নূরুন্নাহার নীরু
পত্রিকার পাতা খুলতেই দেখা যায় পরকীয়ার জেরে স্বামী স্ত্রীকে খুন অথবা স্ত্রী স্বামীকে খুন , আবার সম্পত্তির লোভে ছেলে-মেয়ে-বউ মিলে পিতাকে খুন বা পিতাই সন্তানকে খুন, আবার কোথাও লম্পট সন্ত্রাসীর ক্ষমতার দাপটে অসহায় জনকে ভিটে মাটি হীন করা ইত্যাদি হরেক রকম ঘটনা-দুর্ঘটনা, ব্যভিচার, খুন-ধর্ষণ, জিঘাংসা, জ্বালাও পোড়াও, রক্ত লোলুপতা অহরহ ঘটেই যাচ্ছে। এসবেরই সয়লাব যেন আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
মূলতঃ ধর্ম বিমুখতা, ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মীয় সংকীর্ণতা , অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীনতা এবং সর্বগ্রাসী অশ্লীলতাই সমাজ চিত্রকে বদলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। যাকে আমরা এক কথায় বলছি ‘অবক্ষয়। মনীষীদের মতে, অবক্ষয়হীন সমাজ গড়ার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ধর্ম ! কেননা প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কোন না কোন ধর্মকে আশ্রয় করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেটি ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে গড়ে উঠেছে।
সুতরাং একটি নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি সৃষ্টি ও অবক্ষয়হীন সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে নাগরিকদের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি , মূল্যবোধের সম্প্রসারণ, লালন ও অনুশীলনের কোন বিকল্প নাই। ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ কুতুব বলেছেনঃ”যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে সে সমাজই একটি সভ্য সমাজ। উপরুন্তু একটি সভ্য সমাজ গড়তে হলে প্রথমেই সে সমাজের” নৈতিক অবক্ষয়গুলোকে “ চিহ্নিত করতে হবে এবং এর প্রতিকার স্বরূপ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সসালাম এর দেখানো আদর্শকে সামনে আনতে হবে। যেহেতু মহান আল্লাহ সুবহানাতায়ালা ঘোষণা দিয়েছেন তোমাদের জন্য রাসূল সাঃ এর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। (৩৩:২১)
নৈতিক অবক্ষয় রোধে রাসূল সাঃ এক বিশ্ব শক্তি” বিষয়টি বুঝতে প্রথমেই আমাদের যে বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হচ্ছে যথা
১ নং নৈতিক অবক্ষয় বলতে কী বুঝি ?
২নং বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবক্ষয়ের চিত্রসমূহ।
৩নং অবক্ষয় রোধে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসলামের শিক্ষা সমূহ।
বর্ণনা
১। অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ ক্ষয়প্রাপ্তি। জীবন থেকে যখন কিছু মূল্যবোধ যেমন সততা, নিষ্ঠা, ধৈর্য্য, উদারতা, কর্তব্য পরায়ণতা , শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায় , নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশ-প্রেম, কল্যাণবোধ ,পারস্পরিক মমত্ববোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী লোপ পায় বা বিনষ্ট হয়ে যায় তাকেই বলে নৈতিক অবক্ষয়।
২। অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরলে দেখা যাবে; ধর্মহীনতা, বিকৃত ইতিহাস ,উগ্র জাতীয়তা ,ভারসাম্যহীন অর্থনীতি , অশ্লীল চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, সোসালমিডিয়া, পত্রপত্রিকা, অশিক্ষা কুশিক্ষা , অনৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা, অস্থির শিক্ষাঙ্গন, খারাপ সংঙ্গ, সন্ত্রাসী মনোভাব, নেশাগ্রস্ততা , মেধাহীন রাজনীতি, অন্যায় উচ্চাভিলাষ, সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়ার প্রভাব, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, অসমর্থিত যৌনাচার সহ আরো অনেক রকম ক্ষমার অযোগ্য বিষয়াদি নিহিত।
৩। অবক্ষয় রোধে রাসূলের সাঃ শিক্ষাঃ সৃষ্টির সেরা মানব ও মানব মুক্তির একমাত্র রোল মডেল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম কে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিয়ে স্বীকৃতি দিয়েছেন, “হে রাসুল আপনি বলুনঃ ওহে মানবজাতি! আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসুল সাঃ এবং আমি আপনাকে মানবের কাছে সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছি। (৩৪:২৮)
নৈতিক অবক্ষয় রোধে মহানবী সাঃ অর কতিপয় এক্সক্লুসিভ শিক্ষাঃ— এ প্রসঙ্গে “স্যার আরনল্ড টয়েনবির” উদ্ধৃতিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর “সিভিলাইজেশন অন ট্রায়াল” গ্রন্হে লিখেছেনঃ মোহাম্মদ সাঃ ইসলামের মাধ্যমে মানুষের বর্ণ-গোত্র, বংশ ও শ্রেণিগত বিশিষ্টতা সম্পূর্ণরূপে খতম করে দিয়েছেন। কোন ধর্মই এর চেয়ে বড় সাফল্য লাভ করতে পারে নি, যে সাফল্য মহানবী সাঃ এর ভাগ্যে জুটেছে। বিষয়গুলো নিম্নরূপঃ
ক. শ্রমিকের অধিকার রক্ষার্থে রাসুল সাঃবলেছেন ,তোমরা শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।
খ. ভিক্ষাবৃত্তির উচ্ছেদ সাধনে তিনি বলেছেন, “বনে গিয়ে কাঠ আহরণ করা এবং তা বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করা ভিক্ষা করার চেয়ে উত্তম।
গ. বেকার সমস্যার সমাধানে বলেছেন , “ফরজ এবাদত শেষ হলে হালাল রুজির অন্বেষণ করাও ফরজ।
ঘ . এতিমের মালে হস্তক্ষেপ না করার জন্য জোর তাগিদ দিয়ে বলেছেন, “উত্তম পন্থা ছাড়া এতিমের মাল সম্পদের কাছেও যেও না, যতদিন না তারা বয়োঃপ্রাপ্ত হয় (সূরা বনী ইসরাঈল ৩৪)
ঙ. অসহায় দুর্বলদের প্রতি ভালো ও নম্র ব্যবহার দ্বারা জান্নাত লাভ ও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
চ. বিধবাদের প্রতি সদয় আচরণ স্বরূপ তিনি বলেছেন, “যারা বিধবা নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয় তারা যেন আল্লাহর পথে জিহাদকারী নিরলস নামাজী ও সদা রোজা পালনকারী।
ছ. তালাকপ্রাপ্তাদের স্বাধীনতার ব্যাপারেও ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, “তোমরা যখন স্ত্রীদের তালাক দেবে, তারপর তারা যখন ইদ্দত পূর্ণ করার কাছাকাছি পৌঁছবে তখন হয় ন্যায়সঙ্গত ভাবে তাদের রেখে দাও , নয়তো ন্যায় সঙ্গতভাবে মুক্ত করে দাও। কিন্তু ক্ষতি করা ও কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদেরে আটকে রেখো না। এমনটি করলে সেটি হবে তোমাদের সীমা লঙ্ঘন। (সূরা বাকারা ২৩১)
জ. মিসকিন ও মুসাফিরদের প্রতি দানের হাত বাড়িয়ে দিতে নবী সাঃ সূরা বনী ইসরাঈল থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেনঃ “আত্মীয় স্বজনকে তাদের হক প্রদান করবে এবং মিসকিন ও পথিকদেরও। কিছুতেই অপব্যয় করবে না।(২৬)
ঝ. ঋণগ্রস্তদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের ব্যাপারে রাসুলসাঃ বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন অভাবী ঋনগ্রস্তকে অবকাশ দিবে, তার বিনিময়ে প্রতিদিন সে সদাকার সওয়াব পাবে।
ঞ. রক্তপাত না করার প্রসঙ্গে বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন , জাহিলী যুগের সমস্ত রক্তের বদলা বাতিল করে দেয়া হলো। সর্ব প্রথম আমি নিজ খানদানের রক্তশোধ বাতিল করে দিলাম বলে তিনি ঘোষণা দেন।
ট. মজুদ দারীর মতো ঘৃণ্য ব্যবস্থার বিরোধিতা করে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি মূল্য বৃদ্ধির জন্য খাদ্যবস্তু জমা করে রাখে সে পাপী।
ঠ. ওজনের স্বচ্ছতা রাখতে তিনি আল-কোরআনের আয়াত শোনান; “যারা মাপে, ওজনে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। মানুষের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় দাবি করে, কিন্তু মেপে দেওয়ার সময় প্রতারণামূলক কম করে দেয়। এরা কি ভাবে না যে, এদেরকে পূনরায় উঠিয়ে আনা হবে!” (৮৩:১-৪)
ড. অমুসলিমদের প্রতি দয়া,ক্ষমা, মহানুভবতা ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন জ্বলন্ত উদাহরণ! মনীষী মূর বলেন, “যে সকল মানুষ এত কাল তাঁকে ঘৃণা ও বর্জন করে এসেছে তাদের প্রতিও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর উদারতা ও ক্ষমাশীলতা প্রসংশনীয়।
ঢ. জীবে দয়া— এ ক্ষেত্রে রোগীরা সেবা থেকে সব ধরনের জীবজন্তুর প্রতি তার যত্ন, মমত্ববোধ, সহনশীলতা, কর্তব্য পরায়ণতা এক অনুপমও নৈতিক শিক্ষার মাইলফলক!
ণ. ঝগড়া ফ্যাসাদ এড়ানোর কৌশলগত পদক্ষেপ মহানবী সাল্লাল্লাহু সালামের এক মহান শিক্ষা। ঐতিহাসিক “হুদায়বিয়ার সন্ধি” “গ্রহণ হচ্ছে এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ যা আল কোরআনে বিবৃত হয়েছে এভাবেঃ” “নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে দিয়েছি এক সুস্পষ্ট বিজয়। (সূরা ফাতাহ : ০১)
ত. মুয়াখাত প্রতিষ্ঠার শিক্ষা ছিল তাঁর গভীর ধীশক্তি ও দূরদর্শীতার পরিচয়। মহা নবী সাঃ একটি শান্তিপূর্ণ ও মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে প্রচার করেন, “মুমিনরাতো ভাই ভাই” (সূরা হুজুরাত ১০) তিনি আরো বলেছেন, “মুমিন যেন একে অপরের ভুলত্রুটিকে ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখে আর দুর্দিন পাশে থাকে।— এ আহব্বানেই তিনি মদিনায় রাষ্ট্রপত্তন কালে কতিপয় আনসার মুহাজিরের মধ্যে মুয়াখাত’ প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে ভাতৃত্ব বন্ধনের এক অনুপম নিদর্শন রেখে গেছেন।
মূলতঃ আজকের বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে তাকালে ব্যক্তি জীবন, সামাজিক ,রাজনৈতিক তথা আন্তর্জাতিক অঙ্গন সর্বত্রই সংঘাত মুখর ও উত্তাল বিশৃঙ্খলা ময় হতাশার যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তা রাসুলের সাঃ এর সে যুগেও যে বিদ্যমান ছিল না তা নয়! বরং তা ছিল ভিন্ন রূপে ভিন্ন আঙ্গিকে। কিন্তু মাত্র ২৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনে তিনি তার মোড় ঘুরিয়ে যে আদর্শ ও শিক্ষার মাধ্যমে গোটা সমাজকে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন সেই আদর্শই আজকের নৈতিক অবক্ষয় রোধের একমাত্র হাতিয়ার।
তাইতো প্রফেসর সাধুটি বাস্বনীর সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে হয়ঃ “দুনিয়ার অন্যতম মহান বীর হিসেবে মহাম্মদ সাঃ কে অভিবাদন জানাই। মোহাম্মদ এক বিশ্বশক্তি মানবজাতির উন্নয়নে এক মহানুভাব শক্তি।