ড. সাইয়েদ মুজতবা আহমাদ খান
এ বিশ্বের বুকে যুগে যুগে, কালে কালে বহু মনীষী মহামানবের আর্বিভাব ঘটেছে। যারা তাদের অসাধারণ মেধা ও ধী-শক্তি ব্যবহার করে বিশ্ববাসিকে নানারকম আদর্শ বা মতবাদ উপহার দিয়ে ধন্য করেছেন। এসব মহান মনীষীদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের মনীষীগণের সংখ্যাই সর্বাধিক। যাদেরকে নবী বা রাসুল হিসেবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে ধরার সুপথহারা বিভ্রান্ত মানুষকে রাব্বুল আলামীনের প্রেরিত ঐশী গ্রন্থের মাধ্যমে আলোকিত করবার জন্যে ধরাধামে পাঠিয়েছেন। তবে এদের মধ্যে একমাত্র রাসূলে আকরাম (সা.) ব্যতীত সকলেই ছিলেন তাদের সগোত্র বা সজাতির জন্যে নির্দিষ্ট নবী বা রাসূল। নির্দিষ্ট অঞ্চল বা সীমিত সংখ্যক মানুষ ও গোত্রের জন্য এরা প্রেরিত হয়েছেন মাত্র। কিন্তু এক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হিসেবে একমাত্র রাসুলে আকরাম (সা.) ই হচ্ছেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তাকে পরিপূর্ণ একটি ঐশী গ্রন্থ দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে ধীরে ধীরে অবর্তীর্ণ করেছেন- কিন্তু অন্য নবী রাসুলদের নিকট ধীরে ধীরে নয় বরং একসঙ্গে এক ভারেই ছহিফা বা আসমানি গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন। এদিক দিয়ে রাসূলে আকরাম (সা.) সর্বদিক দিয়েই সকলের চে’ ব্যতিক্রমী পদ্ধতির মহান কারিগর। কেনোনা তিনিই কুরআনুল কারিমের প্রতিটা নির্দেশ বাস্তবায়ন করে সমাজ-রাষ্ট্রে শৃক্সক্ষলা ফিরিয়ে আনেন। তিনি তাঁর আনিত ইসলামী আদর্শের মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়ে মানব জীবনকে ঐশী আদর্শের বাগডোরে গ্রথিত করে জগৎবাসিকে হাতে কলমে দেখিয়ে চমকিত করেন। যার দৃষ্টান্ত অতীতকালে শুধু নয় সর্ব কালেই দুর্লভ ।
এক্ষেত্রে জগতের অন্যান্য মনীষী, যারা ঐশ্বরিক গ্রন্থের ধারক বাহক নন- তাদের মধ্যে বহু জনকেই দেখতে পাওয়া যায়। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের বিপুল জ্ঞান গরিমার অধিকারী মনীষীবৃন্দ বহু ধরনের মতদর্শে প্রকাশ করে জগতে বিপুল খ্যাতির অধিকারী হয়েছেন- বহু সংখ্যক গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে অমর হয়েছেন। পৃথিবী বাসিকে চমকিত করেছেন। কিন্তু এদের মধ্যে অনেককেই পাওয়া দুলর্ভ যারা তাদের বর্ণিত আদর্শের মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়েছেন বরং তারা থিউরি দিয়েই খালাস। হৃদয় মনের আশা আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটিয়ে নিস্কৃতি খুজেঁছেন। কিন্তু তারা তাদের সেই সব আদর্শের আলোকে দেশ জাতি বা রাষ্ট্রের মেরামতের কোনো কর্মটিই বাস্তবায়িত করে যেতে সক্ষম হননি ।
দৃষ্টান্ত হিসেবে বর্তমান জগতের সর্বাধিক পরিচিতি ‘সমাজতন্ত্র’ বা “সাম্যবাদের” স্রষ্টা জার্মান ইহুদী বংশোদ্ভুত মি: কার্লমার্কস লন্ডনে বসে “ডাস ক্যাপিটা” এবং “মেনুফেষ্ট অব কম্যুনিষ্ট পার্টি ” লিখে রেখে পরলোকে গমন করেন । কিন্তু কথিত “সাম্যবাদ” বা “সমাজতন্ত্র” যে কি জিনিস বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখার সুযোগই পেলেন না অথচ তার থিউরির একনিষ্ঠ অনুসরণকারী সোভিয়েত রাশিয়ার ভেলাদিমির ইলিচ লেনিন এবং চীনের মাও সেতুং রা তার মতাদর্শের সফল বাস্তবায়নকারীগণ সোভিয়েত রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব এবং চীনে সাংস্কৃতিক বিল্পব সংঘটিত করেন। এ জন্যে একদেশে বিশ লক্ষ এবং অন্যদেশে বাইশ লক্ষ মানুষ নিহত হন। এ পর্যন্ত সারাবিশ্বের বহু দেশে তার মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বমোট দশ কোটি মানুষ হত্যার শিকার হন। কিন্তু তারপরে ও বেশ কটি দেশে প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্র নামক দানবীয় ব্যবস্থা-মানুষের প্রকৃতি বিরোধী কার্লমাকসের সাম্যবাদ মূল্যেৎপাটিত হয়েছে। ঐসব দেশে কার্লমার্কসের শিষ্যরা চরম লাঞ্চনার শিকারে পরিণত হয়ে তাদের ষ্টাচু ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হলো যে, থিউরি দেয়া এক জিনিস আর তা জীবনে সমাজে-রাষ্ট্রে বাস্তবায়ন করা অন্য জিনিস। কিন্তু ইসলামী আদর্শ বা কুরআনুল কারিমের অলৌকিক আদর্শের মূর্ত প্রতীক হয়ে সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ মহা মানব রাসূলে আকরাম (সা.) জগৎবাসিকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে-কাকে বলে আদর্শের মহত্তম সুমহান মূর্ত প্রতীক! তিনি তাঁর বাস্তব জীবনে প্রাত্যহিক জীবনে কুরআনুল কারীমের আদর্শের শুধু উচ্চারণ করেই ক্ষ্যন্ত হননি। বরং তাঁর মহান জীবনের পরতে পরতে তা সফল ভাবে নিখুত ভাবে বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। যার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত এ বিশ্বে বিরল ।
আমাদের সমাজ সংসারে ইদানিং কালেই শুধু নয় সর্বসময়েই বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন দেশের মনীষীদের কথা ও কর্মের উল্লেখ করা হয়। ফলাউ করে তাদের জীবন ও আদর্শের কথা তুলে ধরা হয়। তাদের মতাদর্শ গ্রহণ ও অনুসরণের উদাত্ত আহ্বানও জানানো হয়। কিন্তু গভীরভাবে ভেবে দেখা হয় না। যাদের কথা উপস্থাপন করা হয় তাদের জীবন কেমন ছিলো তারা কোথা থেকে তাদের মতাদর্শ গ্রহণ করেছেন। সেসব কি কল্পিত-নাকি নিজ মস্তিষ্ক পোষিত? সেই মতাদর্শগুলোর উৎস কি? কে দিলো তাদেরকে জীবন চালানোর দেশ ও জাতি পরিচালনার নিয়ম নীতি এসব ভাবনার বিশেষ প্রয়োজন, নচেৎ হোঁচট খাওয়ার, বিভ্রান্ত হওয়ার, পথভ্রষ্ট হওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে ষোলআনা ।
সুতরাং সদা সতর্ক থাকা বিশেষভাবে আবশ্যক। যেমন কার্লমাকর্স, প্লেট্রো, এরিষ্টটেল, চালর্স ডারউইন, মেকীয়াভেলী, হেগেল, সিগমুন্ড ফ্রয়েন্ড, সাহেবদের খপপড়ে পড়ে জীবন ধ্বংসের কারণ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। ঐশী আদর্শ ব্যতীত মানুষ রুপী বানরদের থিউরি গ্রহণ করলে আম ও যাবে এবং ছালাও যাবে, যাওয়ার আশংকা শতভাগ।
অতএব সমগ্র বিশ্বের যিনি মহামানব, যার নেতৃত্বে বিশ্বের একমাত্র রক্তপাতহীন সফল মহা বিল্পব সাধিত হয়েছিলো, তাঁর আদর্শ ব্যতীত তাঁর আনিত ঐশী আদর্শ ছাড়া মানব জাতির জন্যে দ্বিতীয় কোনো মতবাদ বা আদর্শ গ্রহণ মর্মান্তিক আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কিছু নয়। বর্তমান বিশ্বের যে তাল-মাতাল অবস্থা তা দেখে তাঁকে একমাত্র অনুসরণীয় নেতা গ্রহণ ব্যতীত গোটা মানব জাতির সামনে আর কোনো গত্যন্তর নেই বললেই চলে ।
আমরা তো জানি রাসূলে আকরাম (সা:) অন্ধকারময় আরবের মর্মান্তিক অবস্থার ভয়াবহ চিত্র অবলোকন করলেন। তদানিন্তন তরুণ যুবসমাজের চরমতম অধঃপতন দেখে তিনি শিউরে উঠলেন এবং তরুণ সমাজকে উদ্ধার করবার একটা পথ খুঁজলেন একটা যুবসংগঠন গঠন করেলেন “হিলফুল ফুজুল” নাম নির্ধারণ করেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে সক্ষম হলেন যে যুবকদের শুধু নয় পুরো মানব সমাজের সংকট সমাধানের জন্যে মানুষের মস্তিষ্ক প্রস্তুত মানুষের কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কেনোনা মানুষের যিনি খালেক মালেক তিনিইতো জ্ঞাত যে কোন্ সমস্যার সমাধান কোথায়। বর্তমান-তাই মানব জাতিকে পরিচালনার জন্যে তাঁর প্রত্যাদেশ অবশই আবশ্যক ।
কুরআনুল কারিমের ভাষ্য :
তিনিই উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাদের মধ্যে হতে যিনি তাদের নিকট আবৃত্তি করেন তাঁর আয়াতসমূহ। তাদেরকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত । ইতোপূর্বে তো তারা ছিলো ঘোর বিভ্রান্তিতে। কুরআনুল কারিমের এসব নির্দেশ ও বিধি বিধান দ্বারা তিনি নিজে সজ্জিত হলেন নিজে আলোকিত হলেন। নিজের বাস্তব জীবনে প্রাত্যাহিক কর্মে ঐ সব নিয়মনীতি সফলভাবে অনুসরণ করলেন এবং তাঁর অনুসারী সঙ্গী সাথীদেরকে সেসব প্রতিপালনের প্রত্যক্ষ নির্দেশ দান করেন ।
ইতিহাসের প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে যে রাসূলে আকরাম (সা.) তার আনিত ঐশী আদর্শ শুধু তার নিজ জীবনেই নয় তদানীন্তন সমগ্র আরবে সফলভাবে বাস্তবায়ন করে বিশ্বের বুকে চমক সৃষ্টি করেন। তাঁর যারা প্রকৃত অনুসরণকারী সাহাবী ছিলেন তারা যে ভাবে তাঁর আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন-তাদের জীবনে যে ভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়ন করে ছিলেন তার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত দুনিয়ার অন্য কোন দেশ ও জাতির মধ্যে আজও দৃষ্টি গোচর হয় না ।
রাসূলে আকরাম (সা.) এর সাহাবীগণ দুনিয়ার যে দেশে যে অঞ্চলে গিয়েছিলেন সে দেশ ও অঞ্চলকে রাসূলে আকরামের (সা.) আদর্শের আলোকে আলোকিত করে অসভ্য ও অমার্জিত মানুষ জনকে সুসভ্য ও মার্জিত জনে রুপান্তরিত করতে সক্ষম হন। আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশেও তারা এসেছিলেন এবং বাংলার পথহারা মানুষকে সোনালী পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। এমন এরুপ ধারা আজো পরিলক্ষিত হয় বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে- সভ্যতার আলোক বঞ্চিত জনগোষ্ঠী এখনো রাসূলে আকরাম ( সা: ) এর রেখে যাওয়া আদর্শের আলোকে আলোকিত হয়ে জীবনকে সার্থক ও সফল করছে। এসবের ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ।
সুতরাং আজ সময় এসেছে। সমগ্র বিশ্বের সকল দেশ ও জাতি সেই মহা মানবের আদর্শের ছায়াতলে সকলকে সমবেত হতে হবে। নইলে ধ্বংস ও বিনাশের হাত থেকে কেউই রক্ষা পাবে না। না প্রাচ্য না পাশ্চাত্য কারোরই নিস্তার মিলবে না। হেরার রাজতোরণের শরণাপন্ন না হলে গোটা বিশ্ব ধ্বংসস্তুপ পরিণত হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার।