম (সা.) বললেন, ‘তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহিমের (আ.) সুন্নত।’ বললাম, ‘এটা করলে আমরা কী পাব?’ বললেন, ‘প্রত্যেকটি চুলের বিনিময়ে একটি করে নেকী।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! পশমের ব্যাপারে কী হবে?’ বললেন, ‘প্রতিটি পশমের বদলে একটি করে নেকী পাওয়া যাবে।” (ইবনে মাজাহ, হাকেম, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ, আল-মুনযেরী)।
উম্মুল মু’মীনুন হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত আরেকটি হাদীস। তিনি বলেন: “রাসূল (সা.) বলেন : ‘কুরবানির দিন কোন ব্যক্তি (কুরবানির পশুর) রক্ত ঝরানোর ন্যায় আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় অন্য কোন কাজই করতে পারে না। যবাহ্ করা জন্তু কিয়ামতের দিন তার শিং, পশম, ও খুর নিয়ে উপস্থিত হবে। কুরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর দরবারে তা সন্তুষ্টির মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা এতে মনের সুখ ও সন্তোষ নিবদ্ধ কর।” (তিরমিযী, হাকেম, ইবনে মাজাহ)।
হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত অপর একটি হাদীসে মহানবী (সা.) তাঁর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমাকে (রা.) লক্ষ্য করে বলেন, : “তুমি ওঠ, তোমার কুরবানির নিকট উপস্থিত হও এবং তা দেখ। কেননা কুরবানির যে রক্ত প্রবাহিত হয় তার প্রতি বিন্দুর বিনিময়ে আল্লাহ তা’য়ালা তোমার অতীত গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ হযরত ফাতিমা (রা.) বললেন : ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের নিজ পরিবারবর্গের লোকদের জন্য এটা কি বিশেষ ব্যবস্থা, না আমাদের জন্য ও সব মুসলমানের জন্য এটা।’ নবী করীম (সা.) বললেন : ‘না, বরং আমাদের ও সব সাধারণ মুসলমানের জন্যই এ ব্যবস্থা।” (বায্যার)।
ইসলামের দু’টি বড় ইবাদত হজ¦ ও কুরবানি (প্রথমটি ফরয, দ্বিতীয়টি ওয়াজিব) মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.) এর শিক্ষা বা আদর্শ। পুত্র ইসমাঈলকে (আ.) সঙ্গে নিয়ে হযরত ইবরাহিম (আ.) যখন পবিত্র কা’বা গৃহ পুনঃনির্মাণ কাজ শেষ করেন তখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা এল:
“এবং স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহিমের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সেই গৃহের স্থান, তখন বলেছিলাম ‘আমার সঙ্গে কোন শরীক স্থির করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রেখো তাদের জন্য যারা তাওয়াফ করে এবং যারা দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজ্দা করে। এবং মানুষের নিকট হজে¦র ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রসমূহের পিঠে, এরা আসবে দূর-দূরান্তর পথ অতিক্রম করে, যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে।” (সূরা হজ্ব : আয়াত-২৬-২৮)।
হজ¦ উপলক্ষে যেমন একমাত্র আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পার্থিব সকল কিছু ত্যাগ করে মক্কা শরীফে সমবেত হতে হয়, কুরবানিও তেমনি একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। হযরত ইবরাহিম (আ.) তাঁর প্রাণাধিক পুত্রকে কুরবানি করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন সেই মহান স্মৃতির স্মরণে প্রতি বছর পশু কুরবানি করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগের পরীক্ষা দিতে হয়। হজে¦র মধ্যে যেমন ব্যক্তিগত তাক্ওয়া অর্জন ছাড়াও মুসলিম উম্মার ঐক্য-সংহতি, ভ্রাতৃত্ব, কল্যাণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও ইসলামকে বিশ্বের সর্বোত্তম বিধান ও বিজয়ী আদর্শরূপে তুলে ধরার প্রয়াস বিদ্যমান, ঈদ্-উল আয্হা ও কুরবানির মধ্যেও তেমনি আল্লাহর প্রতি একান্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে একাধারে ব্যক্তিগত তাক্ওয়া, মুসলিম সমাজের ঐক্য-সম্প্রীতি, পারস্পরিক কল্যাণ কামনা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও একাত্মতার এক মহিমময় উজ্জ্বল প্রাণবন্ত চিত্র ফুটে ওঠে।
এখানে যেমন আনন্দ রয়েছে, তেমনি রয়েছে ছোট-বড়, ধনী-গরীব, বর্ণ-গোত্রের ভেদাভেদ ভুলে সকলে মিলে বিশ্বস্রষ্টার নিকট আত্মনিবেদনের এক মানবিক উদার মহত্তম সংস্কৃতির প্রকাশ।
পবিত্র হজ¦, ঈদ্-উল আয্হা ও কুরবানি প্রতি বছর আমাদের জন্য বহন করে আনে অপরিসীম আত্মত্যাগের এক সুমহান বার্তা। এ উপলক্ষে আমরা আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে একাধারে মহান স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ ও কল্যাণ-চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হতে পারি। বিশেষভাবে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এর প্রত্যেকটিই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই এর লক্ষ্য। কোনরূপ প্রদর্শনেচ্ছা, পার্থিব ফায়দা হাছিলের মনোভাব যেন এর মধ্যে স্থান লাভ করতে না পারে, সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। ‘ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহ্ইয়া ইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’- আমাদের নামায, কুরবানি ও সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত হোক। নিছক প্রথাগতভাবে লোক দেখাবার জন্য যেন আমরা কোন ইবাদতই না করি। লোক দেখানোর জন্য রক্তক্ষরণ ও গোশ্ত ভক্ষন করে কুরবানির মহান আত্মোৎসর্গের শিক্ষাও যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত না করি, সেদিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখা একান্ত কর্তব্য।
কুরবানি যেমন এক মহান আত্মত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি নিঃসংশয় আত্মসমর্পণের অনন্যতুল্য ঐতিহাসিক মহত্তম শিক্ষা তেমনি এটা পালনের মধ্যে ইসলামের মানবতাবাদী উদার ও সাম্য-ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এক উজ্জ্বল সংস্কৃতির সুস্পষ্ট প্রকাশ। এর শিক্ষা, তাৎপর্য ও লক্ষ্যের প্রতি খেয়াল রেখে যথাযথভাবে ঈদ্-উল আয্হা ও কুরবানি করার জন্য আমাদের যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।
* অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান লেখাটি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে দৈনিক সংগ্রামের জন্য দিয়েছিলেন।