মোহাম্মদ জাকারিয়া মোমেন

মানব জীবনের সকল স্তরই অতিক্রান্ত হয়েছে প্রিয় নবী সা. এর জীবনে। শৈশব ও কৈশোর তা থেকে আলাদা নয়। মানুষের শৈশব জীবনের সর্বোত্তম উদাহরণ রয়েছে রাসুল সা. এর জীবনে। তিনি এতিম ছিলেন। এ জন্যই বুঝি সকল অনাথ-এতিম, অভাবী-বঞ্চিত, দুঃখী-দরিদ্র, ভূখা-নাঙ্গা, গৃহহারা-সর্বহারা মানুষের আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো। যা দেখলে একদিকে যেমন চোখ জুড়িয়ে যায়; অন্যদিকে তেমনি এর ঘ্রাণও যেন মন ভরিয়ে দেয়। তিনি এমন এক সময় এ ধরাধামে আগমন করলেন যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত মানবতা যেন মুক্তির নেশায় কাতরাচ্ছিল। অমানিশার আধার কেটে যেন পূর্বদিগন্তে সূর্র্যালোকের প্রতিক্ষায় প্রতিক্ষামান। এমন এক মহাকালের যুগ সন্ধিক্ষণে মা আমিনার প্রসব বেদনার কোন এক মুহূর্তে চিৎকার দিয়ে জানান দিলেন-তিনি এসে গেছেন। এবার পৃথিবী শান্ত হবে, মানবতার মুক্তি হবে, মাজলুমানের ক্রন্দন রোল আকাশ বাতাস বিষায়িত করবে না, অত্যাচারীর অস্ত্রের ঝনঝনানীতে শোষিতের কন্ঠরোধ হবে না। মহানবী সা. শিশুদের জন্য ছিলেন কোমল, প্রশস্তচিত্তের। হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন: “রাসুল সা. ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের মানব এবং সবার চেয়ে প্রশস্তচিত্তের অধিকারী। তিনি একদিন আমাকে কোন এক কাজে পাঠালেন। আমি বের হয়ে দেখি শিশুরা মাঠে খেলছে। তাদের খেলাধুলা দেখে আমিও তাদের সঙ্গে খেলাধুলা শুরু করে দিলাম। সহসা আমি অনুভব করলাম, কেউ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমার পোশাক স্পর্শ করে হালকা নাড়াচাড়া করছেন। আমি পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম: প্রিয় নবী সা. আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন। তিনি বললেন: “হে উনায়েস (শব্দটি ‘আনাস’ এর ক্ষুদ্ররূপ যা আদর-সোহাগের জন্য সম্বোধনে ব্যবহার করা হয়)! তোমাকে যেখানে যেতে বলেছি সেখানে কি তুমি গিয়েছো?” আমি উত্তর দিলাম, হ্যা এখনি যাবো হে আল্লাহর রাসুল! হযরত আনাস বলেন: আমি দশ বছর যাবত তাঁর সেবা করেছি। এর মাঝে কোন কাজ করলে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে বলেননি, কেন তা করেছো? অথবা, কোন কাজ না করলে তিনি বলেননি, কেন তা করোনি?” এ এক অনন্য উপমা।

অতএব, প্রিয় নবী সা. এর জীবন চরিত্র হলো অথই সাগরের মতো যা থেকে বিশ্ব মানবতা চিরকাল তৃষিত পিপাসা নিবারণ করতে পারে। নিম্নে শিশুদের প্রতি প্রিয় নবী সা. এর আচরণ কেমন ছিল তা নিয়ে আলোকপাত করা হলো:

শিশুদের শিক্ষা দেয়া

প্রিয় নবী সা. যেমন বড়দের শিক্ষা দিতেন, তেমনি ছোটদেরকেও শিক্ষা দিতেন। হযরত আব্বাস রা. বলেন: একদা আমি প্রিয় রাসুল. এর পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় তিনি আমাকে ডেকে বললেন:

“ওহে বাছা! আমি তোমাকে কিছু উপদেশ দেব। আর তা হলো, তুমি আল্লাহর হক (ইবাদত) রক্ষা করবে, তাহলে আল্লাহও তোমাকে রক্ষা করবে। তুমি আল্লাহর হক রক্ষা করো। তবে তুমি বিপদে তাকে (আল্লাহকে) তোমার সাহায্যকারী রূপে পাশে পাবে। আর যখন কিছু চাইবে শুধু আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে একমাত্র আল্লাহর কাছেই করবে।” (তিরমিযি-২৫১৬)

শিশুদের প্রতি স্নেহ

হযরত আমর ইবনে শুয়াইব রা. তার বাবা থেকে, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, প্রিয় নবী সা. বলেন: “যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমাদের কেউ না।” (তিরমিযি, আবু দাউদ)

হযরত আনাস রা. বলেন, “একদা প্রিয় নবী সা. আনসারদের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। আনসারী শিশুরা প্রিয় নবীজি সা. কে চারদিক ঘিরে ধরতো। তিনি শিশুদের সালাম দিতেন, মাথায় হাত বুলাতেন ও তাদের জন্য দোয়া করতেন।” (নাসায়ি-১০০৮৮, মুসনাদে বাযযার-৬৮৭২, শারহু মুশকিলিল আসার-১৫৭৭, সহীহ ইবনে হিববান-৪৫৯)

শিশুদের চুম্বন করা

শিশুদের ভালবেসে আদর করে চুম্বন করা সুন্নাত। তাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা এবং আদর করে কাছে টেনে নেয়া স্বাভাবিক মানবিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ। প্রিয় নবী সা. তাঁর আদরের নাতি হাসান ও হুসাইন রা. কে স্নেহ বাৎসল্যভরে আদর করতেন। তাদের সাথে সখ্য ও আন্তরিকতায় শিশুসুলভ বিনোদনে মেতে উঠতেন।

হযরত আনাস রা. বলেন-

অর্থাৎ, প্রিয় নবী সা. তাঁর আদরের পুত্র ইব্রাহিমকে কোলে নিলেন এবং তার ঘ্রাণ নিলেন। (বুখারী, হাদিস নং ১৩০৩)

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন: একদা প্রিয় নবী সা. হযরত হাসান রা. কে আদর করে চুমু দিলেন। সেখানে হযরত আকরা ইবনে হাবেষ আত-তামিমি রা. উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন: “আমার দশজন সন্তান আছে; আমি তাদের কাউকে কখনো চুমু দেইনি।” প্রিয় নবী সা. তার দিকে তাকালেন আর বললেন: “যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হয় না।” (বুখারী)

এতিম-অনাথদের প্রতি ভালবাসা

শিশুদের আদর সোহাগ করা সুন্নাত। সুন্নাতে নববী অনুসরণে শিশুদের প্রতি স্নেহ মমতা প্রদর্শন করা প্রয়োজন। এ ব্যপারে সতর্ক ও যত্নশীল হওয়া দরকার। আল্লাহ তায়ালা প্রিয় নবী সা. কে এতিমদের প্রতি স্নেহ মমতা প্রদর্শনের ব্যাপারে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন। “আপনি কি এমন ব্যাক্তিকে দেখেছেন, যে দ্বীনকে অস্বীকার করে। সে তো ঐ ব্যক্তি যে এতিমকে নির্দয়ভাবে তাড়িয়ে দেয়।” (সুরা মাউন: আয়াত ১-২)

শিশুদের সালাম দেয়া

মূর্খতা ও অহংকার, বিবেকের দৈন্যতা ও সীমিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেকেই শিশুদের জন্য হৃদয়ের প্রশস্ততা তালাবদ্ধ করে রেখে উদারতাকে হারিয়ে ফেলে। কিন্তু প্রিয় নবী সা. হৃদয়ের সব সংকীর্ণতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে শিশুদের আগে সালাম দিতেন। তাদের মাঝে হৃদ্যতা তৈরি করতেন। ভালবেসে কাছে নিতেন। নির্মল আনন্দ করতেন তাদের সাথে।

“হযরত আনাস রা. শিশুকিশোরদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় সালাম দিতেন। তিনি বলতেন: প্রিয় নবী সা. এরূপ করেছেন।” (বুখারী-৬২৪৭)

শিশুদের জন্য নয়নভরা অশ্রু

প্রিয় নবী সা. তাঁর পুত্র ইব্রাহিমের এন্তেকালে যখন নয়ন দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল তখন হযরত আব্দুর রহমান বিন আউফ বলে উঠলেন: “হে প্রিয় রাসুল সা.! আপনিও কাঁদছেন?” উত্তরে তিনি বললেন:

“ওহে আউফের পুত্র! এটা তো দয়া। অতপর তিনি আবার অশ্রু ঝরালেন। তিনি বললেন: নিশ্চয় চোখের অশ্রু প্রবাহিত হয়, হৃদয় চিন্তিত হয়। আমরা তাই বলবো যা আমাদের রব সন্তুষ্ট হন। তারপর তিনি বললেন: হে ইব্রাহিম! তোমার বিচ্ছেদে আমরা শোকাহত।” (বুখারী-১৩০৩)

হযরত সাহাল ইবনে সাদ রা. বর্ণনা করেন, প্রিয় নবী সা. বলেন:“ আমি ও এতিমের প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে কাছাকাছি অবস্থান করবো। এ কথা বলে তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল দ্বারা ইঙ্গিত করে এ দু’টি আঙ্গুলের মাঝে সামান্য ফাঁক রাখলেন।” (বুখারী)

প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি দয়া

শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে শিশুদের স্নেহ মমতা দেখানো সুন্নাত। তাদের অবজ্ঞা অবহেলা করার সুযোগ নেই। বিশেষ একটি ঘটনায় একজন প্রতিবন্ধী সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. এর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আয়াত নাযিল হয়। একদা প্রিয় নবী সা. কুরাইশ নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় লিপ্ত আছেন। এমতাবস্থায় উক্ত প্রতিবন্ধী সাহাবী সেখানে উপস্থিত হয়ে ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রিয় নবী সা. এর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এতে আলোচনায় ব্যাঘাত হওয়ায় প্রিয় নবী সা. একটু বিরক্তি প্রকাশ করেণ। সে সময় তিনি কুরাইশ নেতাদের মন রক্ষার্থে প্রতিবন্ধী সাহাবীর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারেন নি। অন্তর্যামী মহান আল্লাহর নিকট বিষয়টি পছন্দনীয় হয়নি। আল্লাহ বলে দিলেন: “ সে ভ্রুকুঞ্চিত করলো আর মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ, তার কাছে অন্ধ লোকটি এসেছে। আপনি কিভাবে জানবেন? সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো অথবা, উপদেশ গ্রহণ করতো। ফলে উপদেশ তার কল্যাণে আসতো। পক্ষান্তরে যে বেপরোয়া, আপনি তার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন।” (সুরা আবাসা, আয়াত: ১-৬)

এরপর হতে প্রিয় নবী সা. সব সময় প্রতিবন্ধীদের প্রতি অত্যন্ত ভালবাসা ও মমতা পোষণ করতেন।

শিশুদেরকে জিহ্বার লালিমা দেখিয়ে আনন্দ দেয়া

হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, “প্রিয় রাসুল সা. তাঁর দৌহিত্র হাসান বিন আলীর জন্য জিহ্বা বের করে দিতেন। এতে শিশু হাসান রা. নবীজির জিহ্বার লালিমা দেখে আনন্দ ভোগ করতো।” (সিলসিলাতুস সহিহাহ, হাদিস নং ৭০)

শিশুদের তাহনিক করা

তিনি ছিলেন শিশুদের প্রতি মমতাময়। কোন অপ্রীতিকর কিছু তাদের থেকে প্রকাশ পেলে তিনি সহ্য করতেন। আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. এর নিকট নবজাতক শিশুদের আনা হতো। তিনি তাদের জন্য বরকতের দুয়া করতেন এবং তাহনিক করতেন (খেজুর জাতীয় খাদ্য চিবিয়ে সামান্য একটু শিশুর মুখে দেওয়া)।

“একদিন এক শিশুকে তাহনিক করার জন্য তাঁর কাছে আনা হলো। তিনি শিশুটিকে কোলে বসালেন। কিন্তু শিশুটি তাঁর কোলে প্রস্রাব করে দিল। তখন নবীজি সা. পানি আনিয়ে কাপড়ে ঢেলে দিলেন।” (বুখারী-২২২ ও ৬৩৫৫; মুসলিম-২৮৬; মুসনাদে আহমাদ-২৪২৫৬)

শিশুদের বাহন হয়ে খেলাধুলা করা

প্রিয় নবী সা. হযরত ফাতেমার রা. এর দুই পুত্র হাসান ও হুসাইন রা. এর বাহনে পরিণত হয়ে নিজের পৃষ্ঠ মুবারকে চড়াতেন আনন্দ দেয়ার জন্য। তিনি তাঁর কন্যা যয়নাবের মেয়ে উমামা ও আবি আলআস বিন আররবী রা. এর কন্যাকে বহন করা অবস্থায় সালাত আদায় করতেন। যখন তিনি দাঁড়াতেন তাকে বহন করে দাঁড়াতেন। আর সিজদার সময় নামিয়ে রেখে সিজদা করতেন। হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন:

“প্রিয় নবী সা. উম্মে সালামার ছোট কন্যা যায়নাবকে নিয়ে খেলা করতেন আর বার বার বলতেন: হে যুয়াইনাব! ওহে যুয়াইনাব!” (আহাদিসুস সহীহাহ-২৪১৪, সহীহুল জামে-৫০২৫)

‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন: “এক সফরে প্রিয় নবী সা. মক্কায় আগমন করলে আব্দুল মুত্তালিব গোত্রের শিশুরা এগিয়ে এলো তাঁকে এস্তেকবাল (স্বাগত) জানানোর জন্য। তখন তিনি হযরত আব্বাসের ছেলে কুসাম ও ফযলকে তাঁর সাথে বাহনে উঠিয়ে নিলেন। একজনকে বসালেন তাঁর সামনে, অন্যজনকে বসালেন পেছনে।’ (সহীহ বুখারী-১৭৯৮, ৫৯৬৬)

শিশুদের দিয়ে অতিথিদের স্বাগত জানানো

বর্তমানে দেশে বিদেশে শিশুদেরকে দিয়ে যে রাষ্ট্রীয় অতিথিদেরকে স্বাগত জানানোর যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় তা যেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা. এর নিকট থেকেই ধার করে নেয়া রীতি। আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর রা. বলেন:

“প্রিয় নবী সা. কোন সফর থেকে ফিরে এলে তাঁর পরিবারের শিশুদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য বের করে সামনে আনা হতো। একদা তিনি সফর থেকো ফিরে এলে আমাকে তাঁর নিকট আনা হলো। তিনি আমাকে বাহনে উঠিয়ে সামনে বসালেন। এরপর হাসান রা. অথবা, হুসাইনকে আনা হলে তিনি তাকে তাঁর পেছনে বসালেন। আমরা মদিনায় প্রবেশ করলাম এক বাহনে তিনজন উপবিষ্ট হয়ে।” (সহীহ মুসলিম-২৪২৮, সুনানে আবু দাউদ-২৫৬৬)

“সালামা ইবনে আকওয়া রা. বলেন: প্রিয় নবীজি ও হাসান- হোসাইন রা. তাঁর শাহবা (সাদা) খচ্চরে আরোহণ করলে আমি তা টেনে প্রিয় নবী সা. এর হুজরা পর্যন্ত নিয়ে যাই। তাদের একজন প্রিয় নবী সা. এর সামনে, আরেকজন তাঁর পেছনে উপবিষ্ট ছিলেন।” (সহীহ মুসলিম-২৪২৩; সুনানে তিরমিযি-২৯৮০)

শিশুদের প্রতি মমতা

প্রিয়নবীর সা. দয়া-ভালবাসা শুধু আপন সন্তানের প্রতিই ছিল না বরং তা সকল শিশুদের জন্য ছিল উন্মুক্ত। হযরত জাফর রা. এর স্ত্রী হযরত আসমা বিনতে উমাইস রা. বর্ণনা করেন: “একদা আমার বাড়ীতে প্রিয় নবী সা. আগমন করে জাফরের সন্তানদেরকে ডাকলেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম তিনি তাদেরকে চুমা দিয়ে ঘ্রাণ নিলেন আর তাঁর দু’ নয়ন ঝরে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল। আমি তাকে বললাম: হে আল্লাহর রাসুল! জাফর সম্পর্কে আপনার নিকট কি কোনো সংবাদ এসেছে? তিনি উত্তর দিলেন: “হ্যা, সে তো আজ শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন। তারপর আমরাও কাঁদতে লাগলাম। তিনি চলে গিয়ে বললেন: তোমরা জাফরের রা. পরিবারের জন্য খাবার রান্না করো। কেননা তারা শোকাহত।” (ইবনে সায়াদ, তিরমিযি ও ইবনে মাজাহ)

হযরত জাফরের রা. মৃত্যুতে প্রিয় নবীজি সা. যখন কাঁদছিলেন আর দু’ চোখ বেয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল তখন সায়াদ বিন উবাদাহ রা. তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন: হে প্রিয় রাসুল সা.! আপনি কাঁদছেন? তিনি উত্তর দিলেন:

“এটা তো দয়া। যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের হৃদয়ে তৈরি করে দেন। আর তিনি দয়াশীল বান্দাদেরকেই দয়া করেন।” (বুখারী-১২৮৪)

আদর করে গায়ে হাত বুলানো

শিশুদের সাথে রাসুল সা, সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করতেন। তাঁর কোমল আচরণে শিশু-কিশোরদের আকৃষ্ট করতো। হযরত জাবের ইবনে সামুরাহ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন:

“আমি একদা প্রিয় নবী সা. এর সাথে ফজরের নামায আদায় করলাম। অতপর তিনি বাড়ির দিকে বের হলেন, আমিও তার সাথে বের হলাম। পথিমধ্যে একদল বাচ্চাদের সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনি এক এক করে প্রত্যেকের উভয় গালে মৃদু করে হাত বুলিয়ে দিলেন। অতপর যখন আমার পালা আসলো তিনি আমার উভয় গাল স্পর্শ করে দিয়ে আদর করে দিলেন। আমি তাঁর হস্ত মুবারকে সুগন্ধিযুক্ত আতরের হিম শীতল অনুভুতি অনুভব করলাম। যেন তাঁর হাতে সুগন্ধি ব্যবসায়ীর সামগ্রীর ঘ্রাণ লেগে আছে। (সহিহ মুসলিম-২৩২৯)

শিশু হযরত হোসাইন রা. কে আদর

প্রিয় নবীজি সা. তাঁর দৌহিত্র হযরত হোসাইনকে খুব আদর করতেন। তাকে চুমু দিয়ে কোলে নিতেন। হযরত ইয়ালা ইবনে মুরারা বলেন: “

“কিছু সাহাবী প্রিয় নবী সা. এর সাথে দাওয়াত খেতে বের হলেন। হঠাৎ হযরত হোসাইন রা. কে খেলা করতে দেখা গেল। প্রিয় নবী সা. উপস্থিত লোকজনের সামনে এগিয়ে গিয়ে কোলে নেয়ার জন্য তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। এ দেখে হযরত হোসাইন রা. এদিক ওদিক ছুটাছুটি আরম্ভ করলো। প্রিয়নবী সা. তাকে ধরার জন্য হাসাচ্ছিলেন। অবশেষে ধরে ফেললেন। এরপর নবীজি সা. তাঁর হস্ত মুরারক তার থুতনির নিচে রাখলেন, অপরটি মাথার পেছনে রাখলেন। তারপর তাঁর মাথা মুবারক নিচু করে তার মুখে মুখ রেখে চুমু খেলেন। তিনি বললেন: হোসাইন আমা হতে, আমি হোসাইন হতে। আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে ভালবাসে যে হোসাইন রা. কে ভালবাসে। হোসাইন রা. আমার প্রধান দৌহিত্র।” (সুনানে ইবনে মাজাহ-১৪৪, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা-৩২৮৬০, মুসনাদে আহমাদ-১৭৫৬১, আল আদাবুল মুফরাদ-৩৬৪, সহীহ ইবনে হিববান-৬৯৭১)

শিশুদের প্রতি দয়া ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ কাজ

শিশুদের প্রতি প্রিয় নবী সা. আদর- স্নেহ পরায়ন ছিলেন। তিনি দয়া- কোমলতার আকর। সবাইকে শিশুদের প্রতি দয়া ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণের নির্দেশ দিতেন। তিনি বলেন, “যে আমাদের ছোটদের সাথে কোমল আচরণ করে না এবং বড়দের অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রাখে না, সে আমাদের কেউ না।” (সুনানে আবু দাউদ-৪৯৪৩; জামে তিরমিযি-২০৩২; মুসনাদে আহমাদ-৬৭৩৩)

হযরত আবু হুরায়রাহ রা. বর্ণনা করেন, প্রিয় রাসুল সা. বলেন, “যে ব্যক্তি দয়া করে না তার প্রতিও দয়া করা হবে না।” (সহীহ বুখারী-৫৯৯৭, সহীহ মুসলিম-২৩১৮)

উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক বেদুইন সাহাবী প্রিয় নবী সা. এর নিকট এসে বললেন:

হে আল্লাহর রাসুল সা.! আপনি কি শিশুদের চুমু খান?

উত্তরে প্রিয় নবী সা. বললেন: “হ্যা, চুমু খাই।”

বেদুইন বললেন: “আমরা তো শিশুদের চুমু দেই না।”

একথা শুনে রাসুল সা. বললেন:

“আল্লাহ তায়ালা তোমার দিল থেকে রহম ছিনিয়ে নিলে আমার কি করার আছে?”

(সহীহ বুখারী-৫৯৯৮; সহীহ মুসলিম-২৩১৭; সুনানে ইবনে মাজাহ-৩৬৬৫; মুসনাদে আহমাদ-২৪২৯১)

শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ দেয়া

শিশুমন চঞ্চল। চপলা চপল মন তার সদায় খেলাধূলা করতে ইচ্ছে করে। তাদেরকে খেলাধুলা করতে দিয়ে নির্মল আনন্দের সুযোগ দেয়া নবী সা. এর আর্দশ। প্রিয় নবী সা. এর সাথে যখন হযরত আয়েশা রা. এর সাথে বিয়ে হয় তিনি তখন ছোট ছিলেন। তিনি তার বান্ধবীদের সাথে খেলতেন। তিনি বলেন:

“আমি প্রিয় নবী সা. এর ঘরে খেলনা দিয়ে খেলা করতাম। আমার (মত ছোট ছোট) বান্ধবীরা মিলে খেলা করতাম। প্রিয় নবী সা. ঘরে এলে তারা লজ্জায় লুকিয়ে যেত। তখন তিনি একজন একজন করে তাদেরকে আমার কাছে পাঠাতেন। তারা আবার খেলা শুরু করতো।” (সহীহ বুখারী-৬১৩০; সহীহ মুসলিম-২৪৪০)

শিশুদের আতঙ্কিত না করা

হযরত আবু লায়লা রা. বলেন: আমি প্রিয় রাসুল সা. এর নিকট বসা ছিলাম। হয়রত হাসান বা হুসাইন রা. প্রিয় নবী সা. বক্ষ মুবারকে বসা ছিল। আমি দেখলাম-সে প্রস্রাব করছে। (তাকে সরাবার জন্য) আমরা উঠলাম। কিন্তু নবীজি সা. আমাদেরকে বললেন:

ছাড়ো ওকে, তাকে আতঙ্কিত করো না; আমার ছেলেকে (নাতিকে) প্রস্রাব করতে দাও। (মুসনাদে আহমাদ-১৯০৫৯)

আর এটা শিশুর স্বাস্থেও যথেষ্ট ঝুকি বয়ে নিয়ে আসতে পারে। প্রিয় নবী সা. এর এহেন আচরণ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দিক থেকেও অতি গুরুত্বপূর্ণ।

শিশুদের জন্য বদদোয়া না করা

অপ্রাপ্ত বয়সে শিশুদের আকল বুদ্ধি অপুর্ণ থাকে। তারা বিরক্তিকর কিছু করলে তার জন্য দোয়া করা, যাতে তার মধ্যে সুন্দর পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে সন্তানের জন্য পিতা মাতার দোয়া কবুল হয়। এতে সন্তানরা উত্তম আখলাকের অধিকারী হতে পারে। ফলে সন্তান ও পিতার মাতা উভয়েরই দু’জাহানের মঙ্গল হবে। ইনশাআল্লাহ। অন্যদিকে সন্তানরা পিতামাতার বিরুদ্ধে কিছু করলে, তারা অসন্তুষ্ট হয়ে কোন বদদোয়া করলে আল্লাহ তায়ালা যদি কবুল করে ফেলেন তাহলে তাদের কারোর কোন লাভ হয় না। সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রিয় নবী সা. ফরমান:

“তোমরা নিজেদের জন্য বদদোয়া করো না। সন্তানদের জন্য বদদোয়া করো না। সম্পদের উপর বদদোয়া করো না। কারণ এমনও তো হতে পারে, আল্লাহর কাছে দোয়া কবুল হওয়ার সময় তোমরা বদদোয়া করলে আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করে নিলেন।” (সহীহ মুসলিম-৩০০৯; সুনানে আবু দাউদ-১৫৩২; সহীহ ইবনে হিব্বান-৫৭৪২)

শিশুরা দুরন্ত, চঞ্চল। তাদের নিকট সব কিছুই নতুন। তারা পৃথিবীর সব কিছুই নতুন করে উপভোগ করে। তারা দুনিয়ার সব ভাষা ও বস্তুর সাথে পরিচিত হয়। কারণ, তারা এ ধরাধামের নিতান্ত অতিথি। তারা অন্যালোকদের তুলনায় অদ্ভুত ধরণের কাজ কখনো করে বসে। তাদের কথা বলার ধরণ ও ভাব প্রকাশের ভঙ্গিমা হয়ে থাকে একদম নতুনের মতো। যে সব কিছু চিনে না, জানে না। তাই তাদের আচরণ হয়ে উঠে আগন্তুকের মত। এ সময় তারা শিখতে চায়, জানতে চায়। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সময় এটা। তাছাড়া ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। শিশুরাই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নির্মাতা। তাদের সাথে কি ধরণের আচরণ করতে হবে তা প্রিয় নবী সা. এর জীবন থেকে আমরা জানতে পাই। আমরা প্রিয় রাসুল সা. কে নিয়ে যতই শিখবো ততই আমাদের সকল ক্ষেত্রে কল্যাণের দরজা বুলন্দ হবে। বিশ্বে শ্রেষ্ঠ (খায়রুন উম্মাতুন) বলে আত্মপ্র্রতিষ্ঠিত করতে পারে।