মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্
আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি, যাতে মানবজাতিকে উত্তম চরিত্রের শিক্ষা প্রদান করতে পারি। -আল হাদিস।
শিক্ষামানবতার চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যম, আত্মোপলব্ধির চাবিকাঠি। আত্মবিকাশ ও সুকোমলবৃত্তির পরিস্ফুটন ও জীবনের সকল সমস্যার দিক নির্দেশক। মানব জাতিকে নৈতিক শিক্ষার পবিত্র স্পর্শে একটি সুসভ্য ও সুশীল মানবিক গুণসম্পন্ন জাতিতে পরিণত করতে যে মহামানব বিশ্বমানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষকরূপে ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি আরবের নবী করুণার ছবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)।
সমগ্র বিশ্ব যখন অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এমন সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও মানবিক সৌন্দর্যবোধের কলাকৌশল অর্জনকে ব্যক্তির জন্য অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেন। মহান আল্লাহ্ তাঁকে ওহীর জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে মানুষের লক্ষ কোটি বছরের অজানা রহস্যের সমাধান প্রদান করেন। তাঁর মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার উন্মোচিত হয়। ইসলামের সূচনা তাই পঠন-পাঠনের মাধ্যমে। প্রথম নাজিলকৃত ওহী তার বাস্তব প্রমাণ:
পড়ুন হে নবী! আপনার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাটরক্ত হতে। পড়ুন এবং আপনার রব বড়ই অনুগ্রহশীল, যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন, যা সে জানত না। Ñআল কুরআন।
সুশিক্ষিত জাতি গঠনের লক্ষে মহানবী ঘোষণা করেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয। ঘোষণা করেন, “দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন কর।” হে মানুষ! জেনে নাও, আমি তোমাদেরকে উত্তম চরিত্র অর্জনের শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ্র পক্ষ হতে এ পৃথিবীতে শিক্ষকরূপেই প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহ্ আমাকে এজন্য পাঠিয়েছেন যে, আমি যেন তোমাদেরকে তাওহীদ শিক্ষা দিতে পারি। আমি যেন মানুষের উপর মানুষের কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব ও জুলুমের অবসান ঘটিয়ে মানবতার মুক্তি নিশ্চিত করতে পারি। আর তাজকিয়ায়ে নফ্স তথা মানুষের অন্তরের কলুষ-কালিমা দূরিভুত করে প্রতিটি মানুষকে ইনসানে কামিলরূপে গড়ে তুলতে পারি।
মহানবী (সা.) নবুওয়তের সূচনায় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কাজ নিজ গৃহ হতে আরম্ভ করেন। প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.) কে ইহকাল ও পরকালের মুক্তির শিক্ষা প্রদান করেন। তারপর পালিত পুত্র যায়েদ ইবনে হারিসা, চাচাত ভাই কিশোর আলী ও বন্ধু আবু বকর (রা.) কে সর্বজনিন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জগতবাসীর জন্য সুযোগ্য নাগরিক ও শ্রেষ্ঠ প্রশাসকরূপে গড়ে তোলেন।
চরম প্রতিকূলতা ও কাফেরদের অব্যাহত ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় মানবতার নবী অতি গোপনে সাফা পর্বতের পাদদেশে সাহাবী হযরত আরকাম ইবনে আবিল আরকাম (রা.)-এর গৃহে এক ঐশী শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করেন। ‘দারুল আরকাম’ নামে খ্যাত এ শিক্ষা কেন্দ্রে নওমুসলিমগণ আল্লাহ্র নবীর সান্নিধ্যে আসতেন। মদীনা হতে, সুদূর ইথোপিয়ায় গমনাগমনকারী সাহাবীগণ অতি গোপনে নবীজীর নূরানী শিক্ষায় আলোকিত হতেন। একদিন এ গোপন শিক্ষাকেন্দ্রে প্রশিক্ষণকালীন নিজের ভুল ও আমিত্ব ত্যাগ করে মহানবী (সা.)-এর পদতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ বীর ও মর্যাদাবান পুরুষ হযরত ওমর (রা.)।
‘মানব মুকুট’ এর প্রখ্যাত লেখক মুহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী তাঁর গ্রন্থের প্রস্তাবনায় লিখেছেন, “যে সব মহানপুরুষের আবির্ভাবে এই পাপ-পঙ্কিল পৃথিবী ধন্য হয়েছে, যাদের প্রেমের অমৃত সেচনে দুঃখ-তপ্ত মানবচিত্ত স্নিগ্ধ হয়েছে, যারা মানব সমাজের যুগ-যুগান্তরের কুক্ষিগত কালিমার মধ্য হতে প্রভাত সূর্যের মতো উত্থিত হয়ে পাপের কুহক ভেঙ্গেছেন, ধর্মের নবীন কিরণ জ্বালিয়েছেন ও পতিত মানবকে সত্য ও প্রেমে সঞ্জীবিত করে নবজীবন লাভের পথে টেনে এনেছেন, ইসলাম ধর্মের প্রচার ও পরিপূর্ণতা দানকারী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, (তিনি বলেন) “আমি জনাব চৌধুরীর সাথে একমত হয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে শুধু এটুকু সংযোজন করতে চাইÑ হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বিশ্বমানবের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়ক।”
পরশ পাথরের সংশস্পর্শে এসে পরিত্যক্ত মাটির ঢেলা যেমন খাঁটি সোনায় পরিণত হয় ঠিক তেমনি আল্লাহ্র নবীর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মানুষগণ এক একটি উজ্জ্বল প্রদীপের মত জগতকে আলোকজ্জ্বল করেছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে আজমায়ীন, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, ইমামে আজমায়ীন ও যুগে যুগে আগত নবীর ওয়ারেস আলেম-ওলামা, হক্কানী পীর-মাশায়েখগণ মসজিদে নববী বিশ্ববিদ্যালয়ের আসহাবে সুফ্ফার এক একজন প্রতিনিধি। এঁরা মহানবীর শিক্ষা ও আদর্শকে বুকে ধারণ করে পৃথিবীর রূপ বদলে দিয়েছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শাসন-প্রশাসনে, ইন্সাফ ও আদলে, আর্তমানবতার কল্যাণে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও মহানবির সুন্নাহ্ ছিল তাঁদের প্রাতঃস্মরণীয়। তাঁরা এ দু’টিকে ধারণ করেছিলেন ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির বাহনরূপে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “আমি জ্ঞানের নগরী আলী তার দ্বার।” আধ্যাত্মিক জ্ঞানসাধক মহাবীর আলী (রা.)-এর বিদ্যা শিক্ষার প্রসার ও প্রচারণা নবীজীর জ্ঞান নগরীতে প্রবেশের সিঁড়ি। নবীগৃহ ছিল আর এক শিক্ষাকেন্দ্র। জান্নাতে নারীকুলের সর্দার নবীকন্যা মহিয়সী ফাতেমা (রা.) তাঁদের পুত্র হযরত হাসান ও হোসাইন (রা.) তাঁর শিক্ষা মিশনকে এগিয়ে নেন। উম্মাহাতুল মুমিনীনের প্রত্যেকেই ছিলেন অসামান্য বিদুষী। মা আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) সর্বাধিক হাদিস বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হননি দীর্ঘ হায়াতে জিন্দেগীর প্রতিটি মুহূর্ত কুরআন ও সুন্নাহ্র প্রচার-প্রসারে ব্যয় করেছেন।
প্রফেসর ড. কাজী দীন মুহম্মদের মতে, “নবীজির গোটা জিন্দেগী মানবতার জন্য আদর্শ পাঠ। যে কেউ তা থেকে শিক্ষা নিয়ে উপকৃত হতে পারেন। তিনি নীতিকথা প্রচার করেই ক্ষান্ত হননি, নৈতিকতা ও উচ্চ আদর্শ তার অস্থিমজ্জার সাথে একেবারে মিশে গিয়েছিল। কোন শ্রমের কাজকে তিনি হেয় মনে করতেন না। কাপড় সেলাই, জুতা সেলাই, ঝাড়ু দেয়া, মেষ চরাণ, জ্বালানী কাষ্ঠ কুড়িয়ে আনা, রন্ধন, পরিখা খনন প্রভৃতি কোন কাজ করতে তিনি দ্বিধা করতেন না।”
শিক্ষা ও গবেষণাকে মহানবী আবেদের একটানা ইবাদত বন্দেগীর চাইতে উত্তম মনে করতেন। মসজিদে নববীতে যখন সাহাবীদের দু’দলের অধিকাংশ যিকির আযকার ও কিছু সংখ্যক জ্ঞান বিজ্ঞানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন, তখন নবীজি জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচকদের পাশে বসলেন। তিনি ঘোষণা করলেনÑ “একঘণ্টা চিন্তা-গবেষণা করা সারা রাত্রি জেগে ইবাদত বন্দেগীর চাইতে উত্তম।”
এ মহামূল্যবান শিক্ষার আলোকে নবী পরবর্তী যুগে মুসলিম জনপদে শিক্ষা বিপ্লব সূচিত হয়। মদীনা, মক্কা, দামেস্ক, বাগদাদ, কুফা, সমরখন্দ-বোখারা, কায়রো, বসরা, শিরাজ, ইস্পাহান, ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা, কর্ডোভা, গ্রানাডা এবং সুদূর দিল্লী পর্যন্ত শিক্ষা, গবেষণা ও নব নব আবিষ্কার সারা বিশ্বে মুসলমানদের মুখ উজ্জ্বল করে।
এই হলো মানবতার মহান শিক্ষক হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুদূর প্রসারী ফল। প্রতিটি মসজিদ এক একটি বিদ্যালয়। কুরআন হাদিস শিক্ষাকেন্দ্র। প্রতিজন ইমাম-মুয়াজ্জিন এক একজন মুয়াল্লিম, মুবাল্লিগ ও মুহাদ্দিস।
কী গৃহে, কী মসজিদে, কী পথ চলার কাফেলায়, কী রণাঙ্গনে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মহানবী (সা.) এর শিক্ষার শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ বিদ্যমান।
আজও কেউ যদি তাঁর শিক্ষার আদর্শকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যায় তবে তিনি সাফল্যের স্বর্ণশিখরে উপনীত হতে পারবেন। মহানবী জগতের সকল শিক্ষকের শিক্ষক। তাঁর জীবনই এ সত্যের একমাত্র সাক্ষ্য। পরবর্তী প্রজন্মে, যুগে যুগে তা বিকশিত ও প্রসারিত হয়েছে।
হারা সম্বিত ফিরে দিতে বুকে তুমি আনো প্রিয় আবহায়াত
জানি ‘সিরাজাম-মুনিরা’ তোমার রশ্মিতে জাগে কোটি প্রভাত
তব বিদ্যুৎকণা-স্ফুলিঙ্গে লুকানো রয়েছে লক্ষ দিন,
তোমার আলোয় জাগে সিদ্দিক, জিননুরাইন, আলী নবীন
ঘুম ভেঙ্গে যায় আল ফারুকের হেরি ও প্রভাত জ্যোতিষ্মান
মুক্ত উদার আলোকে তোমার অগণন শিখা পায় যে প্রাণ।
তোমার পথের প্রতি বালুকায় এখনো উদার আমন্ত্রণ,
ঘাসের শিয়রে সবুজের ছোপ জাগায়ে স্বপ্ন দেখিছে বন।
তব শাহাদাত আঙ্গুলি আজও ফেরদৌসের ইশারা করে
নিখিল ব্যথিত ‘উম্মত লাগি’ এখনো তোমার অশ্রু ঝরে।
তোমার রওজা মুবারক আজও সেই খুশবুর বইছে বান,
চামেলির ঘ্রাণ, অশ্রুর বান এখনো সেখানে অনির্বাণ।
চলছে ধ্যানের জ্ঞান-শিখা বয়ে জিলানের বীর, চিশতী বীর
রংগিন করি মাটির সুরাহি নক্শবন্দের নয়নে নীর,
জ্ঞানের প্রেমের নিশান তুলেছে হাজার সালের মুজাদ্দিদ
রায়বেরেলির জঙ্গী দিলীর ভেঙেছে লক্ষ রাতের নিদ
ওরা গেছে বহি তোমার নিশান রেখে গেছে পথে সেই নিশানি,
তবু সে চলার শেষ নাই আর কোন দিন শেষ হবে না জানি।
লাখো শামাদান জ¦লে অফুরান রাত্রি তোমার রশ্মি স্মরি
সে আলো বিভায় মুখ তুলে চায় প্রাণ পিপাসায় এ শর্বরী।
তাদের সঙ্গে সালাম জানাই হে মানবতার শাহানশাহ্
হে নবী! সালাম : সাল্লাল্লাহু আলাইকা ইয়া রাসূলল্লাহ।’
[সিরাজাম মুনিরা ॥ ফররুখ আহমদ]