ড. মুহাম্মদ নুরউদ্দিন কাওছার
বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে ইনসাফ, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, সাম্য ও সমতা অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে মানব সভ্যতায় বহুমাত্রিক গুরুত্ব বহন করে। শোষণহীন একটি কল্যাণকর ইসলামী রাষ্ট্র এসব অনুষঙ্গের ভিত্তির ওপর তার টেকসই ইমারত বিনির্মাণ করে। ‘উসওয়াহ হাসানাহ’য় বিভূষিত মহানবী (সা.) এর শিক্ষা ও কর্মের পথ অনুসরণ করার মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রে বৈষম্য নির্মূল এবং সকল মানুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার সত্যিকার কার্যকর নিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। তিনি আরবের জাহেলী সমাজে সবধরনের বর্বর প্রথা, রীতি ও পদ্ধতির বিরুদ্ধে ইস্পাতের ন্যায় দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন এবং সেগুলোর পেছনের দুয়ার চিরদিনের জন্য বন্ধ করেছিলেন। সুতরাং সভ্যতার ইতিহাস বারবার এটিই স্বাক্ষ্য দেয় যে, বিশ্বসভ্যতায় ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণ’ ইস্যুতে রাসূল (সা.)-এর আদর্শের বিকল্প কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নেই। মহানবী (সা.) মদীনার রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বৈষম্যহীনভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে জনসাধারণের হৃদয়ের মণিকোঠায় তিনি সপ্রতিভ অবস্থান করেছেন। তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তাঁর দেয়া দিকনির্দেশনা ও ফর্মুলাই জগতবাসীকে দিতে পারে শান্তি, সফলতা, মুক্তি এবং শোষণহীন ও বৈষম্যহীন সমাজ। আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল (সা.) মানবতার সামগ্রিক জীবনের জন্য এমন আদর্শ ও শিক্ষা নিয়ে আসেন, যা ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মানুষদের পরিণত করে ইতিহাসের সর্বোত্তম স্বর্ণমানবে, যা মানবতাকে সন্ধান দিলো ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের সামগ্রিক সফলতার এক সোনালি সোপান। যার ফলে মানুষে মানুষে গড়ে ীঠে সাম্য, মৈত্রী, মানবতা, একাত্মতা ও ভ্রাতৃত্বের মহাবন্ধন।
রাষ্ট্র সংষ্কারের ইতিহাস সুদীর্ঘ হলেও বিশ্বে একে সঠিক পন্থায় প্রয়োগ করতে মানবজাতি বারবার ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারে রাসূল (সা) আল্লাহ তাআলার দিকনির্দেশনার আলোকে কতিপয় নীতি গ্রহণ করেন। নুবুওয়াতের সূচনালগ্ন থেকে বিভিন্ন সময় এ নীতিসমূহ রাষ্ট্র গঠনে তিনি প্রয়োগ করেন। তাঁর গৃহীত রাষ্ট্র সংস্কারের নীতিসমূহ একটি সুসংগঠিত, সুসংহত, টেকসই ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য উপাদান হিসেবে পরিগণিত হয়। তিনি মাক্কী জীবনে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা করে অবশেষে মদীনায় হিজরতের পর একটি সভ্য ও কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। রাসূল (সা) মদীনার দশ বছর জীবনে এমন একটি সমাজকে আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন যারা কখনো গোত্রের বাইরে গিয়ে একটি কেন্দ্রীয় শাসনের অংশ ছিল না। এক্ষেত্রে ন্যায়ভিত্তিক আইনের শাসন অন্যতম চলক হিসেবে কাজ করে। তাই রাসূল (সা)-এর রাষ্ট্র সংস্কার নীতিসমূহ এতটাই কার্যকর ও পরিপক্ক ছিল যে, খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে মদীনায় তিনি রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ করে সফলতা লাভ করেন। একটি সুন্দর মানবসভ্যতা গড়ে তুলতে আল্লাহ রাসূল (সা)-কে পাঠিয়ে বলেন, ‘আমি আমার রাসূলদেরকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ পাঠিয়েছি আর তাদের সঙ্গে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও (সত্য মিথ্যার) মানদণ্ড যাতে মানুষ ইনসাফ ও সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে (৫৭-সূরা আল হাদীদ, ২৫)।’
রাসূল (সা.) এর পূর্বে যত অজ্ঞতা, বর্বরতা, নির্যাতন, শোষণ, সন্ত্রাস, ভয়ভীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণিবিদ্বেষ ছিল, সবই তাঁর মহান আদর্শের পরশপাথরে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। আল্লাহ নবী (সা) কে সিরাজুম মুনিরার চিরউজ্জ্বল রোশনি দিয়ে রাহমাতুললিল আলামিন হিসেবে ধরণীর বুকে প্রেরণ করেন। সিরাজুম মুনিরার সেই উজ্জ্বল রোশনির আলোকে তিনি পথহারা মানবজাতিকে পৌঁছে দেন হেদায়েতের সরণিতে। মানবসভ্যতার সবচেয়ে সমৃদ্ধ পর্যায়গুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে তার অতুলনীয় মহত্ত্ব ও গুণের সুস্পষ্ট ছাপ বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী (সা.)! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে (৩৩-সূরা আল আহযাব, ৪৫-৪৬)।’
বিশ্বনবীর ন্যায়বিচারের পদ্ধতি ও রূপরেখা
রাসূল (সা.) মদীনায় হিজরতের পর সর্বপ্রথম মসজিদে নববী নির্মাণ করেন। সেখানেই তিনি মুসলামানদের সমস্যাবলী সমাধান বা ফয়সালা দিতেন। তিনি সেখানে ইয়াহুদী, খ্রিস্টান ও পৌত্তলিকদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত এবং পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। উক্ত সনদের মাধ্যমে মদীনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। মহানবী (সা.) সে রাষ্ট্রের স্থপতি ও আমীর (প্রধান) এবং পদাধিকার বলে ছিলেন আল্লাহর মনোনীত মদীনার সর্বোচ্চ বিচারপতি। তিনি পরিপূর্ণ শাসক ও বিচারক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন একই সাথে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান ও প্রধান বিচারপতি। নবী মুহাম্মদ (সা.) আল কুরআনের শাশ্বত বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীতে শান্তি কায়েম করে গেছেন, যে বিচারব্যবস্থা একমাত্র কল্যাণকর ও ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থা যা সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি নিশ্চিত করে।
মানুষের অধিকার ও কর্তব্য পালনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য বিচারব্যবস্থার গুরুত্ব ও অস্তিত্ব অপরিহার্য। তাই আধুনিক সমাজব্যবস্থায় ন্যায়নীতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইসলামী বিচারব্যবস্থার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নুবুওয়াতী ধারাবাহিকতার সর্বশেষ মিশন মুহাম্মদ (সা.) এর হাতে পর্ণতা লাভ করে। তাঁর মিশনের লক্ষ্য ছিল সমাজের সবস্থান থেকে জুলুমের অবসান ঘটিয়ে মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করা। তিনি সম্যক উপলব্ধি করেন যে, ন্যায়বিচার এমন এক প্রচলিত নীতি যার প্রয়োগ সুস্থ সমাজের সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য। যে লক্ষ্য নিয়ে তিনি দুনিয়ায় আবির্ভূত হন, ২৩ বছরে প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে তিনি তা সার্থকভাবে কার্যকর করেন। তাঁর উপস্থাপিত জীবনব্যবস্থা মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বদিক দিয়ে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নিয়ামক ও চালিকাশক্তি। বৈষম্যহীণ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নববী পদ্ধতি ও রূপরেখা নিম্নে আলোকপাত করা হয়েছে।
১. সমাজের সর্বত্র ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা
জীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফ কায়েম সামাজিক উন্নয়নের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। কারণ, ন্যায়বিচার ছাড়া মানবজীবনের কোনো ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। মানবিক মর্যাদাবোধ ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধ এ গুণের কারণেই সৃষ্টি হয়। নিজের অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি সমাজের অপরাপর সদস্যদের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকা জরুরী, যেন কারো প্রতি জুলুম না হয়। কুরআনে বহুস্থানে স্পষ্টভাষায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ন্যায়-ইনসাফ কায়েমের নির্দেশনা প্রদান করে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফ, সদাচার ও নিকট আত্মীয়দের দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও সীমালঙ্ঘন থেকে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর (১৬-সূরা আন নাহল, ৯০)।’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোন কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত (৫- সূরা মায়েদা, ৮)।
মানব জীবনের গতিধারা বিশ্লেষণ করলে প্রমাণিত হয় যে, মানবসমাজ ন্যায়বিচার ও ইনসাফ ছাড়া এক মুহুর্ত ও চলতে পারে না। কেবল অঢেল বিত্ত ও বৈভব মানুষকে শান্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারে না, যদি সেখানে ন্যায়-ইনসাফ ও সুবিচারের ব্যবস্থা না থাকে। অপরদিকে বিত্তের প্রাচুর্য ও সম্পদের পাহাড় না থাকলেও কেবল ইনসাফপূর্ণ বিচারব্যবস্থার কারণে যে কোনো সমাজে শান্তি, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
রাসূল (সা.) বিচারকদের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে বলেন, ‘বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকার বিচারক জান্নাতী আর দুই শ্রেণির বিচারক জাহান্নামী হবে। জান্নাতী বিচারক হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যিনি মূল সত্যটি জেনে সে মুতাবিক রায় দিয়েছেন। আর যে বিচারক সত্য জানা সত্ত্বেও আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণ করে সে হবে জাহান্নামী। আর যে ব্যক্তি অজ্ঞতা অবস্থায় বিচারককার্য সম্পন্ন করে সেও জাহান্নামী হবে (ইবনে মাজাহ: ২৩১৫, তিরমিযী: ১৩২২)।’
যারা ন্যায়বিচার করতে চায় না তাদের আচরণ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখনই তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তাদের পরস্পর বিরোধ মীমাংসা করার জন্য, তখন তাদের একটি দল পাশ কেটে সরে পড়ে (২৪-সূরা আন নূর, ৪৮)।’
২. ন্যায়বিচারের মানদণ্ড কায়েম
আরবি ‘আল-আদল’ শব্দের সাদামাটা বাংলা প্রতিশব্দ ন্যায়বিচার। আল-আদল আল্লাহ তাআলার ৯৯টি সিফাতী নামের অন্যতম। আল্লাহ তাআলা ‘সর্বোত্তম ন্যায়বিচারক’, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক’- এ বিষয়গুলো আল-কুরআনের বহুআয়াতে তিনি নিজেই মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। ন্যায়বিচারের বিপরীত হলো জুলুম। তিনি জুলুমকে হারাম করে বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না। আর যদি সেটি ভাল কাজ হয়, তিনি তাকে দ্বিগুণ করে দেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে মহাপ্রতিদান প্রদান করেন (৪-সূরা নিসা, ৪০)।’
ন্যায়বিচারের মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আর কিয়ামতের দিন আমি ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না। কারো কর্ম যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা হাযির করব। আর হিসাব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট (২১-সূরা আম্বিয়া, ৪৭)।’
তিনি আরো বলেন, ‘আর তুমি চল সে অনুযায়ী যেমন নির্দেশ আসে তোমার প্রতি এবং সবর কর, যতক্ষণ না বিচার করেন আল্লাহ। বস্তুতঃ তিনি হচ্ছেন সর্বোত্তম বিচারক (১০-সূরা ইউনুস, ১০৯)।’
আকাশে অবস্থিত সকল বস্তুর মধ্যে মীযান [ভারসাম্য বা তুলাদণ্ড] বিদ্যমান রয়েছে উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, ‘আর সেদিন পরিমাপ হবে যথাযথ। সুতরাং যাদের পাল্লা ভারি হবে তারাই হবে সফলকাম (৭-সূরা আল আ‘রাফ, ৮)।’
আয়াতে উল্লেখিত শব্দ ‘ওজন’ এর কথা বলা হয়েছে, যা মীযান [তুলাদণ্ড ]-এ পরিমাপ করা হবে। যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এখানে ন্যায়বিচারের বিষয়টিই চলে আসে। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশ্বচরাচরের সবকিছুই সুনির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলের বিধানে আবদ্ধ। সুতরাং ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফের মাধ্যমেই পৃথিবীতে নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ মীযানের অর্থ করেছেন ‘আল-আদল’ বা ‘ন্যায়বিচার’ তথা ‘দাড়িপাল্লা’ বা ‘তুলাদণ্ড’। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে ‘আল-আদল’ বা ‘ন্যায়বিচার’ কায়েম করা এবং পারস্পরিক লেনদেনে ন্যায়-ইনসাফ সুপ্রতিষ্ঠিত করা (মাআরেফুল ক্বোরআন, পৃ. ১৩১৭)।
উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং ওজনে কমবেশি না করার প্রতি বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী আদালতসমূহে ‘দাঁড়িপাল্লা’কে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হলেও মানব সম্প্রদায়ের বৃহত্তর অংশ ও স্বৈরশাসকগণ মীযানের তেমন তোয়াক্কা করেন না করে প্রতিনিয়ত জুলুমতন্ত্র কায়েম করছেন। ন্যায়বিচার ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও অনেক মুসলিম শাসকের স্বেচ্ছাচারিতা, ঈর্ষাপরায়ণতা ও প্রতারণার বহুমুখী দাবানল থেকে জনগণ মুক্তি পাচ্ছে না। অথচ বিশ্ব মুসলিম সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা ঈমান আনে (মুসলিম) ও সৎকর্ম (ন্যায়বিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা) করে, তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ (৯৮-সূরা বায়্যিনাহ, ৭)।’
মহান আল্লাহ তাওহীদ প্রতিষ্ঠা এবং সমাজে ন্যায়বিচারের মানদণ্ড স্থাপনের জন্য নবী-রাসূল প্রেরণ করে বলেন, ‘আর আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং পরিহার কর তাগুতকে। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ কাউকে হিদায়াত দিয়েছেন এবং তাদের মধ্য থেকে কারো ওপর পথভ্রষ্টতা সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং তোমরা জমিনে ভ্রমণ কর অতপর দেখ, অস্বীকারকারীদের পরিণতি কিরূপ হয়েছে (১৬-সূরা আন নাহ, ৩৬)।’
নবী ও রাসূলগণ সমাজব্যবস্থাকে ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। যাতে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও বৈষয়িক কল্যাণের সমন্বয় ঘটে। তারা যেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিবন্ধক না হয়। বরং পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে নিজেদের আচার-আচরণে স্থিতিশীলতা তথা ভারসাম্য নিয়ে আসতে পারে। কেননা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন ও বহুবিধ কল্যাণ লাভ করা যায়। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনগণ পরস্পরে ভাই ভাই। অতএব তোমাদের দু’ভাইয়ের মধ্যে সন্ধি করে দাও। আর আল্লাহকে ভয় কর। তাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে (৪৯-সূরা হুজরাত, ১০)।’
৩. সুবিচার কায়েমের জন্য মানবরচিত সকল মন্ত্র-তন্ত্র সমূলে উৎখাত
পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে কোনো দেশ মানবরচিত আইন দিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি, আর তা কষ্মিনকালে পারবেও না। মানবরচিত আইন দিয়ে ক্ষমতার মসনদকে কুক্ষিগত করা যায়। কিন্তু সামাজিক ন্যায়বিচার সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। আল্লাহ মানবরচিত আইন ও মন্ত্র-তন্ত্রকে মানবজাতির জন্য হারাম করে দিয়েছেন। যারা মানবরচিত আইনে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করবে তারা হলো কাফের, মুশরিক ও ফাসেক। সুতরাং মানবরচিত অইন ও মন্ত্র-তন্ত্রকে সমাজ থেকে উৎখাত না করা পর্যন্ত ন্যায়বিচার সুদূর পরাহত বিষয় হিসেবে থেকে যাবে। আল্লাহর ভাষায়, ‘আর যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে ফয়সালা করে না, তারাই কাফির (৫-সূরা মায়েদা, ৪৪)।’
তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা সুবিচার করো! কারণ এটিই তাকাওয়ার অধিক নিটকবর্তী। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজের খবর রাখেন (৫-সূরা মায়েদা, ৮)।’
সমগ্র জগতের একচ্ছত্র মালিকানা যেহেতু মহান আল্লাহর, সেহেতু হুকুমও চলবে তাঁর। সৃষ্টি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন তার শরীক নেই তেমনই হুকুম প্রদানের ক্ষেত্রেও কাউকে শরীক করার অবকাশ নেই। বিষয়টি আল্লাহর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কথাই আমাদেরকে স্মরণ করে দেয়: ‘পূর্বাপর সমস্ত নির্দেশ দেওয়ার (ফয়সালা করার) ক্ষমতা কেবল আল্লাহ তাআলার (৩০-সূরা রুম, ৪০)।’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম (বিচার ব্যবস্থা) চলতে পারে না (১২-সূরা ইউসুফ, ৪০)।’
আইন প্রণেতা হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা। সুতরাং বিচারকার্জ পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান লংঘন করার অধিকার কারো নেই। ইরশাদ হচ্ছে, ‘শুনে নাও, সৃষ্টি একমাত্র তাঁরই। আর তিনিই একমাত্র হুকুম দেয়ার মালিক (৭-সূরা আ‘রাফ, ৫৪)।’
৪. আইনের দৃষ্টিতে সমতার নীতি বাস্তবায়ন
রাসূলুল্লাহ (সা.) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলেন। বংশকৌলীন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজের বন্ধন সুদৃঢ় করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, ‘মনে রেখ! আরবের জন্য অনারবের উপর, অনারবের জন্য আরবের উপর, লালের জন্য কালোর উপর এবং কালোর জন্য লালের উপর কোনরূপ প্রাধান্য/ শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তবে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীরুতা (বায়হাকী, শোআবুল ঈমান: ৫১৩৭; আহমাদ: ২৩৫৩৬; ছহীহাহ: ২৭০০)।’
তাই এই পৃথিবীতে সব মানুষই আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান। কৃষ্ণ-শ্বেত, ধনী-গরীব সবাই যে আল্লাহর সৃষ্ট মানুষ, সব মানুষই যে পরস্পর ভাই ভাই, ধর্মীয় ও কর্মীয় অধিকার যে সব মানুষেরই সমান- এ কথা দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করে স্বীয় কর্মে ও আচরণে তার কার্যকর প্রমাণ করেন মুহাম্মদ (সা.)। এ কারণে ইসলামে সবার জন্য স্বীকৃত হয়েছে ন্যায়বিচারের অধিকার।
রাসূল (সা.) মানব সভ্যতার এমন এক ক্রান্তিকালে নতুন সমাজ গড়ায় প্রয়াসী হন, যখন গোটা দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজে বর্ণপ্রথা, বর্ণবৈষম্য, বংশকৌলীন্য ও আভিজাত্যের দম্ভ মানুষকে গৃহপালিত জন্তু অথবা বিশেষ বৃক্ষের চেয়ে হীন পর্যায়ে নিয়ে যায়। জন্তুবিশেষ ও বৃক্ষবিশেষকে পবিত্র জ্ঞানে অর্চনা করা হতো তখন। সাধারণ মানুষের তুলনায় এসব জন্তু-বস্তুর মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। রাসূলুল্লাহ (সা.) মানুষের মননে ও মানসিকতায় এ কথা চিত্রায়িত করতে সক্ষম হন যে, সৃষ্টিজগতে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান ও সম্মানের যোগ্য এবং ভালোবাসার পাত্র হলো মানুষ। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। দুনিয়ার সব কিছু মানুষের কল্যাণে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। আর তাইতো ইসলামের বিচারব্যবস্থা সকলের জন্য সমানভাবে প্রাযোজ্য। ইসলামী বিচারব্যবস্থা, ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড়, রাজা-প্রজা, সবল-দুর্বল সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, কুরাইশরা একবার মাখযুমী গোত্রের এক মেয়ে চুরি করলে তাকে ক্ষমা করার জন্য উসামা বিন যায়েদ (রা.)-কে রাসূল (সা.)-এর দরবারে সুপারিশ পেশ করার জন্য প্রেরণ করেন। এ কথা শুনে নবীজি (সা.) বললেন, আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে সুপারিশ করছ! অতপর নবীজি (সা.) দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা এ জন্যেইতো ধ্বংস হয়ে গেছে যখন তাদের অভিজাত বংশের কোন লোক চুরি করত তখন তারা তাকে ক্ষমা করে দিত। আর যখন কোন দুর্বল লোক চুরি করত তখন তার উপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর শপথ! যদি মুহাম্মদ তনয়া ফাতিমাও চুরি করে তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম (বুখারী: ৩৪৭৫, মুসলিম: ৪৫০৫)।
মহানবী (সা.) সব মানুষের প্রতি ছিলেন উদার। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী বিচারে তিনি করো প্রতি জুলুম, অন্যায় ও অবিচার করেননি। সমাজে বসবাসকারী সকল সদস্যদের সাথে ন্যায়বিচার এবং উত্তম আচরণ করার শিক্ষাই বিশ্বনবীর শিক্ষা। ন্যায়, শান্তি ও নিরাপত্তার আচরণ অবলম্বন করার বিষয়ে তিনি ইসলামী শিক্ষামালার সারাংশ এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম। আর যাকে মানুষ তাদের জান ও মালের জন্য নিরাপদ মনে করে সে-ই প্রকৃত মুমিন (তিরমিযী: ২৬২৭)।’
ধর্মপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং আল্লাহর নির্দেশনা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে যার মাত্রা যত বেশি সে আল্লাহর কাছে ততবেশী পছন্দনীয়। রাসূল (সা.) উম্মতকে এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘হে মানবসমাজ! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর তোমাদেরকে বিভিন্ন কওম ও গোত্র বানিয়ে দিয়েছি, যাতে তোমরা একে অপরকে (সেসব নামে) চিনতে পার। আসলে আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে তারাই অধিক সম্মানিত, যারা তোমাদের মধ্যে বেশি মুত্তাকী। আল্লাহ সব কিছু জানেন, সব কিছুর খবর রাখেন (৪৯-সূরা হুজরাত, ১৩)।’
৫. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা
রাসূল (সা.) বিচারব্যবস্থায় মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য করেননি। ইসলামে শুরু থেকে শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগ আলাদা করার ওপর জোর দিয়েছে (ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ ও অন্যান্য, ২০১৮: ৭০; মুহম্মদ মতিউর রহমান, ২০১৭: ৮৮-৯৩)। বিভিন্ন প্রকার অবিচার, অনাচার দূরীকরণের জন্য মুহাম্মদ (সা.) আইনের শাসন কায়েম করেন। আইনকে ব্যক্তিবিশেষ অথবা কোন গোত্রের হাতে না দিয়ে কেন্দ্রীয় বিচার বিভাগের হাতে ন্যস্ত করেন। যেন আইন কারো ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার না হয়। তিনি বিচারব্যবস্থায় মানবাধিকারের অনন্য বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। খলিফা বিচারপতিদের নিয়োগ করতেন কিন্তু তারা বিচারকাজে খলিফা বা শাসনকর্তাদের অধীন হতো না। খলিফা কিংবা শাসনকর্তারা অভিযুক্ত হলে সাধারণ আসামীদের মতই তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারের সম্মুখীন হতে হতো (জিয়া হাবীব আহ্সান, ২০১৬)।
সহজভাবে বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা হলো, আইনানুযায়ী সরকারের বিচারকার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন। এজন্য বিচার বিভাগকে সর্বপ্রকার হস্তক্ষেপমুক্ত থাকতে হয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে আইনের ব্যাখ্যা দান ও বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচারকদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতাকে বোঝায়। কারণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা খুবই অপরিহার্য উপাদান হিসেবে কাজ করে। বিচারকগণ যদি স্বাধীন বা মুক্ত না থাকতে পারেন তাহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই কোন বিবাদ মীমাংসার ক্ষেত্রে বিচারকগণকে অবশ্যই সততা, বিচক্ষণতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করতে হবে। জনগণের স্বাধীনতা দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগের উপর নির্ভরশীল। যার জন্য বিচার বিভাগকে সর্বদা সর্বপ্রকার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভাব এবং সরকারি হস্তক্ষেপ মুক্ত থাকতে হবে। অধ্যাপক গার্নারের মতে, ‘If
the judges’ wisdom, probity, and free-dom of decision, the high purposes for which the judiciary is established cannot be secured (Garner: 792).’
লর্ড ব্রাইসের মতে, ‘কোন দেশের সরকারের কৃতিত্ব পরিমাপ করার সর্বোত্তম মাপকাঠি হচ্ছে তার বিচার বিভাগের দক্ষতা ও যোগ্যতা।’
অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কোন বিকল্প নেই। ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থায় এ স্বাধীনতা অপরিহার্য। রাসূল (সা.) এর নিজ হাতে গড়া সোনার মানুষগুলো সেই স্বাধীনতা রাষ্ট্রে নিশ্চিত করেছিলেন। ইসলামী আইনের চোখে ও মুসলিম বিচারকের কাছে সকল মানুষই সমান। শাস্তি, বিচার এবং আইনী পদক্ষেপ সকল জাতি, শ্রেণি ও ব্যক্তির ওপর সমানভাবে প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে বিশেষ শ্রেণি, গোষ্ঠী, বংশ, জাতি পরিচয়ে কেউ রেহাই পেতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেকে যা করে তদানুসারে তার মর্যাদা রয়েছে এবং তারা যা করে সে সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালক বেখবর নন (৬Ñসূরা আল আনআম, ১৩২)।’
ন্যায়বিচার মানে সমাজের প্রত্যেক নাগরিক নায্যতা, যথার্থতা ও স্বচ্ছতা উপভোগ করবে। প্রত্যেকেই তাদের ন্যায্য অধিকারের নিশ্চয়তা পাবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করবে। দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রেও ইনসাফ বজায় রাখা হবে। শ্রেণি, বর্ণ, গোত্র, ব্যক্তি ভেদে কাউকে অগ্রাধিকার কিংবা কারো সাথে অবিচার করা হবে না। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ; যদিও এটা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়; সে বিত্তবান হোক অথবা বিত্তহীন হোক আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর।
সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না। যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল অথবা পাশ কাটিয়া যাও তাহলে তোমরা যা কর আল্লাহ তো ঐ সম্যক খবর রাখেন (৪-সূরা নিসা, ১৩৫)।’
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন ন্যায়পরায়ণ শাসক আল্লাহ তাআলার খুবই প্রিয়ভাজন ও কাছাকাছি থাকবেন। আর অবিচারী ও অত্যাচারী শাসক খুবই ঘৃণিত ও দূরে থাকবে (তিরমিযী: ১৩২৯)।’
৬. পক্ষপাতমূলক, প্রভাবিত, আবেগতাড়িত হয়ে কোন বিচারকার্য পরিচালনা করা যাবে না
রাসূল (সা.) পক্ষপাতিত্ব, প্রভাবিত, আবেগতাড়িত হয়ে কোন বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন এমন একটি ছোট্ট ঘটনাও তাঁর বিচারক জীবনের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তিনি ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে কোনদিন নিজের আহাল, আত্মীয়-পরিজন ও জলিল-কদর কোন সাহাবীর পক্ষও অবলম্বন করেননি। এ জন্য তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র একজন শ্রেষ্ঠতর মহামানবের সাথে সাথে একজন শ্রেষ্ঠ প্রধান বিচারপতিও বটে। তাঁর এ ন্যায়বিচারের কারণেই হাজরা মাউত থেকে সান‘আ পর্যন্ত সুন্দরী তনয়া, মূল্যবান অলঙ্কার পরিহিতা, একাকিনী দিনে রাতে পথ চলছে কেউ তাকে জিজ্ঞেস করবে তো দূরের কথা তার দিকে চোখ তুলে তাকাবার প্রয়োজন বোধ করতো না।
৭. সবার সাথে ন্যায়সূলভ আচরণ করা
ন্যায়বিচারের আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিজেদের ঘর, সমাজ, আপন-পর, এমনকি শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার সাথে ন্যায়সূলভ ব্যবহারের মাধ্যমেই প্রকৃত অর্থে বিচার বিভাগ স্বাধীন হতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘আর মুমিনদের দু’দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তাদের মাঝে তোমরা মীমাংসা করে দিও। এরপর তাদের মাঝে একদল অন্যদলের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন করলে যে দল সীমালঙ্ঘন করে, তারা আল্লাহর সিদ্ধান্তের দিকে ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। এরপর তারা আল্লাহর সিদ্ধান্তের দিকে ফিরে এলে তোমরা উভয়ের মাঝে ন্যায়পরায়ণতার সাথে মীমাংসা করে দিও এবং সুবিচার করো। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালবাসেন (৪৯-সূরা হুজরাত, ৯)।’
৮. বিচারক সহ বিচারপ্রার্থী ও বিবাদীর মনে সদাসর্বদা আল্লাহর ভয় জাগ্রত থাকা
ন্যায়বিচার করা, সত্যকথা বলা, স্বজনপ্রীতি পরিহার করা এবং দুর্নীতির মূলোচ্ছেদের প্রচেষ্টা হচ্ছে তাকওয়ার পরিচায়ক। এটা একমাত্র ঈমানে দৃঢ়তা সম্পন্ন জবাবদিহিতার ভয়ে আল্লাহভীতি, আল-ফিতরায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব। এই বিষয়টাই সূরা মায়েদার ৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন। প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে যারা সমাজে অনাচার সৃষ্টি এবং ন্যায়বিচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তারা অবগত নয় যে, শেষ বিচারে তাদেরকে এসকল অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। উম্মাহকে সর্তক করার জন্যে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তি আপন ভাইয়ের উপর জুলুম করে থাকলে সে যেন তার কাছ থেকে (পার্থিবেই মৃত্যুর) পূর্বেই মাফ করিয়ে নেয়। কারণ শেষ বিচারে (মজলুম) ভাইয়ের পক্ষে তার নেকীর অংশ কেটে নেয়া হবে, কিন্তু যদি নেকী তার (জালিমের) নিকট মওজুদ না থাকে তবে, তার (মজলুমের) ভাইয়ের গুনাহ কেটে এনে-এর [জালিমের] সাথে যোগ করে দেয়া হবে। কেননা, সেদিন দিনার-দেরহামের কোন লেনদেন কিংবা আদান-প্রদান চলবে না (বুখারী: ৬০৮৪)।’
৯. ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিচারকাজ পরিচালনা করা
ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিচারকাজ পরিচালনা না করা সম্পর্কে নবী (সা.) কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘আল্লাহ একজন বিচারকের সাথে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ তিনি বিচারকাজে জুলুম-অত্যাচারের ঊর্ধ্বে থাকেন, যখন তিনি জুলুম ও বেইনসাফি করেন তখনই আল্লাহ তার থেকে পৃথক হয়ে যান এবং শয়তান এসে তার সাথী হয়ে যায় (তিরমিযী: ১৩৩০)।’
আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কখনও মনে করবে না যে, জালিমরা যা করে, সে বিষয়ে আল্লাহ গাফিল। তিনি তাদেরকে সে দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন, যে দিন তাদের চোখগুলো হবে স্থীর, ভীত বিহবল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছুটাছুটি করবে, নিজেদের প্রতি তাদের দৃষ্টি ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে শূণ্য (১৪-সূরা ইবরাহীম, ৪২-৪৩)।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, মুমিনগণ যখন জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে, তখন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে এক পুলের উপর তাদের আটকে রাখা হবে। তখন পৃথিবীতে একের প্রতি অন্যের যা যা জুলুম ও অন্যায় ছিল, তার প্রতিশোধ গ্রহণের পরে যখন তারা পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে, তখন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। সেই সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যেকে পৃথিবীতে তার আবাসস্থল যেরূপ চিনত, তার চাইতে অধিক তার জান্নাতের আবাসস্থল চিনতে পারবে (বুখারী: ২২৭৮)।’
১০. কারো প্রতি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে বিচার না করা
এ ব্যাপারে আল-কুরআনের নীতিমালা হলো: ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের সাক্ষ্যদাতা হিসেবে আল্লাহর পথে দৃঢ়ভাবে দণ্ডায়মান থাক, কোন সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা তোমাদেরকে যেন এতটা উত্তেজিত না করে যে তোমরা ইনসাফ করা ত্যাগ করবে, সুবিচার কর, এটা তাকওয়ার নিকটবর্তী, তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল (৫-সূরা মায়েদা, ৮)।’
রাসূল (সা.) বলেন, কানো বিচারক রাগান্বিত অবস্থায় দু’জনের মাঝে বিচার-ফায়সালা করবে না। (বুখারী: ৭১৫৮, মুসলিম: ১৭১৭)।
১১. জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
রাসূল (সা.) রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ছিল, শাসন, কর্তৃত্ব এবং তার ক্ষমতা ইখতিয়ার ও এবং অর্থ-সম্পদ আল্ল¬াহ এবং মুসলমানদের আমানত। আল্ল¬াহ ভীরু, ঈমানদার এবং ন্যায়পরায়ণ লোকদের হাতে তা ন্যস্ত থাকবে। এ আমানত যাদের হাতে সোপর্দ করা হবে তারা এর দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জবাবদিহি করতে বাধ্য। রাসূল (সা.) সরকার কাঠামোতে ও প্রশাসনিক পরিমণ্ডলে সরকারি যাবতীয় কার্যক্রমের জবাবদিহির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি আল্ল¬াহর বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে তাঁর জবাবদিহিতার বহি:প্রকাশ ঘটান এভাবে, ‘আমানত বহনের যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে আমানত সোপর্দ করার জন্য আল্ল¬াহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। আর যখন মানুষের মধ্যে ফায়সালা করবে, ন্যায়নীতির সাথে ফায়সালা করবে, আল্ল¬াহ তোমাদেরকে ভাল উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন (৪-সূরা নিসা, ৫৮)।’
তিনি বলেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল, আর (পরকালে) নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে তোমাদের প্রত্যেককেই জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং জনগণের শাসকও একজন দায়িত্বশীল লোক, তার দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। আর প্রত্যেক পুরুষ তার পরিবারের একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। আর স্ত্রী তার স্বামীর ঘর-সংসার ও সন্তান-সন্তুতির ওপর দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। এমনকি কোনো গোলাম বা চাকর-চাকরাণীও তার মুনীবের ধন-সম্পদের ওপর একজন দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। অতএব সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল, আর তোমাদের প্রত্যেককেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে (বুখারী: ৭১৩৮; মুসলিম: ১৮২৯)।’
রাসূল (সা)-এর রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ছিল- শাসন, কর্তৃত্ব এবং তার ক্ষমতা ইখতিয়ার ও এবং অর্থ-সম্পদ আল্ল-াহর। আল্লাহভীরু, ঈমানদার এবং ন্যায়পরায়ণ লোকদের হাতে তা ন্যস্ত থাকবে (রহীম, ১৯৯৫: ৩০-৪১)। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় জবাবদিহিতার বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই অধীনস্থদের (দায়িত্ব) সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হবে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি, তাকে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে (বুখারী: ৮৯৩, ২৪০৯, ২৫৫৪)।’
১২. আল্লাহর দরবারে ন্যায়পরায়ণ শাসক/বিচারকের অবস্থান ও মর্যাদা
মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না। (তারা হল,) ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ (বিচারক/শাসক/নেতা), সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত হয়, সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদসমূহের সাথে লটকে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।) সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালোবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসার উপরেই আমৃত্য অটুট থাকে। সেই ব্যক্তি যাকে কোন কুলকামিনী সুন্দরী রমনী (অবৈধ যৌন-মিলনের উদ্দেশ্যে) আহবান করে, কি সে বলে, ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি।’ সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপন করে; এমনকি তার ডান হাত যা দান করে, তা তার বাম হাত পর্যন্ত জানতে পারে না। আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায় (বুখারী: ৬৬০, মুসলিম: ২৪২৭)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহর নিকট যারা ন্যায়পরায়ণ তারা দয়াময়ের ডান পার্শ্বে জ্যোতির মিরের উপর অবস্থান করবে। আর তাঁরা উভয় হস্তই ডান। (ঐ ন্যায়পরায়ণ তারা) যারা তাদের বিচারে, পরিবারে এবং তার কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বাধীন ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে ন্যায়নিষ্ঠ (মুসলিম: ৪৮২৫)।
আমর বিন আস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, বিচারক যদি সুবিচারের প্রয়াস রেখে বিচার করে অতঃপর তা সঠিক হয়, তবে তার জন্য রয়েছে দুটি সওয়াব। আর সুবিচারের প্রয়াস রেখে যদি বিচারে ভুল করেও বসে, তবে তার জন্যও রয়েছে একটি সওয়াব (বুখারী: ৭৩৫২, মুসলিম: ৪৫৮৪)।
১৩. বিধর্মীদের সঙ্গে ইনসাফ ও সুবিচার
রাসূল (সা.) কথাবার্তা, চালচলন ও অন্যান্য বিষয়ে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কোনো ঘটনা ঘটলে তা সত্য ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে ফয়সালা করতেন। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোষহীন ও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি কোনো মুসলিমের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা শপথ করে, তাহলে সে আল্লাহর সমীপে এমন অবস্থায় হাজির হবে যে আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত থাকবেন। আশআস (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! এটা আমার সম্পর্কেই ছিল, আমার ও এক ইহুদি ব্যক্তির সঙ্গে যৌথ মালিকানায় একখণ্ড জমি ছিল। সে আমার মালিকানার অংশ অস্বীকার করে বসল। আমি তাকে নবী (সা.)-এর কাছে নিয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেন, তোমার কোনো সাক্ষী আছে কী? আমি বললাম, না। তখন তিনি (নবী) ইহুদিকে বলেন, তুমি কসম করো। আমি তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, সে তো কসম করবে এবং আমার সম্পত্তি নিয়ে নেবে। তখন আল্লাহ (এ আয়াত) নাজিল করেন, যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছমূল্যে বিক্রি করে... আয়াতের শেষ পর্যন্ত (৩-সূরা আলে ইমরান, ৭৭) (বুখারী: ২২৫৬)।
১৪. স্ত্রীদের সঙ্গে সমতা রক্ষা
স্ত্রীদের সঙ্গে সমতা বজায় রাখা রাসূল (সা.)-এর আদর্শ ছিল। একজনকে কাপড় একটি দেবেন, আর অপরজনকে দুটি দেবেন, একজনকে ভালো মানের খাবার দেবেন এবং অপরজনকে মন্দ মানের খাবার দেবেন, এমনটি তিনি কখনও করতেন না। স্ত্রীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করার অভ্যাস তার ছিল না। এমনকি মহানবী (সা.) রাত্রিযাপনের ক্ষেত্রেও প্রত্যেক স্ত্রীর সঙ্গে সমতা বজায় রেখে চলতেন। এটা ছিল তার সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতার অনন্য নিদর্শন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) সফরের মনস্থ করলে স্ত্রীদের মধ্যে লটারির ব্যবস্থা করতেন। যার নাম আসত, তিনি তাকে নিয়েই সফরে বেরুতেন। এ ছাড়া প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য একদিন একরাত নির্দিষ্ট করে দিতেন। তবে সাওদা বিনতে জামআ (রা.) নিজের দিন ও রাত নবীজি (সা.)-এর স্ত্রী আয়েশা (রা.)-কে দান করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি রাসূল (সা.)-এর সন্তুষ্টি কামনা করতেন (বুখারী: ২৫৯৩)।
১৫. ধন-সম্পদ বণ্টনে ন্যায়বিচার ও সমতা বিধান
সতরাং রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য পবিত্র কুরআন, হাদীস ও সাহাবাদের ঐকমত্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। পক্ষপাতিত্ব, জুলুম ও অজ্ঞতা বিচারব্যবস্থাকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। তাই রাসূল (সা.) মানব সভ্যতার অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট পরিবার থেকেই ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছেন। সন্তানদের মাঝে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টিকারী এক ব্যক্তির বিষয়ে রাসূল (সা.) দরবারে অভিযোগ উত্থাপিত হলে তিনি কৃত বণ্টন প্রত্যাখ্যান করেন। আমির (র.) বলেন, আমি নোমান ইবনে বশির (রা.)-কে মিম্বরে বলতে শুনেছি, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন আমার মা আমরা বিনতে রাওয়াহা (রা.) বললেন, রাসূল (সা.)-কে সাক্ষী রাখা ছাড়া সম্মত নই। তখন তিনি রাসূল (সা.)-এর কাছে এলেন। বললেন, ‘আমরা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে।’ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার সব ছেলেকেই কি এ রকম দিয়েছ?’ তিনি বললেন, ‘না।’ রাসূল (সা.) বললেন, ‘তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং আপন সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর (বুখারী: ২৫৮৬, মুসলিম: ১৬২৩)।
১৬. নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে সুবিচার
রাসূল (সা.) নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে ‘হিলফুল ফুজুল’ প্রতিষ্ঠা করে জাহেলী সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অনুপম স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তাঁর ইনসাফের প্রতি শতভাগ আস্থা থাকার কারণে কুরাইশরা কাবার দেওয়ালে ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্থাপন নিয়ে যখন মতবিরোধে লিপ্ত, তখন মহানবী (সা.)-কে তারা বিচারক হিসেবে গ্রহণ করেন এবং নবীজী (সা.)-এর প্রতি সকলেই সুবিচারকারী হিসেবে সন্তুষ্ট হন। তিনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তা সবাই এক বাক্যে মেনে নেওয়ার কথা প্রকাশ করে। অথচ তাঁর গোত্র বনু হাশিমও ফায়সালায় শরিক ছিল। তারপরও রাসূল (সা.) ইনসাফের প্রতি শতভাগ আস্থা রেখে অন্যগোত্র তাঁকে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করে।
সুতরাং মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনে রাসূলুল্লাহ নুবুওয়াতের ২৩ বছরের জিন্দেগীতে বিরামহীন নিরলস দায়িত্ব পালন করে গেেেছন। তিনি নুবুওয়াত প্রাপ্তি থেকে শুরু করে ওফাত অবধি আল-কুরআনের রাষ্ট্র গঠনে রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তিনি হিজরতের পর মদীনায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে মানব সভ্যতার সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর রাষ্ট্র সংস্কার-এর নীতি ও কৌশলের মধ্যেই মানবজাতির জন্য স্থায়ী ও স্থিতিশীল সমাধান নিহিত রয়েছে। তিনি কুরআন-সুন্নাহর আলোয় এমন এক রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছেন যার প্রতিটি উপাদান হলো- আকর্ষণীয় ও কার্যকরী। রাসূল (সা) অনুশীলীত নীতি ও কৌশল একটি সভ্য ও যোগ্যতাসম্পন্ন আদর্শ জাতি গঠনে সক্ষম। তিনি রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবর্তনের জন্য স্থায়ী ও টেকসই কর্মসূচী হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছেন। আধুনিক দুনিয়ায় তাঁর অনুসৃত রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়া ও কর্মসূচী গ্রহণ করলে আলোকিত ও সুন্দর রাষ্ট্র উপহার দিতে সক্ষম হবে। মুহাম্মদ (সা)-এর জীবন ও শিক্ষা বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের একটি অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় উপমা। তাঁর নৈতিকতা, দায়িত্বশীলতা, এবং সাম্যের শিক্ষা শুধুমাত্র তার সময়ের সমাজকেই পরিবর্তন করেনি; বরং এটি পরবর্তীতে মানব সমাজের জন্য একটি আদর্শ ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর অনুশীলিত নীতিমালা ও পদক্ষেপগুলো আজও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মৌলিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি সকল মানুষের মধ্যে সমতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা করেছেন, নারীদের অধিকার উন্নত করেছেন, এবং ধর্মীয় সহনশীলতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর নির্দেশনায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত এবং সংহত সমাজ গঠনের পথ প্রশস্ত করেছে। মহানবী (সা)-এর শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ একটি সমষ্টিগত প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ হতে পারে। এটি আমাদের সকলকে মনে করিয়ে দেয় যে, একে অপরকে সম্মান জানানো, সহযোগিতা করা, এবং সাম্য ও ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা আমাদের সামাজিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। জর্জ বার্নার্ডশ বলেন, f all the world was under one leader then
Mohammad (sm) would have been the best fitted man to lead the peoples of var-
ious creed dogmas and ideas to peace and happiness.
রেফারেন্স
১. আল-কুরআন।
২. বুখারী।
৩. মুসলিম।
৪. আবু দাউদ।
৫. নাসায়ী।
৬. ইবনে মাজাহ।
৭. তিরমিযী।
৮. মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’, তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, মাওলানা মুহীউদ্দিন খান অনূদিত, মদীনা মোনাওয়ারা: খাদেমুল- হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রন প্রকল্প, ১৪১৩ হি.।
৯. J. W. Garner, Political Science and Government, New York: American Book Company, 1932
১০. ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ ও ড. মো. ইব্রাহীম খলিল, ইসলামে মানবাধিকার, (ঢাকা: মেরিট ফেয়ার প্রকাশন, ২০১৮ খ্রি.।
১১. মুহম্মদ মতিউর রহমান, মানবাধিকার ও ইসলাম, ঢাকা: বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি., ২০১৭ খ্রি.।
১২. জিয়া হাবীব আহ্সান, বিশ্ব মানবাধিকারের সফল প্রবক্তা হযরত মুহাম্মদ মোস্তাফা স., পাঠক.নিউজ, ডিসেম্বর ১১, ২০১৬।
১৩. মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম, আল কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকার, ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ১৯৯৫ খ্রি.।