ড. কামরুল হাসান
মানব জীবনের চলমানতা স্রষ্টার এক বিশেষ অনুগ্রহ। শয়ন-জাগরণ, হাঁটা-চলা, কথা বলা কিংবা চুপ থাকা মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানব জীবনের সক্রিয়তা প্রমাণের জন্য কথা বলা যেমন আবশ্যক। তেমনি চুপ থাকাও অত্যাবশ্যক। এতদুভয়ের সুসমন্বয়ই জীবন সক্রিয়তার অনন্য রূপ। কথা বলা এক ধরনেরর শিল্প, জীবন নান্দনিকতা। যার উপস্থাপন যত সুন্দর তিনি তত গুণী বাচিক শিল্পী। বাচিক শিল্পের নানাবিধ প্রকাশের অন্যতম হলো- সমষ্টির সামনে ব্যক্তির সামগ্রিক উচ্চারণ। অন্যভাবে বলা যায়- সমষ্টির কল্যাণে বা জন-উন্নয়নে কোনো ব্যক্তি তার যে কল্যাণ ভাবনা উপস্থাপন করে তাকেই আমরা বক্তৃতা হিসেবে চিহ্নিত করি। যিনি বক্তৃতা দেন তিনিই বাগ্মী। বিশ্বোতিহাসে বিখ্যাত বাগ্মীর সংখ্যা নগণ্য না হলেও অবশ্যই তা হাতে গোণা।
পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম আ. ছিলেন একজন বাগ্মী। তার দুই সন্তান হাবিল ও কাবিলের বিতার্কিক চরিত্র আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখেছি। তাদের বক্তব্য কৌশলও প্রত্যক্ষ করেছি। পরবর্তিতে সক্রেটিস, এরিস্টোটল, প্লেটোর বাগ্মী চরিত্র আমরা দেখেছি। একইসাথে জনকল্যাণে তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াও প্রত্যক্ষ করেছি। এখানে বলা বাহুল্য হবে না যে- মানব হেদায়েতের নিমিত্তে প্রেরিত সকল নবি-রাসুলই ছিলেন এক একজন খ্যাতিমান বাগ্মী। মুসা আ.-এর কথা আমরা জানি। তার বাক-শক্তির কিয়দ ত্রুটির কারণে তিনি বক্তব্য উপস্থ্াপনে একজন সহযোগী আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। মহান আল্লাহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। তার ভ্রাতা হারুনকে তার সহযোগী হিসেবে প্রদান করেন। তাকেও নবীর মর্যাদা দেন। সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি।
বিশ্বজাহানের শেষ নবী মুহাম্মদ সা. তার নবী জীবনের সর্বটুকুতে তার এ প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন পূর্ণমাত্রায়। তার বন্ধু-স্বজনদেরকেও শিখিয়েছেন এ শিল্পকলা। নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন তার সাহাবিদের। এ শিল্প নৈপুণ্য ও দক্ষতা অর্জনের জন্য। তিনি দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেছেন- ইন্না মিনাল বায়ানি লাসিহরান। নিশ্চয়ই বাক-শিল্পের নিপুণতায় রয়েছে মোহাবিষ্টতা। বাকচাতুর্য মানুষের মতামত পরিবর্তনে অভাবনীয় প্রভাব সংরক্ষণ করে। জনকল্যাণ ও মানবিকতার প্রতিষ্ঠায় এর ইতিবাচক প্রভাব আরো সুদূর প্রসারি।
নবী মুহাম্মদ সা. তার জীবনব্যাপী বাকশিল্পের চর্চায় মানবকল্যাণ প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন। তার নবুওতি জিন্দেগির আগে ও পরে জনকল্যাণে তিনি তার বাচিক শিল্পকে কাজে লাগিয়েছেন যথাসক্ষমতায়। তবে তার অসংখ্য, অগণিত বক্তৃতার মাঝেও আমাদের মানসে তার যে মহান বক্তৃতা আঁচড় কাটে প্রতিনিয়ত তা হচ্ছে তার জীবন সায়াহ্নের শেষ বক্তৃতা। যা তিনি জনসমুদ্রে একলক্ষ জনতার সামনে উপস্থাপন করেন নবম হিজরীর নয় জিলহজ্জ তারিখে। যা ইসলামের ইতিহাসে বিদায় হজ্জের ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। মানবতার ইতিহাসে এ ভাষণকে নৃপতিবৃন্দের শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়। মানবতার কল্যাণে, মানবিকতার প্রতিষ্ঠায় যে সকল ভাষণকে মূল্যায়ন করা হয় বিদায় হজ্জের ভাষণ সে সবের অন্যতম এবং প্রধানতম। অবশ্য আমরা মনে করি- বিদায় হজ্জের ভাষণ মানবতার উন্নয়নে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ। এ ভাষণের সাথে অন্য কোনো ভাষণের তুলনা করা অর্থহীন। বরং অন্য সব ভাষণ কোনো কোনো দিক হতে তুলনীয় হতে পারে বিদায় হজ্জের ভাষণের সাথে।
উচ্চকিত মানবতার প্রতিষ্ঠায় বিদায় হজ্জের ভাষন প্রথম এবং পথিকৃৎ। আমরা আজকের এ নিবন্ধে খানিকটা দৃকপাত করতে প্রয়াস পাব যে, নবীজীবনের শ্রেষ্ঠ এ ভাষণ কিভাবে মানবতার দীপ্তবাক হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। নবীর বিচক্ষণধর্মী এ বক্তব্যের প্রতিটি অধ্যায়ে কিভাবে মানবতার প্রকৃত স্বরূপ প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাঁর বক্তব্যের প্রতিটি পরতে কিভাবে মানবতা মর্যাদাবান হয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের প্রতিটি স্তরে মানবতাকে সমুন্নত করার দীপ্তবাক ছিল মহানবীর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ। মানবতার জয়গানে উচ্চকিত ছিল মহানবীর প্রতিটি শব্দের ব্যঞ্জনায়, বাক্যের দ্যোতনায়। তার বক্তব্যের ঢঙ, আকর্ষণীয় স্টাইল, অনুভুতিস্পর্শকারী কৌশল, মানব মনে প্রভাব বিস্তারকারী উপস্থাপন যে-কোনো মানব মনকে মানবিক না করে ছাড়ে না।
নবির সে বক্তব্যের শুরুতেই মানবিক নবীর মানবিকতা লক্ষ্য করুন। তিনি বক্তব্য প্রদান করেছিলেন এক লক্ষ পঁচিশ হাজার অনুচরবর্গের সামনে। যাদের সবাই ছিলেন বিশ্বাসী মুসলিম। কিন্তু বক্তব্যে শুরুতে তিনি বলেন- আইয়্যুহান্নাস হে মানব মণ্ডলী! প্রিয় ভাইয়েরা আমার।
হে মুসলিম/ হে মুমিন/ হে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী বা এমন অন্য কোনো শব্দে সম্বোধন করেননি। অর্থাৎ তার বিদায় হজ্জের ভাষণ ছিল বিশ্ব মানবতার জন্য। বিশ্বে বসবাসরত সকল মানুষের জন্য। বর্তমান এবং ভবিষ্যতে আগত সকল মানুষের জন্য। বিশেষ কোনো ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী বা জাতির জন্য নয়।
সমগ্র শোতৃমণ্ডলীকে প্রলুব্ধ করার অনন্য টেকনিক নবীর ছিল। তিনি তার কথার জাদুতে প্রথমেই সমবেত জনমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন- বন্ধুগণ! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। কারণ আমি জানি না- এটিই তোমাদের সাথে আমার শেষ দেখা কি না? এই পবিত্রস্থানে অন্য কোনো বছরে তোমাদের সাথে আমার আর দেখা হবে কি না? রাসুলের এমন বক্তব্যে উপস্থিত সহচরবৃন্দ সচকিত হয়। হয়তো রাসুলের জীবনকাল সমাপ্তির পথে। তারা প্রিয় রাসুলের বক্তব্যে অতি মনেযোগী হয়। আর এ সুযোগে তিনি মানবিকতার প্রতিষ্ঠায় সামগ্রিক নির্দেশনা উপস্থাপন করেন। যা আজও অলঙ্ঘনীয় বিশ্বের প্রতিটি মানবতাবাদীর নিকট।
তিনি তার বক্তব্যের শুরুতেই মানুষের জীবন ও সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে চিরন্তন দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি তার নির্দেশনা পৌঁছাবার স্বপক্ষে সমবেতদের হতে স্বাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। তার এ স্বাক্ষ্য আদায়ের কারণে কেউ তাকে কোনোদিন মানবিকতার ফেরিওয়ালার দাবি থেকে সরাতে পারবে না। নবী তার বক্তব্যের শুরুতে নামাজ, রোজা বা অন্য কোনো ইবাদাতের কথা না বলে সমগ্র মানব সমাজের জান ও মালের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করেছেন। যা প্রমাণ করে তার বক্তব্য ছিল মানবতাবাদের চিরন্তন দীপ্তবাক।
মানব জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ অর্থনৈতিক লেনদেন। অর্থনৈতিক লেনদেন ব্যতিত মানব জীবন অচল। বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা. এটি উপলব্ধি করতেন পূর্ণাঙ্গভাবে। তাই তিনি অর্থনৈতিক জীবনের স্বচ্ছতায় প্রয়োজনীয় মূলনীতির জানান দিয়েছেন উম্মাহকে। তার বাস্তবায়নে নিয়েছেন যথাযথ পদক্ষেপ। বিদায় হজ্জের ভাষণেও আমরা তার অনুরণন শুনতে পাই। তিনি সুদকে চিরস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করে মানব জীবনের অর্থনৈতিক শুদ্ধতা নিশ্চয়নের পরিপূর্ণতার ব্যবস্থা করেন। যা মানবিক সমাজ পরিগঠনের নিয়ামক উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে সর্বকালে, সর্বযুগে।
বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি চূড়ান্তরূপে মানব হত্যাকে নিষিদ্ধ করেন। মানব হত্যার রক্তমূল্য কিংবা দণ্ডমূল্য নির্ধারণ করে বলেন- হত্যার এ প্রতিশোধের মধ্যেই রয়েছে জীবনের উজ্জীবন। নবীর এ বক্তব্য নিয়ে অনেক গবেষণা শেষে গবেষকদের সিদ্ধান্ত হলো- সত্যিই হত্যা বন্ধে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো বিকল্প নেই। অর্থাৎ হত্যার এমন শাস্তির উদ্দেশ্য জীবন নাশ নয় এ যেন অনেক জীবনের উদ্বোধন।
বিশ্বনবীর মদিনার দশ বৎসর কিংবা নবীজীবনের তেইশ বৎসর। আরো বৃহৎ অর্থে তার জীবনের তেষট্টি বৎসরব্যাপী মানবতার সেবায়েত হিসেবে তিনি সুমহান খেদমতের নিরলস আঞ্জাম দিয়েছেন। জন-মানুষকে সত্য ও সততার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছেন। অসততা ও অপসংস্কৃতির মূলোৎপাটনে কার্যকরি উদ্যোগ নিয়েছেন। তাতে অবশ্যই অপশক্তি তথা ইবলিশ বড়ই হতাশাগ্রস্ত। এটি সুনিশ্চিত হয়েই বিদায় হজ্জের সুবিশাল প্রান্তরে স্মরণকালের বৃহৎ জনসমুদ্রের জনমণ্ডলীকে লক্ষ্য করে বলেন- শয়তান আজ তার আনুগত্য নিয়ে বড়ই হাপিত্যেশে সংক্রমিত। তবে সে আশাবাদী এরপরেও মানুষ ছোট-খাট বিষয়েও মনের অজান্তে তার তুষ্টিতে নিমগ্ন হবে। অতএব শয়তানের কুমন্ত্রণা হতে সমগ্র মানবকে সতর্ক করছি। মানবতার শত্রু ইবলিশ কখনও তোমাদের বন্ধু হতে পারে না।
সংস্কৃতি একটি জাতির প্রাণ। সংস্কৃতিই একটি জাতির আচরণ ও লোকাচার নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্য রাসুল সা. যত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রতি তার চেয়ে বেশি মনোযোগি ছিলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতি। সাংস্কৃতিক সংহতি ছাড়া কোনো বিপ্লবই টেকসই হয় না। মহানবী সা. এবার সমবেতজনদের দৃষ্টিকে আরবের নিত্য সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট করেন। আরব সমাজের মজ্জাগত বিষয় যুদ্ধ-বিগ্রহ। যুদ্ধ নেশা তাদেরকে পেয়ে বসলে তারা চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলত। যুদ্ধ প্রলম্বিত করতে মাসকে আগে পিছে করত। যদি তাদের সামনে পবিত্র মাস এসে পড়ত। তবুও তারা থামত না। অথচ এটি একটি ঘৃণ্য প্রথা, জাহালতের চরম প্রকাশ। তাই তিনি এ প্রথাকে নিষিদ্ধ করেন। কারণ এটি মানবতা সংহারক। যুদ্ধের মতো ভয়ানক বিষয়কে প্রলম্বিত করতে এমন সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে অনাকাক্সিক্ষত। তিনি ঘোষণা করেন- রক্তের নেশায় যুদ্ধ কখনও চলতে পারে না। এবারও বিশ্বনবী সমবেত জনতা হতে স্বাক্ষ্য গ্রহণ করে নিজেকে দায়িত্বমুক্ত করতে সচেষ্ট থাকেন।
এবারে রাসুল সা. মনোেিবশ করেন পরিবার ও সংসার সংগঠনের দিকে। কারণ পরিবারই সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক ভিত্তিভূমি। পরিবারসমূহে জায়া ও পতির দায়িত্ব, কর্তব্য ও মর্যাদা নিয়ে প্রায়শ বিরোধ-বিসম্বাদ লেগেই থাকে। তিনি স্বামী ও স্ত্রীর যার যার আভিজাত্য, কৌলিণ্য ও মর্যাদাকে স্থির করে দেন। যাতে কেউ কারো প্রতি দোষারোপ করতে না পারে। তিনি তার বক্তব্যে স্ত্রীর মর্যাদা, স্বামীর কর্তব্য, এতদুভয়ের প্রাপ্য ও অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে মানব উম্মাহকে আগত সমূহ ক্ষতির আশংকা হতে নিরাপদ করেন। এতে পারিবারিক শৃংখলা রক্ষা পায়। দাম্পত্য কলহ হ্রাস পায়। অযৌক্তিক বিসম্বাদ হতে সমাজ বেঁচে যায়। আবারও তিনি জনতাকে তার দায়িত্ব পালনের স্বাক্ষ্যদাতা হিসেবে স্বাক্ষ্য নেন।
এবার তিনি মুসলিম জাতি সত্তার স্থিতি, ইসলামি জাতীয়তাবাদের টেকসই ভিত্তি, গোষ্ঠীগত সৌভ্রাতৃত্ব, রাষ্ট্র রক্ষায় ঐক্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন, সংশয়মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করেন আপন প্রজ্ঞায়। তিনি মুসলিম উম্মাহকে একই ঐক্যের বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ করেন। সীসাঢালা প্রাচীরের অনবদ্যতায় গোটা উম্মাহকে একসাথে, এক কাতারে অন্তর্ভুক্ত করেন। দেশ, কাল, জাতি, অঞ্চল, বর্ণ এসবের ভেদ দূর করে এক অনবদ্য জাতিগঠনের অনুপম নমূনা উপস্থাপন করেন। সমবেতদের সতর্ক করেন- অনুপস্থিতদের এ সংবাদ প্রেরণের দায়িত্ব প্রদান করেন উপস্থিতদের। গ্লোবালাইজেশনের এর চেয়ে দামি আহ্বান আর কী হতে পারে?
সমবেত জনমণ্ডলীকে তিনি হৃদ-উৎসারিত আকুতি পেশ করেন- তোমরা যদি আমার এ প্রস্তাবে সম্মত থাক তবে তোমাদের জন্য আমার রেখে যাওয়া ব্যবস্থাপনা থাকবে দুটো। এক. আল্লাহর কিতাব অন্যটি আমার আদর্শ। এ দুইকে তোমরা যথাযথভাবে অনুসরণ করো, কেউ তোমাদের পথহারা করতে পারবে না।
সমগ্র উম্মাহকে এ পথে অটুট রাখতে, তাদেরকে দৃঢ়পদ রাখতে এক সবিশেষ উপদেশ প্রদান করে বলেন- হে জনমণ্ডলী, তোমরা জেনে রাখ, তোমাদের রব এক। তোমাদের আদি পিতা এক। তোমরা সব এক আদমের সন্তান। যিনি মৃত্তিকা হতে সৃজিত। অতএব তোমাদের গর্ব ও অহংকারের কিছু নেই। বরং সেই তোমাদের মহত্তম যে আল্লাহকে ভয় করে। সমগ্র মানব সত্তার মাঝে কারো উপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি কেবল খোদাভীরুতা বা তাকওয়া।
এভাবেই বিশ্বনবী সা. তার বিদায় হজ্জের ভাষণে বিশ্বমানবতার ভিত্তি বীজ রোপণ করেন।
বর্তমান সমাজের প্রকট সংকট উত্তরাধিকার বিষয়ে। ইসলাম প্রবর্তিত ও বণ্টিত বিধিমালা বাস্তবায়নে তিনি জোর দেন। সম্পদ বেহাত হবার আশঙ্কায় নিকটাত্মীয়কে তা প্রদান ও মুত্যু পূর্ব অসিয়তকে নিয়মের অধীনে নিয়ে আসেন। সর্বক্ষেত্রে বাড়াবাড়িকে নিরুৎসাহিত করেন। সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে যুগান্তকারী সব ঘোষণা দেন।
দাম্পত্য জীবনে কলুষমুক্ত হওয়া সমাজ জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ। পারস্পারিক সন্দেহ ও সংশয়প্রবণতা দাম্পত্য কলহের উৎসভূমি। দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করতে যাবতীয় সংশয় হতে মুক্ত থাকতে হবে। কথায় কথায় স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে সন্দেহ করতে পারবে না। পরম আস্থা ও নির্ভরতার আলোকে পরিচালিত হবে দাম্পত্য জীবন। রাসুল সা. বিদায় হজ্জে ঘোষণা করেন- সন্তানের পরিচয় হবে শয্যা সঙ্গি তথা স্বামীর পরিচয়েই। তবে কেউ ব্যভিচার করলে তার পরিণাম হবে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যৃদণ্ড।
রাসুল সা. বিদায় হজ্জের ভাষণে সমাজ অসুস্থতার মূলে কুঠারাঘাত করেন। সমাজে দত্তক সন্তান ও দত্তক পিতা গ্রহণের প্রবণতাকে চিহ্নিত করেন। এমন প্রবণতা সর্বাবস্থায় বর্জনীয়। এ কাজে সম্পৃক্তজনরা অবশ্যই আল্লাহ, ফিরিস্তা ও জনঅভিশাপে নিমজ্জিত হবে। তার কোনো ইবাদাতই আল্লাহর কাছে কবুল হবে না।
এভাবেই রাসুল মুহাম্মদ সা. তার বিদায় হজ্জের নাতিদীর্ঘ বক্তব্য শেষ করেন। অল্প সময়ের চুম্বক কথার স্পর্শে তিনি বিশ্ববাসীকে মানবতার যে সবক প্রদান করেন তা পৃথিবীতে বিরল নয় একমাত্র।
বিদায় হজ্জে প্রদত্ত রাসুলের অমীয় বক্তব্য আজও মানবিকতাকে ধারণ করে বিশ্বব্যাপী প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। আজকের পৃথিবীকে মানবতার যে সকল সংকট বিদ্যমান যেন তার সতেজ প্রতিষেধকের ব্যবস্থা রয়েছে বিদায় হজ্জের ভাষণে। আজকের পৃথিবীতে চলছে দুর্বলের উপর সবলের খড়গ আক্রমণের প্রতিযোগিতা। লোহিতের প্রস্রবণ যেন সমাজের নিত্যচিত্র। মানব লহুই আজ বিশ্বের সর্বাধিক সুলভ বস্তু। মানবের রক্ত আজ মূল্যহীন। মানবজাতিকে রক্তের নেশা হতে নিস্কৃতি দিতে সমাজকে খুনখারাবির হাত হতে মুক্তি দিতে বিদায় হজ্জের অমর বাণী আজও দুনিয়াবাসীকে পথ দেখায়। আলোকরেখার সন্ধান দেয়। খুনের প্রবৃত্তি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে বিদায় হজ্জের নির্দেশনা কিয়ামত তক মানুষকে নিবৃত্ত জীবনের স্পর্শ দিয়ে যাবে অবিরাম।
অর্থনৈতিক মোড়লীপনায় অস্থির দুনিয়ার রাজা-বাদশারা। পুঞ্জিভুত সম্পদ আর অঢেল শৌর্যের একত্রিকরণে ব্যস্ত বিশ্বের মোড়লগোষ্ঠী। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় একদিকে গড়ে উঠছে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ধনকুবশ্রেণি। অন্যদিকে সম্পদের তলানিতে পৌঁছেছে দরিদ্র শ্রেণি। এই বৈষম্য হতে বাঁচার কোনো পথ পায়নি বিশ্ববাসী। সেদিন যে সমস্যা ছিল আজও সেই সমস্যা সমানরূপে দৃশ্যমান ও বিদ্যমান। বিদায় হজ্জের সুষম অর্থনৈতিক কাঠামো বিনির্মাণের ব্যবস্থাপত্র আজ ও আগামির জন্য সমান কার্যকর। এ নির্মম, সত্য পৃথিবীর সকল অর্থবোদ্ধার স্বীকৃতিতেও মেলে।
একইভাবে আমরা যদি বিদায় হজ্জের বক্তব্য নিরীক্ষা করি তবে দেখতে পাব বক্তব্যের পুরোটা জুড়ে রয়েছে কেবলই বৈষম্যহীনতার প্রতিচ্ছবি, সাম্যের প্রতিষ্ঠা, মানবতার সংরক্ষণ, মানবিকতার উচ্চকণ্ঠ, মানবের প্রতি সহমর্মিতা। নবীর বক্তব্যের দেড় সহস্রাব্দ পরেও তা অমলিন। মানবিকতা প্রতিষ্ঠার এক সুমহান দলিল। এই দলিলের আবেদন শেষ হবে না কোনোদিনও। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।